ভূমিকম্প যখন আঘাত হানে তখন দুপুরের ওই সময়ে বহু মানুষ রমজানের শেষ জুমা পড়তে মসজিদগুলোতে জড়ো হয়েছিলেন।
Published : 29 Mar 2025, 11:13 PM
শক্তিশালী ভূমিকম্প মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলে যখন আঘাত হানে, শুক্রবারের ওই সময় হাতেত মিন উ জুমার নামাজ পড়তে মান্দালয়ে তাদের বাড়ির পাশের মসজিদে গিয়ে ওজু করছিলেন।
ভূমিকম্পে মসজিদের একটি অংশের পাশাপাশি তাদের বাড়িও ধসে পড়ে। তার শরীরের অর্ধাংশ ধসে পড়া একটি দেয়ালের ধ্বংসাবশেষের নিচে আটকা পড়ে, তার দুই চাচি ওই দেয়ালের নিচে পুরোপুরি চাপা পড়েন। স্থানীয় বাসিন্দারা দৌঁড়ে এসে তার দুই চাচিকে উদ্ধারের চেষ্টা চালান, কিন্তু মাত্র একজনকে বাঁচাতে পারেন।
হাতেত মিন উ (২৫) রয়টার্সকে জানান, তার দুই চাচা আর দাদিও ক্রংক্রিটের স্তূপের নিচে আটকা পড়েছিলেন, ভারী কোনো যন্ত্রপাতি না থাকায় তিনি হাত দিয়েই ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে তাদের বের করার বেপরোয়া চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সেগুলো সরাতে পারেননি।
“ধ্বংসস্তূপের নিচে তারা এখনও বেঁচে আছেন কি না আমি জানি না। এত দীর্ঘ সময় পরে আর কোনো আশা আছে বলে আমার মনে হয় না,” শুক্রবার বলেন তিনি।
“সেখানে অনেক অনেক ধ্বংসস্তূপ ছিল আর আমাদের জন্য কোনো উদ্ধারকারী দল আসে নাই,” কম্পিত কন্ঠে এমনটি বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
ভূমিকম্প যখন আঘাত হানে তখন দুপুরের ওই সময়ে বহু মানুষ রমজানের শেষ জুমা, জুমাতুল বিদা পড়তে মসজিদগুলোতে জড়ো হয়েছিলেন। মিয়ানমারে নিহত প্রায় দুই হাজার মানুষের মধ্যে কয়েকশ মুসলিম আছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
দেশটির ছায়া জাতীয় ঐক্য সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ৫০টিরও বেশি মসজিদ ভূমিকম্পে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মান্দালয় অঞ্চলের ৩৯ বছর বয়সী এক বাসিন্দা সুলে কোনে গ্রামে ধসে পড়া এক মসজিদের ধ্বংসাবশেষে আটকা পড়া এক ব্যক্তিকে উদ্ধারের চেষ্টার মর্মভেদী বর্ণনা দেন। তিনি ওই ব্যক্তিকে যখন ধসে পড়া কংক্রিটের স্তূপের ভেতর থেকে বের করার চেষ্টা করছিলেন তখন শক্তিশালী পরাঘাত ঘটে, এতে নিজের জান বাঁচাতে তাকে পালাতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যক্তি বলেন, “তাকে আমার পেছনে ফেলে আসতে হয়। তাকে উদ্ধার করতে আমি দ্বিতীয়বার সেখানে গিয়েছিল। আমি নিজ হাতে চারজনকে উদ্ধার করতে পেরেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনজনের ইতোমধ্যে মৃত্যু হয়েছিল আর একজন আমার হাতের মধ্যে থাকা অবস্থায়ই মারা যান।”
তিনি জানান, সেখানে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে আর এরাসহ ওই গ্রামের ধ্বংস হয়ে যাওয়া তিনটি মসজিদে মোট ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তিনি জানান, সরকারি বিধিনিষেধের কারণে শেষ পর্যন্ত কতোজনের মৃত্যু হয়েছে তা জানতে পারেননি তারা।
বৌদ্ধ প্রধান দেশ মিয়ানমারে মুসলিমরা সংখ্যালঘু। ক্ষমতায় আসা প্রত্যেকটি সরকারই তাদের অবহেলা করেছে। আর অতি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো ও চরমপন্থি ভিক্ষুরা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সহিংসতা উস্কে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষগুলো কয়েক দশক ধরে মুসলিমদের নতুন মসজিদ নির্মাণ বা পুরনোগুলো সংস্কার করার অনুমতি দেওয়ার বিষয়গুলো কঠিন করে রেখেছে, এর ফলে ঐতিহাসিক মসজিদগুলোর অবস্থা জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়েছে কারণ সেগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়গুলোও উপেক্ষিত হয়েছে।
ভূমিকম্পে বৌদ্ধদের অনেক স্থাপনাও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশটির জান্তা সরকার জানিয়েছে, ৬৭০টি বিহার ও ২৯০টি প্যাগোডা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে নিজেদের প্রতিবেদনে তারা কোনো মসজিদের কথা উল্লেখ করেনি।
ভূমিকম্পে মিয়ানমারেই মৃত হাজার ছাড়াল, কারাবন্দি সু চি 'নিরাপদে আছেন'
মিয়ানমারে ভূমিকম্প: মৃত্যু ছাড়াতে পারে ১০ হাজার, বলছে ইউএসজিএসের মডেল
রয়টার্সও এ বিষয়ে স্বতন্ত্রভাবে কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে বা জান্তার দেওয়া তথ্য যাচাই করতে পারেনি।
ভূমিকম্পে ধ্বংস হওয়া মান্দালয়ের আরেকটি মসজিদের কংক্রিটের পিলার সরাতে ভারী যন্ত্রপাতির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবেদন জানিয়েছেন জুলিয়ান কাইল নামে এক ব্যক্তি।
নিজের পোস্টে তিনি লিখেছেন, “ধ্বংসস্তূপের নিচে আমার পরিবারের সদস্যরা ও অন্যরা চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। আমরা যেকোনোভাবে তাদের মরদেহ উদ্ধার করতে চাই।”
মান্দালয় থেকে প্রায় ৩৭০ কিলোমিটার দূরে তাংনু নামের এক ছোট শহরের এক বাসিন্দা জানান, তিনি নামাজ পড়ার সময় কান্দাও মসজিদের একটি অংশ তার সামনে থাকা দুই সারি মানুষের ওপর ভেঙে পড়ে।
“আমি মসজিদটি থেকে বহু মানুষকে বের করে আনতে দেখলাম, তাদের অনেকে আমার চোখের সামনেই মারা গেলেন। এটি সত্যিই হৃদয়বিদারক!”