সাম্প্রতিক মাসগুলোতে শ্রমিক ঘাটতি এবং রেকর্ড সামরিক ব্যয়ের কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি চালু করা সুদের উচ্চ হারের দরুন সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি কিছুটা চাপে পড়েছে।
Published : 23 Jan 2025, 03:44 PM
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার যুদ্ধকালীন অর্থনীতির সংকট নিয়ে ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছেন, তাও এমন এক সময়ে যখন সদ্য শপথ নেওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেইনে যুদ্ধ বন্ধে মস্কোর ওপর চাপ বাড়াচ্ছেন।
পরিস্থিতি সম্বন্ধে অবগত পাঁচটি সূত্রের বরাত দিয়ে এমনটাই জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইনে রাশিয়ার অভিযান শুরুর পর পশ্চিমারা মস্কোর ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গেলেও তেল, গ্যাস ও খনিজ রপ্তানিনির্ভর রুশ অর্থনীতি সেসব টপকেই দোর্দণ্ড প্রতাপে এগিয়ে যাচ্ছিল।
তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে শ্রমিক ঘাটতি এবং রেকর্ড সামরিক ব্যয়ের কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি চালু করা সুদের উচ্চ হারের দরুন সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি কিছুটা চাপে পড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে দেশটির অভিজাতদের একটি অংশের কাছে সংঘাত নিরসনে আলোচনাই আকাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠছে, জানিয়েছে ক্রেমলিনের অভ্যন্তরে চলমান চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত দুটি সূত্র।
সোমবার হোয়াইট হাউজে ফেরা ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে চলা সবচেয়ে বড় সংঘাত রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ দ্রুত বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলেন।
শপথ নেওয়ার পর তিনি পুতিনকে সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট যদি আলোচনায় না বসেন তাহলে রাশিয়াকে নতুন শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হবে।
রাশিয়ার অর্থনীতি ‘বিশাল সমস্যার’ দিকে এগুচ্ছে বলেও সাবধান করেন তিনি।
এর প্রত্যুত্তরে মঙ্গলবার ক্রেমলিনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, আলোচনা নিয়ে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব পায়নি রাশিয়া।
“অর্থনীতি বিবেচনায় নিলে রাশিয়া অবশ্যই সংঘাতের কূটনৈতিক সমাধানে আগ্রহী,” সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল ব্যয়ের কারণে অর্থনীতির ঝুঁকি যে ক্রমশ বাড়ছে সেদিকে ইঙ্গিত করে এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছেন রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি চেয়ারম্যান ওলেগ ভাইয়ুগিন।
যে ৫টি সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স অর্থনীতি নিয়ে ক্রেমলিনের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কথা জানাচ্ছে, তার মধ্যে ভাইয়ুগিন নেই। রাশিয়ার সংবেদনশীল পরিস্থিতি বিবেচনায় এ সূত্রগুলো তাদের নামপরিচয় গোপন রেখেই যুক্তরাজ্যভিত্তিক বার্তা সংস্থাটির সঙ্গে কথা বলেছে।
ইউক্রেইনের যে যে অঞ্চল মস্কো নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে সেগুলোকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে এবং কিইভ যদি মার্কিন নেতৃত্বাধীন নেটো সামরিক জোটে যোগ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছাড়ে তাহলে যুদ্ধবিরতি নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে বসতে পুতিন আগ্রহী বলে রয়টার্স আগেই জানিয়েছিল।
অর্থনীতি এবং ইউক্রেইন নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে পুতিনের এখনকার দৃষ্টিভঙ্গি কী, ক্রেমলিনের কাছ থেকে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে হোয়াইট হাউজের নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র ব্রায়ান হিউজ বলেছেন, বিস্তৃত অংশীদারদের সম্পৃক্ত করে এই ‘নির্মম যুদ্ধের অবসানে’ সচেষ্ট ট্রাম্প।
ট্রাম্প এর আগে ক্ষমতায় বসে একদিনের মধ্যেই তিন বছর ধরে চলা ইউক্রেইন যুদ্ধের অবসান ঘটাবেন বলে আওয়াজ দিয়েছিলেন, যদিও এখন তার প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ প্রসঙ্গে খানিকটা ধীরে চলো নীতিতেই এগুচ্ছেন।
ট্রাম্পের অভিষেকের কয়েকদিন আগে সদ্যবিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের আয়ের ওপর এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গিয়েছিলেন। এ পদক্ষেপের সুবিধা নিয়ে ট্রাম্প রাশিয়াকে চাপে রাখতে পারবেন বলে বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভানও স্বীকার করে গিয়েছিলেন।
পুতিন এর আগে বলেছিলেন, যতদিন দরকার ততদিনই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে রাশিয়া; নিজেদের জাতীয় স্বার্থে তারা কখনোই অন্য কোনো পরাশক্তির কাছে মাথা নোয়াবে না বলেও বারবারই বলে আসছেন তিনি।
রাশিয়ার ২ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি এই কিছুদিন আগ পর্যন্তও যুদ্ধের চাপ ভালোভাবে সামলাতে পেরেছে। এজন্য পুতিন শীর্ষ অর্থনৈতিক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের তুমুল প্রশংসাও করেছিলেন।
২০২২ সালে যুদ্ধ শুরুর বছর রাশিয়ার জিডিপি খানিকটা সংকুচিত হলেও পরের দুই বছর তা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
এ বছর রাশিয়ার জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পূর্বাভাসে বলা হলেও, দেশটির সরকার এই সংখ্যা ছাড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।
গত বছরের অক্টোবরে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেঞ্চমার্ক সুদের হার ২১ শতাংশ বাড়ালেও মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
“কিছু সমস্যা, যেমন মূল্যস্ফীতি অর্থনীতিতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এই উত্তাপ কমিয়ে আনতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ শুরু করেছে,” ডিসেম্বরে বার্ষিক সংবাদ সম্মেলনে পুতিন নিজেই এমনটা বলেছিলেন।
গত বছর রাশিয়া ইউক্রেইনের বিশাল অংশ নিজেদের করে নিতে সক্ষম হয়েছে, সব মিলিয়ে এখন তারা প্রতিবেশী দেশটির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ দখল করে নিয়েছে।
ক্রেমলিনের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত একটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ক্রাইমিয়াকে সংযুক্ত করা, ইউক্রেইনের সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করে দেওয়াসহ যুদ্ধে মস্কোর লক্ষ্যের প্রায় সবই অর্জিত হয়েছে বলে পুতিন মনে করছেন।
এদিকে যুদ্ধও রাশিয়ার অর্থনীতিকে চাপে ফেলছে, বিশেষ করে সুদের উচ্চ হার অ-সামরিক ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যয় বেড়ে জিডিপির ৬ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছেছে, সোভিয়েত পরবর্তী সময়ে যা সর্বোচ্চ। এর ফলে দেশটির বাজেটে ব্যয়ের প্রায় এক তৃতীয়াংশই এখন সামরিক খাতে যাচ্ছে, বাড়াচ্ছে মূল্যস্ফীতি।
যুদ্ধকালীন শ্রমিক ঘাটতিতে অনেক প্রতিষ্ঠানকেই বেতন বাড়াতে হয়েছে, আর্থিক ঘাটতি মেটাতে সরকারও কর রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
এসব কারণে রাশিয়ায় বেসরকারি বিনিয়োগ কমে আসায় ডিসেম্বরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে হওয়া এক বৈঠকে পুতিন হতাশাও ব্যক্ত করেছেন বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।
ইগর সেচিন, ওলেগ দেরিপাস্কার মতো রাশিয়ার প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা বেশ কয়েক মাস ধরে সুদের উচ্চ হার নিয়ে নিয়মিত সমালোচনাও করে যাচ্ছেন।