সেনা শাসনের মিয়ানমারে বিভেদ ঘুচিয়ে এক হচ্ছে জাতি গোষ্ঠীগুলো

মিয়ানমার সেনাবাহিনী যে অপপ্রচার চালাচ্ছিল, সেটা কাঁচা মনে হলেও কার্যকর ছিল বেশ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 May 2021, 06:26 PM
Updated : 1 May 2021, 06:26 PM

তারা দাবি করছিল, রোহিঙ্গারা বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু মিয়ানমারে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু ‘নিজেদের ঘরই আগুনে পুড়িয়ে দেয়নি’ বরং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যার ‘গল্পও বানিয়েছিল’।

আর নিজের দেশের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে সেনাবাহিনী গণহত্যায় নেমেছে- এই সত্য মেনে নেওয়াও মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু বামার জোতিগোষ্ঠীর অনেকের জন্য বিশ্বাস করা কঠিন ছিল।

প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক সান্দার মিও ছিলেন তেমনেই একজন, যিনি দেশের সেনাবাহিনীর কথায় আস্থা রাখতে চেয়েছিলেন।

সেই সেনাবাহিনী যখন এবছর ক্ষমতা দখল করল, এবং তাদের হাতে সাড়ে সাতশর বেশি বেসামরিক নাগরিকের প্রাণ গেল, সান্দার মিও বুঝলেন, রোহিঙ্গা এবং অন্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী কয়েক দশক ধরে নিপীড়নের যে অভিযোগ করে আসছে, তা মিথ্যা নয়। 

“অভ্যুত্থানের পর আমি দেখেছি, শহরের সাধারণ মানুষকে কীভাবে নির্যাতন করছে, হত্যা করছে সেনাবাহিনী আর পুলিশ। তখন থেকে আমি রোহিঙ্গা আর অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্যও কষ্ট পাচ্ছি, তারা বহু বছর ধরে আমাদের চেয়েও বেশি ভোগান্তির শিকার।”

১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দৃশ্যমান সবচেয়ে বড় কর্মসূচি সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠী বামারদের গণবিক্ষোভ বেসামরিক প্রশাসনের অসহযোগ ও শ্রমিক ধর্মঘট এমনকি একটি সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা হওয়ার সম্ভাবনার পথও তৈরি করে দেয়।

কিন্তু চুপিসারে অন্য এক পরিবর্তনও ঘটে চলেছে। নৃগোষ্ঠীগত বৈচিত্র্যময় একটি মিয়ানমারের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমেই বাড়ছে, যা আগের যে কোনো রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে ছিল অনুপস্থিত।

আর নতুন এই পরিবর্তনের স্রোতের গতিপথ অনুসরণের চেষ্টা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস। এক প্রতিবেদনে তার ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে পত্রিকাটি।

এতে বলা হয়, সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়ন বেড়ে চলার মধ্যে অনেকেই উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন, যে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী, যারা দশকের পর দশক নির্যাতনের শিকার, তাদের স্বীকৃতি দেওয়া ছাড়া একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব না।

মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী, যারা দেশের প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ সীমান্ত এলাকাগুলোজুড়ে ছড়িয়ে আছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম বিশ্বে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা গৃহযুদ্ধগুলোর অন্যতম।

কীভাবে ‘তাতমাদো’র (স্থানীয় ভাষায় মিয়ারমারের সামরিক বাহিনী) বিরুদ্ধে লড়তে হবে, সে বিষয়ে এসব সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে গভীর দূরদৃষ্টি। সশস্ত্র বাহিনী যখন জনগণের রক্ষকের পরিবর্তে দখলদার বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ, তখন মিয়ানমার কতটা স্থিতিশীল হতে পারে, তা সংখ্যাগুরু বামারদের চেয়ে তারা ভালো জানেন বলে দাবি করছেন।

মিয়ানমারে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াইয়ে থাকা একটি জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র বিদ্রোহী দল তা’অং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল আইক কিয়াও বলেন, “মিয়ানমারে কখনোই সত্যিকারের গণতন্ত্র ছিল না। কারণ এখানে সংখ্যালঘু আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর জন্য কোনো আশা ছিল না।

“গত ৭০ বছরে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলো যে অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছে তার সঙ্গে আপনি যদি এখনকার পরিস্থিতির তুলনা করেন, তাতে বলা যায় বামার জাতিগোষ্ঠী সে ধরনের কোনো কষ্টই সহ্য করেনি।”

২০১৭ সালে সেনা অভিযানের মুখে বাংলাদেশে পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা। ছবি: নিউ ইয়র্ক টাইমস

সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করার পর মিয়ানমার এখন ধীরে ধীরে একটি পূর্ণাঙ্গ গৃহযুদ্ধের দিতে এগোচ্ছে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার বিষয়ক একজন জ্যেষ্ঠ পরামর্শক রিচার্ড হর্সি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে এমাসেই বলেন, “মিয়ানমার একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রাপ্তে, এটি ভেঙে পড়তে পারে।”

আবার অন্যদিকে মিয়ানমারের চলমান সঙ্কট সেখানকার সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সংহত দেশ গড়ার পথও দেখাতে পারে বলেও মনে করেন হর্সি।

“এই সব হত্যা, সহিংসতার মধ্যে, সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার এই পরিবর্তিত চেহারাকে স্বীকৃতি এবং উৎসাহ দিতে হবে। একটি নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক কার্যক্রম গড়ে উঠছে, যা পুরনো বিভেদ ও সংস্কারগুলোকে ঝেড়ে ফেলছে এবং এমন একটি ভবিষ্যৎ মিয়ানমারের আশা দেখাচ্ছে, যা এর বৈচিত্র্যকে শান্তির সঙ্গে আলিঙ্গন করবে।”

এপ্রিলের শুরুতে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অবস্থান জানাতে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট নামে একটি ছায়া সরকার গঠন করা হয়। এতে প্রথমবার প্রকাশ্যে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে অনুমোদন করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় একটি সংবিধান প্রণীত হলে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সংখ্যাগুরু বামারদের শ্রেষ্ঠত্বের কবল থেকে মুক্তি পাবে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলো।

নবগঠিত এই ছায়া সরকারের মন্ত্রিসভায়ও বেশি সংখ্যক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাদের সংখ্যা অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির আগের সরকারের চেয়ে মন্ত্রিসভার চেয়ে বেশি।

মিয়ানমারের একমাত্র জনপ্রিয় জাতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে অবস্থান আছে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির, কিন্তু তাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসও বলছে যে তারাও সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে।

নভেম্বরে সর্বশেষ নির্বাচনে এনএলডি ভূমিধস জয়ে পুনর্নির্বাচিত হলেও বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ১০ লাখের বেশি মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।

তাতমাদোর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির সরকারের অধীনে গত পাঁচ বছরের শাসনামলে এনএলডির নেতারা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনকে সমর্থন জুগিয়ে গেছে।

সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অহিংস সংগ্রামের কারণে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী সু চি ২০১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে সামরিক বাহিনীর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু সামরিক বাহিনী তাকে কারাগারে পুরে দিয়ে ক্ষমতা দখলের পর এখন তার আত্মোপলব্ধি জাগার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

মিয়ানমারে সংখ্যালঘুদের অধিকারের স্বীকৃতির বিষয়ে সোচ্চার রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক রাজবন্দি খিন জ উইন বলেন, “অভ্যুত্থানপরবর্তী রক্তপাত জনগণের চেতনায় একটি বিরাট পরিবর্তন এনেছে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং অন্তর্ভুক্তির বিষয়গুলোতে।

“এনএলডি জনপ্রিয় হলেও দেশ এগিয়ে গেছে; এখন আর তা শুধু এনএলডিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় আটকে নেই।”

নতুন জাতীয় ঐক্যের সরকার এখন পর্যন্ত এনক্রিপটেড অ্যাপ থেকে একগুচ্ছ নীতি বিষয়ক বিবৃতি প্রচার করতে পেরেছে। এদের কোনো সেনাবাহিনী নেই, নেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

এই সরকারকে সফল হতে হলে ওইসব সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোর সমর্থন পেতে হবে, যারা দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতিত হয়ে আসছে।

নিজেদের বানানো অস্ত্র নিয়ে জান্তার বিরুদ্ধে লড়ইয়ে মিয়ানমারের বিক্ষোভকারীরা। ছবি: নিউ ইয়রআক টাইমস

মিয়ানমারের ইতিহাস যদিও বলছে, সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র দলগুলোর মধ্যে ঐক্য খুবই ক্ষণস্থায়ী, যাদের অনেকেই সামরিক বাহিনীকে মোকাবেলায় যে পরিমাণ গোলাবারুদের মজুত রাখে, তা আবার পরস্পরের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করে।

একাধিক সশস্ত্র সংগঠন রয়েছে বড় জাতিগোষ্ঠী কারেন ও শানের, যারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠীর একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করে থাকে। এসব সশস্ত্র সংগঠন আকর্ষণীয় খনি, বনাঞ্চল ও অবৈধ মাদক উৎপাদনের অবকাঠামো ধারণ করা মিয়ানমারের সীমান্তের অনেকখানি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে।

‘দ্য হিডেন হিস্টোরিস অব বার্মা’ বইয়ের লেখক ইতিহাসবিদ থান্ত মিন্ত-উ বলেন, বার্মায় উপনিবেশ স্থাপনকারী ব্রিটিশরা এই দেশকে ‘জাতিগত অস্থিতিশীলতার অঞ্চল’ হিসেবে প্রচার করেছিল।

“কিন্তু জাতিসত্তা ও বর্ণের স্পষ্ট বিভাজন করা সম্ভব- মিয়ানমার এমন কখনোই ছিল না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর ওপর বামারদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সমাপ্তি টানতে হয়ত আরও বিকেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সব ধরনের বৈষম্য দূর করার উদ্যোগও সমানভাবে নিতে হবে।”

এই প্রথম কারেন জাতিগোষ্ঠীর একটি সশস্ত্র দল কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন বামার জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে সামরিক বাহিনীর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কারেনদের জন্য সহায়তা পেয়েছে বলে ওই দলের মুখপাত্র পাদোহ স মান মান জানান।

তিনি বলেন, “আমরা এখন বামার জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, তাতমাদোর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে পারলে জয় আমাদের হবেই।”