চীনে উপসর্গবিহীন আক্রান্তদের নিয়ে নতুন ভয়

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চীন অভাবনীয় সাফল্যের নজির দেখালেও দেশটির উপসর্গবিহীন আক্রান্তরা নতুন করে কভিড-১৯ সংক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারেন বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2020, 11:42 AM
Updated : 25 March 2020, 11:42 AM

এশিয়ার শীর্ষ অর্থনীতির দেশটিতে উপসর্গবিহীন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য; নিজেদের অসুস্থতার কথা না জেনেই তারা ফের ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিতে পারে বলেও অনেকের উদ্বেগ রয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

ডিসেম্বরের শেষদিকে চীনের হুবেই প্রদেশ থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা এরই মধ্যে ১৯ হাজার পেরিয়ে গেছে; আক্রান্তের সংখ্যা পেরিয়েছে ৪ লাখ।

ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ইরান, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে নভেল করোনাভাইরাসের দাপট অব্যাহত থাকলেও চীন এখন কভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে; এরই মধ্যে তারা জনসাধারণের চলাচলের ওপর এতদিনের বিধিনিষেধ শিথিল করেছে। দুই মাস অবরুদ্ধ করে রাখার পর ভাইরাসের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হুবেইয়ের সীমানা বুধবার খুলে দেওয়া হয়েছে।

‘লকডাউন’ তুলে নেয়ার ফলে এতদিন ধরে ঘরবন্দি উপসর্গবিহীন আক্রান্তরা ফের মানু্ষের মধ্যে ভাইরাসটির সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয় কিনা তা নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাণঘাতীয় রোগ কভিড-১৯ এর নিয়ন্ত্রণে উপসর্গবিহীন আক্রান্তরাই সবচেয় বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হতে পারে। তাদেরকে শনাক্ত করতে না পারলে রোগটির সংক্রমণ বন্ধও কঠিন হয়ে যাবে।

চীনে এ ধরনের উপসর্গবিহীন আক্রান্তের সংখ্যা গোপন রাখা হয়েছে, তাদেরকে আক্রান্তের মোট সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অপ্রকাশিত কিছু নথির সূত্র ধরে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট দেশটিতে উপসর্গবিহীন আক্রান্তের সংখ্যা ৪০ হাজারেরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা দিয়েছে।

মঙ্গলবার পর্যন্ত চীন মোট ৮১ হাজার ২১৮ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্তের কথা জানিয়েছে; মত্যুর খবর দিয়েছে তিন হাজার ২৮১ জনের।

উপসর্গবিহীন এ আক্রান্তদের খোঁজ বের হচ্ছে মূলত শনাক্ত হওয়া ব্যক্তির ‘সংস্পর্শে আসা’ ব্যক্তিদের পরীক্ষার মাধ্যমে। পরীক্ষায় যাদের দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি মিলছে, উপসর্গ থাকুক না থাকুক, তাদের স্থান হচ্ছে কোয়ারেন্টিনে।

“শনাক্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের মাধ্যমে আমরা উপসর্গবিহীন আক্রান্তদের খোঁজ পাচ্ছি। এরা কি নতুন করে সংক্রমণ ছড়াতে পারে? না, পারবে না,” মঙ্গলবার এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন চীনের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের উ জুনইউ।

তবে উপসর্গবিহীন এ আক্রান্তদের মোট আক্রান্ত তালিকায় না রাখায় করোনাভাইরাস নিয়ে বেইজিংয়ের স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এ লুকোচুরি কভিড-১৯ কিভাবে ছড়ায় এবং রোগটি সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণে এসেছে কিনা তা নিয়ে বিভ্রান্তিকর চিত্র দেবে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

চীনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১৮ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত উহানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নতুন কারও সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে ২০ মার্চ তারা ঝাং নামের ৬২ বছর বয়সী এক ব্যক্তির দেহে ভাইরাস শনাক্তে পরীক্ষা করার কথা জানান, এবং উপসর্গ না থাকায় ওই রোগীকে সরকারি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলেও নিশ্চিত করেন।

হাসপাতাল সূত্রের বরাত দিয়ে কাইজিন ম্যাগাজিন জানিয়েছে, মঙ্গলবার উহানে এক চিকিৎসকের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে, উপসর্গবিহীন এক রোগীর মাধ্যমে তার দেহে ভাইরাসটি সংক্রমিত হয়েছিল।

চীন বলছে, উপসর্গবিহীন আক্রান্তদের দেহে কয়েকদিন পর উপসর্গ দেখা গেলেই কেবল তাদেরকে মোট আক্রান্তের তালিকায় সংযুক্ত করা হচ্ছে। তবে উপসর্গবিহীন কতজনকে এখনো পরীক্ষা করা হয়নি ও কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়নি, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

লকডাউন তুলে নিলে এই উপসর্গবিহীন আক্রান্তদের মাধ্যমে ফের সংক্রমণ ছড়াতে পারে বলে  অনেকেরই শঙ্কা।

“অসংখ্য দেশ এখন পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার মানুষকে পরীক্ষার আওতায় আনতে পারেনি বলেই ব্যাপারটা খুবই উদ্বেগজনক,” বলেছেন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অ্যাডাম কামরাত-স্কট।

উপসর্গবিহীন এই আক্রান্তদের মাধ্যমে সংক্রমণের মাত্রা ও হার কেমন তাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

“আমরা কেবল জানি, এমন উপায়ে সংক্রমণ হতে পারে, যদিও এটা বড় ধরনের সংক্রমণ ঘটাতে পারে বলে বিশ্বাস করছি না,” মার্চের শুরুতে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মারিয়া ভ্যান কেরখোভ।

নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, উপসর্গ নেই এমন বাহকরাও অন্যদের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। ইয়োকোহামা বন্দরের কাছে দীর্ঘদিন পৃথক করে রাখা প্রমোদতরী ডায়মন্ড প্রিন্সেসের যাত্রীদের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ১০৪ জনকে জাপানের সেল্ফ-ডিফেন্স ফোর্সেস সেন্ট্রল হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল; এদের মধ্যে ৩৩ জনের দেহে গড়ে ১০ দিন পরও কোনো উপসর্গ মেলেনি।

উপসর্গবিহীন এ আক্রান্তরা মোটামুটি সুস্থ থাকলেও কয়েকজন পরেরদিকে ভয়াবহ মাত্রার অসুস্থ হয়ে পড়েন।

২৩ মার্চ প্রকাশিত অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, চীনের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় শহর চংকিংয়ের মোট আক্রান্তের ১৮ শতাংশই উপসর্গবিহীন। আরেক গবেষণা বলছে, খুবই সামান্য উপসর্গ থাকাকালীনও সংক্রমণ ব্যক্তির দেহ থেকে অন্য দেহে ছড়াচ্ছে।

উপসর্গবিহীন রোগীর অস্তিত্ব বিদ্যমান মানেই হচ্ছে চীন থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশে ভাইরাসটির সংক্রমণ রুখতে দেশে দেশে বিমানবন্দর ও অন্যান্য শহরে যে ধরনের স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, আদতে তা কোনো কাজেই আসেনি, বলছে ইয়েলের স্কুল অব পাবলিক হেলথ।

“যখন আমরা সেরোলজিকাল (রক্তরস ও শরীরের অন্যান্য তরল) পরীক্ষা করে কারা কারা আক্রান্ত তা বের করতে পারবো, তখনই আসল ছবিটা পাওয়া যাবে,” বলেছেন কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব অনুজীববিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক ইয়ান হেন্ডারসন।