রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেইনের প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করতে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেশটিতে হস্তান্তর করা হয়ে আসছে।
Published : 20 Sep 2024, 12:50 AM
ভারতীয় অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের বিক্রি করা কামানের গোলা ইউরোপীয় ক্রেতাদের হাত হয়ে চলে যাচ্ছে ইউক্রেইনে। এ নিয়ে রাশিয়ার আপত্তি থাকার পরও এই গোলা রপ্তানির ব্যবসা বন্ধ করেনি ভারত।
১১জন ভারতীয় এবং ইউরোপীয় সরকারি ও প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা একথা জানিয়েছেন। তাছাড়া, কাস্টমসের তত্য বিশ্লেষণে বার্তা সংস্থা রয়টার্স একথা জানিয়েছে।
বিভিন্ন সূত্র ও কাস্টমসের তথ্যমতে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেইনের প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করতে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেশটিতে হস্তান্তর করা হয়ে আসছে।
তবে ভারতীয় অস্ত্র রপ্তানি বিধিমালায় ঘোষিত আইন অনুসারে, একমাত্র ঘোষিত ক্রেতাই রপ্তানি করা অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। অন্যথায়, এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে সেই ক্রেতা অস্ত্র কাউকে হস্তান্তর করে থাকলে পরবর্তীতে তার কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দিতে পারবে ভারত সরকার।
রাশিয়া অন্তত দু'বার বিষয়টি উত্থাপন করেছে, এর মধ্যে জুলাই মাসে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এবং তার ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠকের সময়ও এই বিষয়ে কথা বলেছেন তারা।
যদিও এ বিষয়ে রাশিয়া ও ভারতের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রাণালয় কোনও প্রশ্নের উত্তর দেয়নি।
ওদিকে, গত জানুয়ারিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারত ইউক্রেইনের কাছে কামানের গোলা পাঠায়নি বা বিক্রি করেনি।
ভারতের দুটি সরকারি ও দুটি প্রতিরক্ষা শিল্প সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, ইউক্রেইন যে পরিমাণ গোলাবারুদ ব্যবহার করে, তার খুব কম পরিমাণই ভারতের উৎপাদন করা।
একজন কর্মকর্তা অনুমান, যুদ্ধের পর থেকে কিইভ যে পরিমাণ অস্ত্র আমদানি করেছে ভারতের গোলা তার ১ শতাংশেরও কম হবে।
ইউরোপীয় ক্রেতারা এসব যুদ্ধাস্ত্র কিইভকে পুনরায় বিক্রি করছে, নাকি অনুদান হিসেবে দিচ্ছে তা নিশ্চিত করতে পারেনি বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
ইউক্রেইনে ভারতীয় যুদ্ধাস্ত্র পাঠানো ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে রয়েছে ইতালি এবং চেক প্রজাতন্ত্র। এই দুই দেশ কিইভকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে থেকে কামানের গোলা সরবরাহের উদ্যোগের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
একজন স্প্যানিশ এবং একজন ঊর্ধ্বতন ভারতীয় কর্মকর্তার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা যন্ত্র ইন্ডিয়ার সাবেক শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তার মতে, এদের যুদ্ধাস্ত্র ইউক্রেইন ব্যবহার করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় ওই কর্মকর্তা বলেন, ভারত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তবে ইউরোপে এই অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ বন্ধের কোনও পদক্ষেপ নেয়নি ভারত।
এদিকে ইউক্রেইনীয়, ইতালিয়ান, স্পেন এবং চেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় মন্তব্যের অনুরোধে কোনও সাড়া দেয়নি।
সম্প্রতি চীনকে মোকাবেলায় ইউক্রেইনের প্রধান নিরাপত্তা সমর্থনকারী যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করেছে ভারত। এই দুই দেশই চীন কে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে।
ভারতের অস্ত্র আমদানির বড় একটি অংশের যোগান দেয় রাশিয়া। তাই কয়েক দশক ধরে রাশিয়ার সঙ্গেও ভারতের উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মস্কোর বিরুদ্ধে পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞায়ও যোগ দিতে অস্বীকার করেছেন।
পোকরোভস্কের পূর্বাঞ্চলীয় লজিস্টিক হাবের দিকে রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে লড়াই করা ইউক্রেইনে কামানের গোলার মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে।
হোয়াইট হাউজ এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারত সরকারের কাছে দিল্লির অস্ত্র রপ্তানির বিষয়ে জানতে চেয়েছে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ভারত মাত্র ৩০০ কোটি ডলারের অস্ত্র রপ্তানি করেছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ৩০ আগস্ট একটি সম্মেলনে বলেছিলেন, গত অর্থবছরে প্রতিরক্ষা রফতানি ২দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। দিল্লি ২০২৯ সালের মধ্যে এটি প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করছেন তারা।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ আরজান তারাপুর বলেন, ইউক্রেইনে অস্ত্র হস্তান্তরের পেছনে দিল্লির অস্ত্র রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ একটি বড় কারণ।
ইউক্রেইনে ভারতে তৈরি গোলা পাঠানো কোম্পানিগুলোর মধ্যে অ-তালিকাভুক্ত ইতালির প্রতিরক্ষা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেকানিকা পার এল'ইলেট্রোনিকা ই সার্ভোমেকানিজমি (এমইএস) অন্যতম।
এমইএস হ'ল যন্ত্র ইন্ডিয়ার বৃহত্তম বিদেশি ক্লায়েন্ট। এর নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, রোমভিত্তিক এ কোম্পানিটি ভারত থেকে গোলার শেল কিনে তাতে বিস্ফোরক ভরে।
যন্ত্র ইন্ডিয়া তার ২০২২-২৩ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, তারা এল১৫এ১ শেলের জন্য একটি উৎপাদন লাইন স্থাপন করতে নামহীন এক ইতালিয়ান ক্লায়েন্টের সঙ্গে একটি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে।
কাস্টমসের তথ্যানুযায়ী, যন্ত্র ইন্ডিয়া ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের মধ্যে এমইএস- কে ৩৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের খালি ১৫৫ মিমি এল১৫এ১ শেল রপ্তানি করেছে।
শুল্ক বিভাগের রেকর্ডে আরও দেখা যায়, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক অস্ত্র কোম্পানি ডিন্স হিল ইতালি থেকে ইউক্রেইনে ৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারের গোলাবারুদ রফতানি করেছে।
ভারতের অস্ত্র আমদানির ৬০ শতাংশের যোগান দেয় রাশিয়া। তাই ভারতের কাছে বরাবরই রাশিয়া মূল্যবান। গত জুলাই মাসে তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী তার প্রথম দ্বিপক্ষীয় আন্তর্জাতিক সফরের জন্য মস্কোকে বেছে নেন।
একজন ভারতীয় কর্মকর্তা জানান, গত জুলাই মাসে কাজাখস্তানে এস. জয়শঙ্কর ও লাভরভের মধ্যে বৈঠক হয়। সেখানে ভারতীয় অস্ত্র যে ইউক্রেইনীয়রা ব্যবহার করছেন সেবিষয়টি জানান লাভরভ।
তিনি বলেন, এসব অস্ত্রের কিছু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ভারতীয় কোম্পানি তৈরি করছে। তবে এর জবাবে জয়শঙ্কর কী বলেছেন, তা জানাননি ওই কর্মকর্তা।
কিংস কলেজ লন্ডনের দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ওয়াল্টার লাডউইগ বলেছেন, তুলনামূলকভাবে অল্প পরিমাণ গোলা অন্য দেশে গেলে দিল্লির জন্য ভূ-রাজনৈতিকভাবে তা উপযোগী।
তিনি বলেন, এর ফলে পশ্চিমাদের ভারত বলতে পারবে যে, রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধে তারা মস্কোর পক্ষে নয়। আর ভারতের সিদ্ধান্তের ওপর মস্কো তেমন কোনও প্রভাবই রাখে না।