ফিলিস্তিনি এই যুবক ছিলেন ‘একবছরের শিশুর’ মতোই অবোধ। কুকুরের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর তাকে আলাদা কক্ষে ফেলে রাখা হয়। একসপ্তাহ পর মেলে তার পচা-গলা লাশ।
Published : 17 Jul 2024, 08:44 PM
গাজা সিটির সুজাইয়ায় ইসরায়েলি সেনাদের হিংস্র কুকুরের আক্রমণে প্রতিবন্ধী এক ফিলিস্তিনি যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এই যুবক খাওয়া, পরা থেকে শুরু করে কোনও কিছুই নিজে নিজে করতে পারত না। সবকিছুই করিয়ে দিতে হত। বয়স ২৪ হলেও সে ছিল এক বছরের শিশুর মতো।
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘মিডল ইস্ট আই’ জানায়, এই যুবকের নাম মুহাম্মদ। সে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকত। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিল সে। আরামদায়ক একটি চেয়ারে বসেই দিন কাটত তার।
এই অবোধ যুবকটির সঙ্গে ইসরায়েলি সেনারা যে অমানবিক আচরণ করেছে, তার আদ্যপান্ত ‘মিডল ইস্ট আই’-কে বর্ণনা করেছেন মুহাম্মদের মা নাবিলা আহমেদ বাহার।
তিনি বলেন, গত ২৭ জুনে ইসরায়েলের হামলার মুখে সুজাইয়ায় নিজের বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন তারা। হামাস যোদ্ধাদের খুঁজতে খুঁজতে ইসরায়েলর প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ এর সেনারা হামলা চালাতে চালাতে অগ্রসর হচ্ছিল।
বাড়ির আশেপাশের রাস্তায় তুমুল গোলাগুলি চলছিল। তারা বাড়ির বিভিন্ন কোণে লুকোচ্ছিলেন। এরই মধ্যে ইসরায়েলি সেনারা এক সময় বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। প্রথমেই তারা বাড়িতে ঢোকায় তাদের কয়েকটি কুকুরকে। কুকুরগুলো মুহম্মদের ওপর ঝঁপিয়ে পড়ে তাকে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে।
প্রতিবন্ধী হওয়ার পরও মুহাম্মদকে ছেড়ে দেওয়া হয়নি। বরং ইসরায়েলি সেনারা মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে সবাইকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে মুহাম্মদকে আলাদা একটি কক্ষে আটকে রাখে।
সে সময় ছেলেকে দেখতে পাননি তার মা, কেবল তার চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলেন। চিৎকার শুনেই তিনি আঁচ করতে পারছিলেন ছেলের ভাগ্যে কি ঘটতে চলেছে।
এরপর অপেক্ষায় থেকে পার হয়ে যায় যন্ত্রণাদায়ক ৭ টি দিন। ইসরায়েলি সেনারা সুজাইয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পরই পরিবারের সদস্যরা দ্রুত বাড়িতে ফিরে যায়। আর সেখানে গিয়ে তারা দেখতে পায় পড়ে আছে মুহাম্মদের পচা-গলা মৃতদেহ। পোকায় খাচ্ছিল তার মুখমন্ডল।
মুহাম্মদের ৭১ বছর বয়সী মা নাবিলা বলেন, “তার চিৎকার আর কুকুর থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টার যে চিত্র দেখেছি তা ভুলতে পারছি না। তার সঙ্গে তারা (ইসরায়েলি সেনা) কি করেছে; কীভাবে তাকে এভাবে মরতে দিয়েছে আমি ভাবতেও পারি না।”
নাবিলা জানান, ইসরায়েলের সেনারা দুই সপ্তাহ ধরে সুজাইয়ার জনাকীর্ণ এলাকায় বোমা হামলা চালিয়েছিল। সে সময় বহু পরিবারই বাড়ির ভেতরে আটকে পড়ে। ইসরায়েলের সেনারা বাড়িতে ঢোকার আগে তারাও এক সপ্তাহ ধরে বন্দি হয়ে ছিলেন।
ইসরায়েলের হামলার সময় তারা বাড়িতে ১৬ জন ছিলেন। যার মধ্যে তার দুই ছেলে, তাদের স্ত্রী ও সন্তানেরা ছিল। ইসরায়েলিদের ছোড়া বোমা থেকে বাঁচতে শিশুরা বাথরুমে বাথটাবে লুকিয়েছিল। কিন্তু মুহাম্মদের ওজন বেশি থাকায় এবং সে নড়াচড়া করতে না চওয়ার কারণে ঘরের ভেতরই ছিল। ফলে কুকুর বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই তাকে কামড়ে ধরে।
নাবিলা জানান, ইসরায়েলের হামলা থেকে বাঁচতে তারা এর আগে ৫ বার নিরাপদ জায়গার সন্ধানে চলে গিয়েছিলেন। মুহাম্মদ বুঝত না কেন, কোথায় যাওয়া হচ্ছে। স্থূল হওয়ার কারণে সে জলদিই ক্লান্ত হয়ে পড়ত, আর কয়েক পা চলতে না চলতেই বসে পড়ত।
এবার তাদের যাওয়ার মতো আর কোনও নিরাপদ জায়গাই ছিল না। ফলে তারা বাড়িতেই ছিলেন, বলেন নাবিলা।
কুকুর যখন মুহাম্মদকে হামলা করে তখন নাবিলা ইসরায়েলি সেনাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন যে, তার ছেলে প্রতিবন্ধী। এক সময় কুকুরটিকে ছাড়ায় তারা। কিন্তু মুহাম্মদকে নিয়ে যাওয়া হয় আলাদা রুমে। তার মা তাকে ছেড়ে দিতে বললেও দেওয়া হয়নি।
এর বদলে ইসরায়েলি সেনারা জানায়, মুহাম্মদের চিকিৎসা করবে তারা। মুহাম্মদ ভেতর থেকে চিৎকার করছিল, পানি চাইছিল। মাঝে মধ্যেই তার চিৎকার শোনা যাচ্ছিল।
সেনারা তখন দরজা খুলে তাকে দেখে চুপ করার জন্য বলে আবার দরজা বন্ধ করে দিচ্ছিল। পরে এক চিকিৎসক মুহাম্মদের কক্ষে প্রবেশ করেন। কিন্তু এরপর হঠাৎ করেই মুহাম্মদের আর কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।
তার মা বলেন, এক সেনাকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, মুহাম্মদ কোথায়? জবাবে সে বলে “মুহাম্মদ আর নেই।” এরপর বাড়ির সবাইকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করে ইসরায়েলি সেনারা। থেকে যায় শুধু মুহাম্মদ।