ফ্রান্সকে ঐতিহ্যগতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদর্শিক ও রাজনৈতিক অশ্বশক্তির চালিকাশক্তি হিসেবেই দেখা হয়।
Published : 05 Dec 2024, 10:06 PM
ফ্রান্সের পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রী মিশেল বার্নিয়ের সরকারের পতন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ পাওয়ার মাত্র তিন মাসের মাথায় সরে যেতে হচ্ছে বার্নিয়েকে।
গত সোমবার সামাজিক নিরাপত্তা বাজেট বিশেষ ক্ষমতা খাটিয়ে ভোটাভুটি ছাড়াই পার্লামেন্টে পাস করিয়ে অনাস্থা ভোটের মুখে পড়ার ঝুঁকি নিয়েছিলেন তিনি।
ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা এখন কেবল দেশের নাগরিকদের জন্যই গভীর উদ্বেগের নয় বরং ইউরোপের জন্যও একইরকম উদ্বেগের।
এখন বিশ্বজুড়ে অস্থিতিশীলতার সময়। আর ফ্রান্সকে জার্মানির পাশাপাশি ঐতিহ্যগতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) আদর্শিক ও রাজনৈতিক অশ্বশক্তির ‘মোটর’ (চালিকাশক্তি) হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এই চালিকাশক্তি বিশৃঙ্খলায় পর্যবসিত হচ্ছে।
ফ্রান্সই কেবল অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক বিরোধে বিভক্ত ও লক্ষ্যচ্যুত নয়। জার্মানিতেও জোট সরকারের পতন হওয়ার জেরে আগামী ফেব্রুয়ারিতে আগাম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
দুই দেশে এই অস্থিরতা জোট হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) প্রভাবিত করছে। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রসারণবাদী ও আগ্রাসী ক্রেমলিনের সামনে নিজেদের শক্তি এবং ঐক্য বজায় রাখার সংকল্প ইউরোপ দেখাতে পারবে কিনা প্রশ্ন সেটি।
তাছাড়া, অবিচলভাবে ইউক্রেইনের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি ইউরোপ আগামী দিনগুলোতে রক্ষা করতে পারবে কি না সেটিও প্রশ্নও। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যদি কিইভকে মার্কিন সামরিক সহায়তা দেওয়া কমিয়ে দেন বা বন্ধ করে দেন- সেক্ষেত্রে ইউরোপ কী করবে সে বিষয়টি অনিশ্চিত।
যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি ফ্রান্সই এখন ইউরোপের একমাত্র বড় সামরিক শক্তি। হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের ফেরা নিয়েও ইইউ ও ইউরোপ উদ্বেগে আছে। কারণ, ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি এবং অপর্যাপ্ত ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ব্যয় নিয়ে ট্রাম্পের ক্ষোভ কীভাবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় ফেটে পড়ে সেটি দেখার বিষয়।
ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এ সময়ে ইইউ-য়ে নেতৃত্বের সংকট আছে। রাডারবিহীনভাবে চলার মতোই অনুভব করতে শুরু করেছে ইইউ। ইউরোপের দেশে দেশে আরও বেশি স্বৈরশাসকের উত্থান ঘটছে। হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া ও রোমানিয়ায় রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল নেতাদের উত্থান ঘটছে। আর সেখানে দেশের অভ্যন্তরীন অস্থিরতায় দুর্বল হয়ে লক্ষ্যচ্যুত হচ্ছে ফ্রান্স ও জার্মানি।
ফ্রান্সে বাস্তবিক অর্থেই রাজনৈতিক অস্থিরতা শেষ হওয়ার লক্ষণ নেই। প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁ নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করলেও পার্লামেন্ট তিনটি রাজনৈতিক ব্লকে বিভক্ত হয়ে থাকবে। সংস্কার ও নতুন বাজেট প্রশ্নে ব্লকগুলো একে অপরকে জিম্মিও করতে পারবে।
ফ্রান্সে যা ঘটছে বহির্বিশ্বে তা প্রভাব ফেলার আরেক কারণও আছে। আর তা হচ্ছে ফ্রান্স ইউরোজোনের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। তাদের বাজেট ঘাটতি বেড়ে তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানদণ্ডকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। একইভাবে ফরাসি সরকারের ঋণ ইউরোপের চোখ কপালে তুলে দিচ্ছে।
ফ্রান্সের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে করদাতারা জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইউরোজোনের বাদবাকীরাও অস্বস্তিতে আছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ইউরোর মান কমতে পারে বলে তারা শঙ্কিত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশ জার্মানিও সমস্যায় আছে।
সমালোচনা-তোপে মাক্রোঁ:
সব কিছুতেই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাঁক্রো নিজেকে ধীরস্থির হিসাবে উপস্থাপনের চেষ্টা নিয়েছেন।
অনাস্থা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী বার্নিয়ে যখন টিভিতে দেশের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে সতর্কবার্তা দিচ্ছিলেন এবং দেশকে দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে রাখাসহ তাকে ও তার ব্যয়সাশ্রয়ী বাজেটে সমর্থন দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছিলেন তখন মাক্রোঁর সুর ছিল ভিন্ন।
দেশবাসীকে তিনি বলেছিলেন, “এসব বলে আমাদের জনগণকে ভয় পাইয়ে দেওয়া উচিত নয়। আমাদের মজবুত অর্থনীতি আছে। ফ্রান্স একটি ধনী, সমৃদ্ধ রাষ্ট্র। এ দেশে অনেক সংস্কার করা হয়েছে এবং তাতে অটল আছে। দেশে স্থিতিশীল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সংবিধান আছে।
অনাস্থা ভোটের আগে দিয়ে সৌদি আরব থেকে তিনদিনের সফর শেষে প্যারিস ফেরার সময় এসব কথা বলেন মাক্রোঁ। কিন্তু মাক্রোঁ যা-ই বলুন, তিনিও খোদ সমালোচনা এবং তোপের মুখে রয়েছেন।
ফ্রান্সের পার্লামেন্টের বর্তমান অচলাবস্থা চলতি গ্রীষ্মে মাক্রোঁর ডাকা আগাম পার্লামেন্ট নির্বাচনেরই ফল। এই নির্বাচনে তার দল খারাপ ফল করেছে।
ফ্রান্সের আইন অনুযায়ী, অন্তত এক বছরের জন্য কোনও নতুন পার্লামেন্ট নির্বাচন আয়োজন করা যাবে না। তার মানে, ২০২৫ সালের গ্রীষ্ম বা শরতের আগে কোনও নতুন ব্যয়সাশ্রয়ী বাজেট প্রণয়নের সম্ভাবনা নেই।
এমনকি এর মধ্যে কোনও নতুন নির্বাচনে একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক ফল বেরিয়ে এলেও না। জনমত জরিপেও অবশ্য এমন স্পষ্ট কোনও ফল বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত মেলেনি।
এ পরিস্থিতিতে মাক্রোঁর অনেক রাজনৈতিক বিরোধীই তার পদত্যাগের দাবিতে আরও বেশি সোচ্চার হচ্ছে। তারা বলছে, মাক্রোঁর পদত্যাগ দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান ঘটাবে।
মাক্রোঁর মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। আগাম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে তিনি বরং জোর দিয়ে বলেছেন, জনগণ তাদের স্বার্থ রক্ষায় সেবা পেতেই তাকে ভোট দিয়ে জয়ী করেছে।
তবে রাজনীতি থেকে মাক্রোঁর বিদায় ত্বরান্বিত করার মতো একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন কট্টর-ডান জাতীয়তাবাদী ন্যাশনাল র্যালি পার্টির নেতা ম্যারিন ল্য পেন।
কিন্তু ইইউ তহবিল আত্মস্যাতের অভিযোগে ল্য পেনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। যদিও এমন কিছু করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। দোষী সাব্যস্ত হলে ল্য পেন ৫ বছরের জন্য রাজনীতিতে নিষিদ্ধ হতে পারেন। ফলে ২০২৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি দাঁড়াতে পারবেন না। তার মামলার রায় ঘোষণার কথা রয়েছে আগামী বছর মার্চের শেষে।
আর মাক্রোঁ যদি এখন পদত্যাগের দাবি মেনে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান, তাহলে ৩০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ডাকতে হবে। এতে ন্যাশনাল র্যালির নেতা লা পেনের অংশ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে এবং নির্বাচনে তিনি জিততেও পারেন।
এককথায় বলতে গেলে- রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে ফ্রান্সের ভেতরে-বাইরে সামনে কী ঘটতে চলেছে তা দেখার অনেক কিছুই আছে।