সিরিয়ায় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৯০০ সেনা রয়েছে। সিরিয়া পূর্বাঞ্চলে ফোরাত নদী এবং ইরাক ও জর্দানের সীমান্তবর্তী ‘ডিকনফ্লিকশন’ অঞ্চলে তারা মোতায়েন রয়েছে।
Published : 14 Dec 2024, 01:22 AM
ফ্রান্সের প্যারিসে গত রোববার নটর ডেম ক্যাথেড্রাল পুনরায় খুলে দেওয়ার অনুষ্ঠানে ডনাল্ড ট্রাম্প যখন বিশ্বনেতাদের পাশে বসেছিলেন, তখন সিরিয়ায় সশস্ত্র ইসলামি যোদ্ধারা আসাদের পতন ঘটাত জিপে করে দামেস্কের পথে এগোচ্ছিলেন।
ভিন্ন দুটি দৃশ্যপটের একটিতে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বসে ছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডির মাঝখানে, যদিও তার একটা চোখ কিন্তু পড়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের অপ্রত্যাশিত বাঁক-বদলের দিকে।
একই দিন নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাইট ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ একটি পোস্ট দেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি লেখেন, “সিরিয়ায় ব্যাপক গোলমাল চলছে; কিন্তু তারা আমাদের বন্ধু নয়।
“সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু করার নেই। এটা আমাদের লড়াই নয়। লড়াই চলুক; এতে জড়ানোর দরকার নেই।”
পরের দিন আরেকটি পোস্ট দেন ট্রাম্প। এসব পোস্ট ছিল তার নির্বাচনি ম্যান্ডেটের একটা বহিঃপ্রকাশ, যেখানে পররাষ্ট্রনীতিতে হস্তক্ষেপ না করার কথা বলা হয়েছে।
ট্রাম্পের এ অবস্থানের মধ্য দিয়ে আরেকটি বড় ধরনের প্রশ্নের উদয় হয়েছে। সেটা হল, ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে? যে যুদ্ধ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিকে প্রভাবিত করেছে এবং বাশার আল-আসাদের পতন ঘটিয়েছে, সেখানে ট্রাম্পের ‘কিছু করার নেই’ বলার সুযোগ আদৌ রয়েছে কি না?
ট্রাম্প কি মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেবেন?
ট্রাম্পের নীতি কি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চেয়ে অনেক আলাদা হবে? সেটা যদি হয়ও, ট্রাম্প ক্ষমতা নেওয়ার পাঁচ সপ্তাহ আগে হোয়াইট হাউসের পক্ষে কী করার আছে?
সিরিয়ায় আসাদের পতন এবং হায়াত তাহির আল-শামের (এইচটিএস) ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে বর্তমান মার্কিন প্রশাসন সম্পৃক্ত রয়েছে; যদিও যুক্তরাষ্ট্রের চোখে এইচটিএস একটি সন্ত্রাসী সংগঠন।
বিবিসির প্রতিবেদক টম বেইটম্যান যখন সংবাদটি লিখছেন, তখন তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের সঙ্গে একই বিমানে বসা। জর্ডান ও তুরস্কে ব্লিনকেনের এ যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল মূলত সিরিয়ার নতুন সরকারের রূপরেখার বিষয়ে মার্কিন শর্তের পক্ষে আরব ও মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন আদায় করা।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, নতুন সরকার হতে হবে স্বচ্ছ ও সমন্বিত; সন্ত্রাসের ঘাঁটি হওয়া যাবে না, সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোকে হুমকি দেওয়া যাবে না এবং সব ধরনের রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্রের মজুদ ধ্বংস করতে হবে।
ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া (এখনও চূড়ান্ত নয়) মাইক ওয়ালজের একটি পররাষ্ট্র নীতি সামনে এসেছে।
চলতি সপ্তাহে ফক্স নিউজে তিনি বলেন, “ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে আর কোনো যুদ্ধে না জড়ানোর পরিষ্কার একটা ম্যান্ডেট নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।”
তিনি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্বার্থগত বিষয়ে’ একটি তালিকাও দিয়েছেন, যেখানে তিনি বলেছেন, ইসলামিক স্টেট (আইএস), ইসরায়েল ও ‘আমাদের আরব মিত্ররা’ সবচেয়ে প্রাধান্য পাবে।
মাইক ওয়ালজের এসব মন্তব্যকে সিরিয়া বিষয়ে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির সারাংশ এবং বৃহত্তর পররাষ্ট্রনীতির ‘আভাস’ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
ট্রাম্পের লক্ষ্য হল, আইএসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সিরিয়ায় এমন একটা সরকার প্রতিষ্ঠা করা, যারা ওয়াশিংটনের সবচেয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ মিত্র ইসরায়েলের জন্য কোনো হুমকি তৈরি করবে না।
আরেকটি ‘বড় পুরস্কারের’ প্রতিও নজর থাকবে ট্রাম্পের। সেটা হলো, ইসরায়েল ও সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পন্ন করা। ট্রাম্পের বিশ্বাস, এ ধরনের চুক্তি হলে তা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরানকে আরও দুর্বল করে দেবে।
ট্রাম্প মনে করেন, এর বাইরে যা যা আছে, তার সবাই সিরিয়ার ‘গোলমাল’; তার কিছু করার নেই।
ট্রাম্পের এই মনোভাব অবশ্য তার প্রথম মেয়াদের কথা মনে করিয়ে দেয়। ওই সময় তিনি সিরিয়াকে মূল্যায়ন করেছিলেন ‘ধ্বংসযজ্ঞ ও মৃত্যু’ হিসেবে।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনে সিরিয়ায় মার্কিন দূত হিসেবে দায়িত্ব (২০১১-২০১৪) পালন করেন রবার্ট ফোর্ড, যিনি সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অধিকতর হস্তক্ষেপের পক্ষে ছিলেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে সিরিয়ার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না।
“কিন্তু তার প্রশাসনে এমন অনেক ব্যক্তিই আছেন, যারা সন্ত্রাস মোকাবেলার বিষয়ে আরও বেশি উদ্বিগ্ন।”
সিরিয়ায় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৯০০ সেনা রয়েছে। সিরিয়া পূর্বাঞ্চলে ফোরাত নদী এবং ইরাক ও জর্দানের সীমান্তবর্তী ‘ডিকনফ্লিকশন’ অঞ্চলে তারা মোতায়েন রয়েছে।
এসব সেনার মূল দায়িত্ব হলো আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটি ফোর্সেসকে (এসডিএফ) প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেওয়া। এসডিএফ মূলত কুর্দি ও আরব মিত্রদের একটি গ্রুপ, যারা এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করে।
এছাড়া ওই অঞ্চলের মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি ইরানে সম্ভাব্য অস্ত্রের একটি রুট বন্ধ রাখতে ভূমিকা রাখছে। ইরানের মিত্র হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র সরবরাহ করতে সিরিয়া ওই রুট ব্যবহার করে।
অন্যান্য বিশ্লেষকের মতো ফোর্ডও বিশ্বাস করেন, ট্রাম্পের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ নীতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভালো চলতে পারে। কিন্তু মাঠের বাস্তবতা এবং তাদের টিমের সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ট্রাম্পের মতাদর্শ সংশোধন-পরিমার্জন আসতে পারে।