তাইওয়ান ঘিরে চীনের সামরিক মহড়ার আসল তাৎপর্য কী?

বিবিসির বিশ্লেষণ বলছে, পেলোসির তাইপে সফর তাইওয়ানের ওপর চাপ বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে চীনের সামনে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 August 2022, 06:38 PM
Updated : 9 August 2022, 06:38 PM

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের জেরে দ্বীপটি ঘিরে চীন যে নজিরবিহীন সামরিক মহড়া চালিয়েছে- তা কী শুধু তাদের ‘কঠোর সামরিক প্রতিক্রিয়া’ ছিল? নাকি উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তাইওয়ানের ওপর আরও সুদৃঢ় প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পেয়ে গেল চীন?

তাইওয়ান ঘিরে চীনের প্রতিক্রিয়ার তাৎপর্য আদতে কী? তা বিশ্লেষণ করেছেন বিবিসি’র দুই সংবাদদাতা:

নতুন স্বাভাবিক অবস্থা:

ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের কারণে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চপদস্থ কট্টরপন্থিরা সম্ভবত খুশিই হয়েছেন।

বিবিসি মনে করে, পেলোসি আদতে তাদের সামনে তাইওয়ানের উপর চাপ বাড়ানোর একটি জানালা খুলে দিয়ে গেছেন এবং তারা সেটা ব্যবহার করছে।

তাইওয়ান ঘিরে চীন যে সামরিক মহড়া চালিয়েছে সেখানে ‘লাইভ-ফায়ার’ ড্রিল করা হয়েছে। মহড়ায় তাইওয়ানের ওপর দিয়ে বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে চীন।

এর মাধ্যমে তাইওয়ান ঘিরে চীনের একের পর এক সামরিক ব্যবস্থা নেওয়ার ‘গ্রহণযোগ্যতা’ তৈরির পট প্রস্তত হয়েছে।

বিবিসির এক প্রতিনিধি বলেন, তাইওয়ানের ওপর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়াসহ চীন মহড়ায় যে ‘লাইভ-ফায়ার’ ড্রিল করেছে, সেটি এখন ‘গ্রহণযোগ্যতা’ পেয়ে গেছে। বিষয়টি এমন নয় যে, আন্তর্জাতিক মহল তাদেরকে সেটি করার অনুমতি দিয়েছে, বরং চীন এটা এরই মধ্যে করে দেখিয়েছে এবং এজন্য তাদেরকে কোনও জবাবদিহিতার মুখে পড়তে হয়নি।

এবারের মহড়ায় চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) তাইওয়ান প্রণালী ঘিরে অনেক কাছে এবং অনেক বেশি সংখ্যায় যুদ্ধবিমান উড়িয়েছে। এটা এখন ‘নতুন সীমা’ বলে বিবেচিত হচ্ছে।

তার উপর একদিন প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে হলেও তাইওয়ানকে চীনের মূলভূখণ্ডের অন্তর্ভূক্ত করার যে নীতি চীন সরকারের রয়েছে, সেটি এখন অনেক বেশি বাস্তব বলে বিশ্বাস করা মানুষের সংখ্যা চীনে বাড়বে। যারা এই নীতিতে বিশ্বাস করেন তারা এটিকে তাদের জয় হিসাবে দেখছেন।

অন্য কোনও শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাইওয়ানকে পুনরায় চীনের অংশ করার আর কোনও কৌশল নিয়ে আপাতত আলোচনা তাই বন্ধ হয়ে গেছে।

শুধু তাইওয়ান নয়, এবারের মহড়ার মাধ্যমে চীন দক্ষিণ চীন সাগরের দখল নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোকেও তাদের সামরিক শক্তির দেখাতে পেরেছে। তারা দেখিয়ে দিয়েছে, পিপলস লিবারেশন আর্মি সামরিক শক্তিতে কতটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।

এত বৃহৎ মহড়ার পরিকল্পনা কী তাৎক্ষণিক?

চীন তাইওয়ান ঘিরে যত বড় সামরিক মহড়া চালিয়েছে সেটার জন্য ন্যুনতম পরিকল্পনা প্রয়োজন। তাই হঠাৎ করে পেলোসির তাইওয়ান সফরে যাওয়ার খবর ফাঁস হল, আর চীনের জেনারেলা সঙ্গে সঙ্গে এত বৃহৎ মহড়ার পরিকল্পনা করে ফেললেন এমনটা কল্পনা করাও কঠিন।

বরং এটি বিশ্বাস করা সহজ যে, চীন প্রস্তুত হয়েই ছিল। তাদের মহড়ার পরিকল্পনা করাই ছিল। শুধু যখন পেলোসির তাইওয়ান সফরের খবর প্রকাশ পেল, তখন তারা ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ পেয়ে তা কার্যকর করে ফেলল।

বিবিসি জানায়, গত সপ্তাহে বেইজিংয়ে একজন কট্টর জাতীয়তাবাদী রাস্তায় সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় হাসতে হাসতে বলেই ফেললেন, ‘‘ধন্যবাদ কমরেড পেলোসি!’’

তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। যদি চীন সরকার যুদ্ধ নিয়ে নিজেদের বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথাবার্তার ফাঁদে নিজেরাই ধরা পড়ে এবং একথা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে- কঠিন, রক্তাক্ত ও সর্বনাশা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নয়, বরং তারা সহজেই তাইওয়ানকে দখল নিতে পারবে।

যদিও কোনও কোনও বিশ্লেষকের ধারণা, চীনের এই যুদ্ধ মহড়া আসলে তাইওয়ান সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীকে চীনের হামলা মোকাবেলায় প্রতিরক্ষা কৌশল তৈরিতে সহায়তা করবে।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সরকার তো এই সামরিক মহড়ার মধ্যেই থেমে থাকছে না। গত শুক্রবার চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনেক ধরনের সহযোগিতা বন্ধ করে দিচ্ছে।

মাদক চোরাকারবারের মতো আন্ত-সীমান্ত অপরাধ, সমুদ্র পথের নিরাপত্তা থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের চীন-মার্কিন সামরিক সংলাপ- সবকিছুই স্থগিত করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমে এরকম খবরও বেরিয়েছে, দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এবং সশস্ত্র বাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জেনারেল মার্ক মাইলির ফোন ধরেনি চীনারা।

আরও গুরুতর ব্যাপার হচ্ছে, চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সহযোগিতাও বন্ধ করে দিয়েছে। এর মানে হচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে দূষণকারী দুটি দেশ এখন আর জলবায়ু বিষয়ে কোনও কথাবার্তা বলবে না।

ন্যান্সি পেলোসির সফর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বা পরিস্থিতি এমন একটি দিকে গড়ানোটা শি জিনপিং সরকারের ভালই লাগছে, অন্তত এখনকার জন্য।

কথার লড়াই:

বিবিসির খবরে বলা হয়, তাইওয়ানকে ঘিরে গত কদিন ধরে যে সামরিক মহড়া আর গোলাগুলি চলছে, সবার মনোযোগ ছিল সেদিকে। কিন্তু এ মহড়ার পাশাপাশি বেইজিং থেকে যে ধরনের বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, আর হুংকার শোনা গেছে সেগুলোও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই তাইওয়ানের একদল রাজনীতিবিদকে ইঙ্গিত করে তাদেরকে 'তাইওয়ানের বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তি' বলেছেন। এ তালিকার শীর্ষে আছেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং তাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ এবং ‘চীনা জাতির বংশধর হওয়ার অনুপযুক্ত’ বলেছেন। তবে বেইজিংয়ের জন্য মুশকিল হচ্ছে, তারা যে ধরনের তাইওয়ানের চিত্র তুলে ধরতে চাইছে, বাস্তবতার সঙ্গে তার বিরাট ফারাক।

সাম্প্রতিক জরিপগুলোতে দেখা যাচ্ছে, তাইওয়ানের মানুষের একটা বড় অংশ চীনের সঙ্গে কোনও ধরনের একত্রীকরণের বিরুদ্ধে। তাইওয়ানের জনগণের বিরাট অংশ, যাদের সংখ্যা এখন বাড়ছে, নিজেদেরকে ‘চীনা’ নয় ‘তাইওয়ানিজ’ বলে ভাবছে।

তাইওয়ানের সাই ইং-ওয়েন সরকার সেখানে এক ধরনের 'অ-চীনাকরণ' নীতি নিয়েছে এবং তারা ‘দুই চীন’ অথবা ‘এক চীন, এক তাইওয়ান’ নীত প্রতিষ্ঠার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে বলে মনে করেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং।

এ কারণে ফ্রান্সে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূতকে বলতে শোনা গেছে, চীনের সঙ্গে তাইওয়ান এক হয়ে গেলে তাইওয়ানিজদের ‘নতুন করে শিক্ষিত’ করার প্রয়োজন পড়বে। রাষ্ট্রদূতের মতে, তাইওয়ানের মানুষের ‘মগজ ধোলাই’ করে বোঝানো হচ্ছে, তারা চীনা নয়।

তবে এটিও বাস্তব পরিস্থিতি থেকে একেবারে ভিন্ন। তাইওয়ান মুক্ত সমাজের দেশ, যেখানে লোকজন তাদের ইচ্ছামত পড়তে পারে, যা খুশি চিন্তা করতে পারে এবং যাকে খুশি ভোট দিতে পারে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যা ঘটছে তার পরিণাম কী হবে?

বেইজিংয়ের উদ্দেশ্য হল, ২০২৪ সালে তাইওয়ানের নির্বাচনে মানুষ যেন প্রেসিডেন্ট সাই এর দলকে ভোট না দেয়, সেজন্যে তাদেরকে ভয় দেখানো। বেইজিং চায়, তাদের বন্ধু-ভাবাপন্ন দল কেএমটি (কুওমিনটাং) ক্ষমতায় ফিরে আসুক।

তাইওয়ানের ব্যবসায়ীদেরকে চীন সরাসরি হুমকিও দিচ্ছে, যাদের অনেকের বড় বিনিয়োগ রয়েছে চীনের মূল ভূখণ্ডে। বলা হচ্ছে, তাদেরকে ‘সঠিক পক্ষ’ বেছে নিতে হবে।

বেইজিং এরকম কৌশল আগেও ব্যবহারের চেষ্টা করেছে, তবে সেরকম সাফল্য পায়নি। বেইজিংয়ের নিষেধাজ্ঞার ফলে তাইওয়ানের অনেক ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বিশেষ করে ফল ব্যবসায়ীরা। পর্যটন শিল্প এরই মধ্যে ক্ষতির শিকার হয়েছে, কারণ মূল ভূখণ্ড থেকে পর্যটকদের তাইওয়ানে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে চীন।

কিন্তু গত কয়েকদিনে যে নজির দেখা গেছে সেগুলো বিবেচনায় নিলে বলা যায়, বেইজিং-এর প্রতি তাইওয়ানের মনোভাব আরও কঠোর হতে চলেছে।