Published : 30 Apr 2025, 04:27 PM
পঞ্চাশ বছর আগে উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট গেরিলারা দক্ষিণ ভিয়েতনামের যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত বাহিনীকে পরাজিত করে পুরো দেশের ক্ষমতা কব্জা করেছিল, বুধবার রক্তক্ষয়ী সেই বিজয়ের অর্ধশতবর্ষ উদযাপন করছে লাখো ভিয়েতনামি।
সরকারিভাবে বুধবারের উদযাপনের পর্দা নামে হো চি মিন সিটিতে জাঁকজমকপূর্ণ কুচকাওয়াজের মাধ্যমে, যাতে অংশ নেয় হাজারো সেনা। রাশিয়ার বানানো যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টারের অংশগ্রহণে হয় এয়ার শো, এ সময় লাল পতাকা নাড়াতে নাড়াতে ভিয়েতনামিরা গায় দেশপ্রেমের গান।
১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল কমিউনিস্টশাসিত উত্তর ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গন দখলে নিয়েছিল, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির কিংবদন্তি নেতা হো চি মিনের নামে পরে শহরটির নাম বদলে রাখা হয় হো চি মিন সিটি।
“এটা ছিল বিশ্বাসের বিজয়, ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের বিজয়,” বুধবার যুদ্ধজয়ের ৫০ বছরপূর্তিতে শাসকদল কমিউনিস্ট পার্টির বর্তমান প্রধান তো লাম এমনটাই বলেছেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
লাম গতবছর কিছুদিন ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্টও ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রকে হারানোর ৫০ বছর উদযাপনে তিনি হো চি মিনের অন্যতম অনুপ্রেরণাদায়ী বাণীও উদ্ধৃত করেন, “ভিয়েতনাম এক, ভিয়েতনামের জনগণ এক—নদী শুকিয়ে যেতে পারে, পাহাড় ক্ষয়ে যেতে পারে কিন্তু এই সত্য কখনো বদলাবে না।”
ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের শেষ যোদ্ধাদলকে সরিয়ে নেওয়ার প্রায় দুই বছর পর পতন হয়েছিল সায়গনের, যার মাধ্যমে শেষ হয়েছিল ২০ বছরব্যাপী লম্বা যুদ্ধের, যা ৩০ লাখ ভিয়েতনামি ও প্রায় ৬০ হাজার মার্কিনির প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল।
“কমিউনিস্ট সেনারা দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গনে প্রায় কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই প্রবেশ করেছে, এটি জনসাধারণের জন্যও ব্যাপক স্বস্তির, শেষ মুহূর্তে হয়তো রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের ভয়ে ছিল তারা,” শহরটির পতনের দিন রয়টার্সের এক প্রতিবেদকের পাঠানো তারবার্তায় এমনটাই বলা হয়েছিল।
ওই তারবার্তায় বিজয়ী বাহিনীকে বলা হয়েছিল ‘ব্যাপক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত’ বাহিনী হিসেবে, যাদের গায়ে ছিল জঙ্গলের সবুজ রঙের যুদ্ধ পোশাক, তাদের সঙ্গে ছিল খালি পায়ের কিশোররাও।
তখনকার অনেক ঘটনার মধ্যে অনেকের স্মৃতিতে এখনও ভাসে- সায়গনের দিকে উত্তর ভিয়েতনামের ট্যাঙ্কগুলোর অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পালানো যুক্তরাষ্ট্রের শেষ হেলিকপ্টারগুলোর কথা, যাতে করে প্রায় ৭ হাজার লোককে দেশটি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সরিয়ে নেওয়া এসব লোকের মধ্যে অনেক ভিয়েতনামিও ছিলেন।
মার্কিন দূতাবাসের ছাদ থেকে সর্বশেষ হেলিকপ্টারটি উড়াল দেয় ৩০ এপ্রিল সকাল ৭টা ৫৩ মিনিটে, নিয়ে যায় সায়গনে থাকা শেষ মার্কিন মেরিন যোদ্ধাকে।
আনুষ্ঠানিকভাবে দুই ভিয়েতনাম একীভূত হয় আরও এক বছর পরে, যার মাধ্যমে অবসান ঘটে ২২ বছর আগে ফরাসী ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর দুই টুকরা হয়ে পড়া ভিয়েতনামিদের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিয়েতনাম সম্পর্ক
সায়গন থেকে মার্কিন সেনাদের পাততাড়ি গুটানোর ২০ বছর পর ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। ২০২৩ সালে ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সফরের সময় থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার হয়।
“যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনামের মধ্যে একটি শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিদ্যমান, এটা আরও প্রগাঢ় ও বিস্তৃত করতে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ,” বুধবার এমনটাই বলেছেন ভিয়েতনামের মার্কিন মিশনের মুখপাত্র।
দুই দেশের এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অবশ্য এখন চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়েছে কেননা বাইডেনের উত্তরসূরী ডনাল্ড ট্রাম্প চলতি মাসেই দক্ষিণপূর্ব দেশটির পণ্যে ৪৬ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করে বসেছেন।
এই শুল্ক অবশ্য জুলাই পর্যন্ত স্থগিত থাকছে। শুল্ক কমাতে ও বাণিজ্য বাড়াতে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনাও চলছে। কিন্তু এরপরও যদি শেষ পর্যন্ত শুল্ক বহাল থাকে তাহলে তা ভিয়েতনামের রপ্তানিনির্ভর প্রবৃদ্ধিকে জোর ধাক্কা দেবে। এই প্রবৃদ্ধিই গত কয়েক বছর ধরে দেশটিতে বিদেশি বিনিয়োগকে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করেছে।
বুধবারের কুচকাওয়াজে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিতে ওয়াশিংটন হো চি মিন সিটিতে তাদের কনসাল জেনারেলকে পাঠিয়েছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
দশ বছর আগে, যুদ্ধজয়ের ৪০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিনিধির উপস্থিতি ছিল না।
ভিয়েতনামিদের কাছে যুদ্ধে হেরেছিল ফরাসীরাও। গত বছর দিয়েন বিয়েন ফু-র যুদ্ধের সমাপ্তির ৭০ বছর উদযাপন অনুষ্ঠানে ফ্রান্স তাদের এক মন্ত্রীকে পাঠিয়েছিল। ওই যুদ্ধের মাধ্যমে ভিয়েতনামে ফরাসী ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে।
হ্যানয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্স্থাপন করলেও রাশিয়ার সঙ্গে এখনও তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। মস্কো এখনও ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী।
একাধিক সংঘাত এমনকি এখনও দক্ষিণ চীন সাগরের অনেক অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে বিরোধ থাকলেও উত্তরের প্রতিবেশী চীনের সঙ্গেও ভিয়েতনামের সম্পর্ক বেশ ভালো।
ভিয়েতনামের অর্থনীতিতে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে; বেইজিং হ্যানয়কে এমন অনেক উপকরণ সরবরাহ করে যেগুলো দিয়ে পণ্য তৈরি করে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে।
দুই দেশের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে সম্মান জানাতে বুধবারের কুচকাওয়াজে ১১৮ চীন সেনার একটি দল যাচ্ছে বলে আগেই জানিয়েছিল চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম।
‘স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ভিয়েতনাম যে আন্তর্জাতিক সমর্থন পেয়েছিল তার সম্মানে’ এই চীনা সেনারা ভিয়েতনামি সেনা ও পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কুচকাওয়াজে অংশ নেবে, বলেছিল তারা।