এই নগরী এবং এর আশেপাশে কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি ছাড়াও আছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নাতাঞ্জ।
Published : 21 Apr 2024, 10:00 PM
প্রাসাদ, মসজিদ আর মিনারের জন্য বিখ্যাত ইরানের ইম্পাহান নগরী সামরিক শিল্পেরও একটি প্রধান কেন্দ্র। গত শুক্রবার এ নগরীতেই শোনা যায় বিস্ফোরণের শব্দ।
ইস্পাহান ইরানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। এর নাম 'নেস্প-ই-জাহান' বা অর্ধেক পৃথিবী। ইরানের মাঝামাঝি জাগ্রোস পর্বতমালার কাছে এই নগরীর অবস্থান।
ওই নগরী ও এর আশেপাশের এলাকায় ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কারখানা আছে।
নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনাও এই নগরীর অপেক্ষাকৃত কাছে। ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এই নাতাঞ্জ।
ইস্পাহানের নাম ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলির সঙ্গে জুড়ে থাকার কারণেই এ নগরীতে প্রতীকী কোনও হামলা নজর এড়াবে না।
ইস্পাহানে হামলাটি ইসরায়েল চালিয়ে থাকলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার ইরানকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছে।
ইসরায়েল সরকার ইরানকে বলার চেষ্টা করেছে যে, ওই এলাকার সংবেদনশীল নিশানাগুলোতে হামলা চালানোর ক্ষমতা ইসরায়েলের রয়েছে, যদিও তারা এখনই সেরকম হামলা চালানো থেকে বিরত রয়েছে।
ইরানি কর্মকর্তারাও তাৎক্ষণিকভাবে ঘোষণা দিয়ে বলেছে যে, ইস্পাহান প্রদেশের পরমাণু স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণ সুরক্ষিত আছে।
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নেই। দেশটি এটাও অস্বীকার করে আসছে যে, তারা পারমাণবিক অস্ত্রধর দেশে পরিণত হওয়ার জন্য তাদের বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচিকে কাজে লাগাচ্ছে।
তবে শুক্রবার যা ঘটেছে তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী খবর পাওয়া যাচ্ছে। ইরানের মহাকাশ সংস্থার মুখপাত্র হোসেইন ডেলিরিয়ান বলেছেন, বেশ কয়েকটি ড্রোন সফলভাবে ভূপাতিত করা হয়েছে। সেখানে কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার খবর নাকচ করেন ওই মুখপাত্র।
পরে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুসেইন আমির-আব্দুল্লাহিয়ান রাষ্ট্রীয় টিভিতে বলেন, ছোট্ট ড্রোন ইস্পাহানে কোনও ক্ষয়ক্ষতি কিংবা প্রাণহানি ঘটাতে পারেনি, যদিও ইসরাইলপন্থি গণমাধ্যমে এমন খবর এসেছে।
আবার ইরানের কয়েকটি গণমাধ্যম ইস্পাহান বিমানবন্দর ও একটি সামরিক বিমান ঘাঁটির কাছে তিনটি বিস্ফোরণের খবর দিয়েছে। তবে এ হামলা ইসরায়েলের পক্ষ থেকে করা হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করেনি ইরান।
ইরান কি বলেছে?
বিস্ফোরণের কারণ হিসাবে ইরানের সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ আব্দুল রহিম মুসাভি দায়ী করছেন একটি সন্দেহজনক বস্তুর ওপর বিমান-বিধ্বংসী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুলি ছোড়াকে।
ইরানের একটি গণমাধ্যম ও কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, হামলার ঘটনায় ড্রোনগুলো অনুপ্রবেশকারীরা আকাশে উড়িয়েছিল।
ইস্পাহান বিমানবন্দরে ইরানের বিমান বাহিনীর একটি ঘাঁটি রয়েছে। সেখানে কিছু পুরনো এফ-১৪ যুদ্ধবিমান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এই যুদ্ধবিমানগুলো ১৯৭০-এর দশকে শাহ-র শাসনকালে সংগ্রহ করেছিল ইরান। তখন থেকেই দেশটি এই বিমান উড়িয়ে আসছে।
আগেও ইস্পাহানে হামলা হয়েছে:
এর আগেও ইস্পাহানে ইসরায়েলের হামলা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। গত বছর জানুয়ারিতে নগরীর কেন্দ্রস্থলে একটি গোলাবারুদের কারখানায় ড্রোন হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছিল ইরান। চারটি প্রপেলারের একটি ছোট ‘কোয়াডকপ্টার’- ড্রোন দিয়ে ওই হামলা চালানো হয়েছিল।
সম্প্রতি কয়েক বছরে ইরানের অন্যান্য অংশেও একই ধরনের ড্রোন হামলার খবর পাওয়া গেছে। এসব হামলার কোনোটিতেই জড়িত থাকার কথা নিশ্চিত করে জানায়নি ইসরায়েল।
ইস্পাহান কেন নিশানায়?
রাসায়নিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ এবং যুক্তরাজ্য ও নেটোর পারমাণবিক শক্তির সাবেক প্রধান হামিশ ডি ব্রেটন-গর্ডন বিবিসি-কে বলেন, ইস্পাহানকে নিশানা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই নগরীর ভেতরে এবং এর আশপাশে অনেকগুলো সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।
গর্ডন বলেন, "ইরান যেখানে পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে বলে আমরা মনে করি, ক্ষেপণাস্ত্র হামলাটি তার খুব কাছেই হয়েছিল। সুতরাং, এ হামলা সম্ভবত ইঙ্গিতপূর্ণ।”
তার কথায়, ইসরায়েলের হামলা তাদের সক্ষমতা এবং অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ। তিনি বলেন, গত সপ্তাহান্তে ইসরায়েলে ইরান যে ৩০০’রও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে করেছে তার বেশিরভাগই প্রতিহত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েল তাদের নিশানায় একটি বা দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে এবং ক্ষতিসাধন করেছে।
"ইরানের কর্মকর্তারা এ হামলাকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করছেন। কারণ, ইরান চায় না যে, তাদের পুরানো বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে ইসরায়েলের সফলতা সবার সামনে চলে আসুক,” বলেন গর্ডন।
তিনি বলেন, “সামরিকভাবে ইরানের চেয়ে ইসরায়েল অনেক এগিয়ে। আর ইসরায়েল সেটিই দেখিয়ে দিয়েছে।”
তার মতে, “ইসরাইলের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে জড়ানোর চাইতে ইরান বরং তাদের চরমপন্থি বিভিন্ন গোষ্ঠী ও প্রক্সি ব্যবহার করে ছায়া যুদ্ধ চালিয়ে যেতেই বেশি পছন্দ করবে।”
রাশিয়ার ভূমিকা:
ইরানের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বাড়িয়ে চলা রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ শুক্রবার ইসরায়েলকে বলেছেন, ইরান এই বিবাদ আর বেশি বাড়াতে চায় না।
রাশিয়ান রেডিওকে ল্যাভরভ বলেন, "রাশিয়া ও ইরানের নেতৃবৃন্দ, আমাদের প্রতিনিধি এবং ইসরায়েলিদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হয়েছে। এ আলোচনায় আমরা খুব স্পষ্ট করে ইসরায়েলকে জানিয়ে দিয়ছি যে, ইরান উত্তেজনা বাড়াতে চায় না।”
ওদিকে, রাসায়নিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ এবং যুক্তরাজ্য ও নেটোর পারমাণবিক শক্তির সাবেক প্রধান হামিশ ডি ব্রেটন-গর্ডন বলছেন, সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে গত ১ এপ্রিলে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের বিমান হামলার পর এর পাল্টায় গত সপ্তাহান্তে ইসরায়েলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে তেহরান তাদের ‘হৃত গৌরব কিছুটা পুনরুদ্ধার করেছে’। তবে তারা আর এগুতে চায় না।
কারণ, তিনি বলেন, “ইরান জানে যে, ইসরায়েল পুরোপুরি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ সমর্থন দিচ্ছে বলেও আলামত আছে। ওদিকে, ইরান আদতে খুব বেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে পারছে না। কেবল সামান্য একটু সমর্থন তারা পেতে পারে রাশিয়ার কাছ থেকে। কিন্তু এর বাইরে ইরান বহির্বিশ্ব থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।”