‘ভিশন প্রো’ নামে নিজেদের প্রথম অগমেন্টেন্ড রিয়ালিটি হেডসেট উন্মোচন করেছে প্রযুক্তি জায়ান্ট অ্যাপল।
সোমবার উন্মোচিত হেডসেটটি দেড় দশকের বেশি আগে আইফোন প্রকাশের পর থেকে এখন পর্যন্ত অ্যাপলের সবচেয়ে ‘ঝুঁকিপূর্ণ বাজি’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে কোম্পানি এমন এক বাজারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, যেখানে ‘কোয়েস্ট’ সিরিজের হেডসেটের সহায়তায় আধিপত্য করছে সামাজিক জায়ান্ট মেটা।
অ্যাপ নির্মাতাদের জন্য বার্ষিক আয়োজন ‘ডব্লিউডব্লিউডিসি’তে বেশ কয়েকটি নতুন পণ্য ও ফিচার উন্মোচন করেছে অ্যাপল। এর মধ্যে রয়েছে ১৫ ইঞ্চির ম্যাকবুক এয়ার, ‘এম২ আলট্রা’ নামের ক্ষমতাধর চিপ, ‘আইওএস’ সফটওয়্যারে আপডেট ও বহুল প্রতীক্ষিত বিরক্তিকর ‘অটোকারেক্ট বন্ধ করার’ সুবিধা।
ভিশন প্রো হেডসেটের দাম শুরু তিন হাজার চারশ ৯৯ ডলার থেকে। এর দাম মেটার মিক্সড ও ভার্চুয়াল রিয়ালিটি শ্রেণির সবচেয়ে দামি হেডসেটের তিন গুণেরও বেশি।
অ্যাপলের সিইও টিম কুক বলেন, নতুন এই হেডসেট ‘সহজেই বাস্তব জগত ও ভার্চুয়াল জগতের মিশ্রণ ঘটায়’।
বিবিসি বলছে, নতুন হেডসেটটির ব্যাটারি লাইফ কেবল দুই ঘণ্টা।
অ্যাপল বলেছে, হেডসেটটি চালু হলে বিশাল সংখ্যক আইপ্যাড ও আইফোন অ্যাপে এটি ব্যবহারের সুবিধা মিলবে। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারী নিজের চোখ ও হাত ব্যবহার করেই ‘অ্যাডোবি লাইটরুম’ চালাতে ও বিভিন্ন ছবি এডিটের সুবিধা পাবেন বলে প্রতিবেদনে লিখেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘ইউনিটি’ নামে পরিচিত প্ল্যাটফর্মের বেশ কিছু জনপ্রিয় অ্যাপ ও গেইমে বিভিন্ন ‘ভিশনওএস’ ফিচারের প্রবেশাধিকার মিলবে। এর উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, প্রযুক্তি কোম্পানি ‘সিসকো’র জুম ও ওয়েবেক্স’সহ মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল ও টিমের মতো অ্যাপগুলো।
ব্যবহারকারীর প্রাওভেসি ও বিভিন্ন ডেভেলপার প্ল্যাটফর্ম নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়াদি নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে বেশ কয়েক বছর ধরে চলমান সংঘর্ষের পর হেডসেটটি এমন ডিভাইসগুলোর সঙ্গে বাজারে পরীক্ষিত হবে, যেগুলো এখনও গ্রাহকদের আকর্ষণ করতে পারেনি। এ ছাড়া, ফেইসবুকের মালিক কোম্পানি মেটার সঙ্গেও সরাসরি প্রতিযোগিতায় ফেলবে একে।
রয়টার্স বলছে, নতুন হেডসেটের অগমেন্টেড রিয়ালিটি ফিচারের অভিনবত্বের পাশাপাশি খেলাধুলা ও বিনোদন খাতে এর অংশীদারিত্বের ওপর জোর দিয়েছে অ্যাপল।
কোম্পানি বলেছে, ডিভাইসটিতে ‘আর ১’ নামের নতুন চিপ ব্যবহৃত হবে, যা চোখের পলকের চেয়েও কম সময়ে নিজস্ব সেন্সর থেকে বিভিন্ন তথ্য প্রক্রিয়া করবে।
এই ঘোষণা ওয়াল স্ট্রিটকে তেমন আকৃষ্ট করতে পারেনি। কারণ উন্মোচনের আগে অ্যাপলের শেয়ারের দাম রেকর্ড উচ্চতায় নিয়ে এর পক্ষে বাজি ধরেছিল বিনিয়োগকারীরা।
“ভিশন প্রো হেডসেটটি কিনবেন যারা মূলত ধনী ও শুরুতেই বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে চান এমন ব্যক্তিরা। তবে, এর বিশাল বাজার তৈরির লক্ষ্যে অ্যাপলকে আরও বেশ কয়েক বছর কলকাঠি নাড়তে হবে।” --বলেন ২০০৫ সাল থেকে অ্যাপলের অংশীদার কোম্পানি ‘ওয়েজউড পার্টনার্স’-এর বিনিয়োগ প্রধান ডেভিড রলফ।
রলফ আরও বলেন, এই হেডসেটের জন্য এখনও বড় বাজার তৈরি হয়নি। তবে পণ্যটির প্রযুক্তিগত সুবিধাগুলোর প্রশংসা করেন তিনি।
“অ্যাপল ভিশন প্রো আমাকে ব্যক্তিগত কম্পিউটার বিপ্লবের শুরুর দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। মূলধারার পণ্য হয়ে উঠতে পিসি’র বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছিল। আর ভিশনপ্রো’র বেলাতেও একই ঘটনা ঘটছে।”
ভিশন প্রো ব্যবহারকারীরা নিজেদের চোখের মাধ্যমে গগলসের ভেতর বিভিন্ন কনটেন্ট বাছাই করতে, নিজের আঙ্গুলে একসঙ্গে চাপ দিয়ে ক্লিক করতে ও নিজের মাথাকে আলতো ঝাঁকুনি দিয়ে স্ক্রল করতে পারবেন। এর পাশাপাশি, ত্রিমাত্রিক ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন সিস্টেম ব্যবহার করে বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে পারবেন, যা পরবর্তীতে ‘৩ডি’তে দেখা যাবে।
মেটার হেডসেটের সঙ্গে এর সবচেয়ে দৃশ্যমান পার্থক্য হলো, এই ডিভাইসে একটি ‘এক্সটার্নাল ডিসপ্লে’ আছে, যা ব্যবহারকারীর চোখ বাইরের বিশ্বের লোকজনকে দেখায়।
“এটিই প্রথম অ্যাপল পণ্য, যার ‘মধ্যে নয় বরং মধ্য দিয়ে’ আপনি দেখতে পারবেন।” --বলেন অ্যাপল সিইও টিম কুক।
যুক্তরাষ্ট্রে হেডসেটটি পাওয়া যাবে আগামী বছর। আর অন্যান্য দেশে এটি আসতে সময় লাগতে পারে ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ।
মুখোমুখি
বাজার বিশ্লেষক কোম্পানি আইডিসি’র তথ্য অনুসারে, বিনিয়োগকারীরা হয়ত ভার্চুয়াল রিয়ালিটির বাজার ও মেটার প্রতি অ্যাপলের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানতে চাইবেন। বর্তমানে এআর/ভিআর বাজারের ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে মেটা।
মেটার প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ নিজের ‘মেটাভার্স’ লক্ষ্যমাত্রার রূপরেখা দিয়েছেন, যেখানে মানুষ বিভিন্ন কাজ করতে, গেইম খেলতে ও সময় কাটাতে পারবেন। তবে, এই শব্দটি এড়িয়ে গেছেন অ্যাপল নির্বাহীরা।
“আমার কাছে মূল পার্থক্য হলো, জাকারবার্গ এমন এক ভার্চুয়াল জগত তৈরির চেষ্টা করছেন, যেখানে তিনি আমাদের রাখতে চান। আর অ্যাপল আমাদের বাস্তব জগতের মধ্যে রেখেই এর বিভিন্ন সুবিধা বাড়াতে চায়।” --বলেন পরামর্শক কোম্পানি ‘ক্রিয়েটিভ স্ট্র্যাটেজিস’-এর বিশ্লেষক ক্যারোলিনা মিলানেসি।
এদিকে, মেটার পাশাপাশি সনি ও বাইটড্যান্স মালিকানাধীন কোম্পানি পিকো’ও ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ডিভাইস বানাচ্ছে।
আইডিসি বলেছে, গত বছর এইসব কোম্পানি সর্বমোট ৮৮ লাখ হেডসেট বিক্রি করেছে।
অ্যাপল বলেছে, নতুন এই হেডসেটে বিভিন্ন অ্যাপ আনতে তারা অ্যাডোবি ও মাইক্রোসফটের পাশাপাশি গেইম ডেভেলপারদের নিয়ে কাজ করা প্রযুক্তি কোম্পানি ইউনিটির সঙ্গেও কাজ করছে। হেডসেটের ঘোষণার পর ইউনিটির শেয়ারমুল্য বেড়েছে ১৭ শতাংশ।
ভিশন প্রো হেডসেটে ‘অ্যাপল টিভি+’-এর সিনেমা ও টিভি শো’র সংগ্রহের পাশাপাশি ওয়াল্ট ডিজনির ‘ডিজনি+’ স্ট্রিমিং সেবাও দেখা যাবে।
অ্যাপল আরও দেখিয়েছে, হেডসেটটি কোনো ট্র্যাকপ্যাড বা কিবোর্ডের সঙ্গে যোগ করে একাধিক ডিসপ্লে থাকা প্রচলিত কম্পিউটারের মতোও ব্যবহার করা যাবে।
এবারের আয়োজনে অ্যাপল অবশ্য চ্যাটজিপিটি বা গুগলের বার্ড সার্চ ইঞ্জিনের মতো জেনারেটিভ এআই ব্যবস্থা নিয়ে বড় কোনো ঘোষণা দেয়নি। তবে, নিরবে ভয়েস মেইলে সরাসরি ট্রান্সক্রিপশনের মতো বেশ কিছু এআই ভিত্তিক ছোট ফিচার এনেছে কোম্পানিটি।