প্রত্নতাত্ত্বিকরা দাবি করেছেন, ১৯৮৮ ও ১৯৯০ সালের মধ্যে খননের সময় ব্রাহের ল্যাব থেকে মাটির জিনিসপত্র ও কাচের বিভিন্ন টুকরা খুঁজে পেয়েছিলেন।
Published : 28 Jul 2024, 06:27 PM
সম্প্রতি আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের মূল স্থপতি টাইকো ব্রাহের অ্যালকেমি ল্যাবের রহস্য উন্মোচন করেছেন বিজ্ঞানীরা।
মধ্যযুগে অ্যালকেমিস্টরা গোপনে কাজ করতেন এবং ডেনিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী টাইকো ব্রাহেও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।
অ্যালকেমি রসায়নের একটি প্রাথমিক রূপ এবং জ্ঞানের দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক এক শাখা, যেখানে প্রাচীনকালে বিভিন্ন পদার্থের রূপান্তর ও রোগের নিরাময়ের লক্ষ্যে চর্চা করা হত।
ভেন দ্বীপে (বর্তমানে সুইডেনের অংশ) ‘ইউরানিবার্গ’ বা ‘স্বর্গের দূর্গ’ নামে একটি বিশাল বাসস্থান ও মান মন্দিরে থাকতেন ব্রাহে, যেখানে তার একটি অ্যালকেমি ল্যাবও ছিল বলে প্রতিবেদনে লিখেছে নোরিজ।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে অনেক বেশি অবদান থাকা সত্ত্বেও ব্রাহের বিভিন্ন অ্যালকেমিক্যাল পরীক্ষা সম্পর্কে বিশ্বের মানুষের খুব কমই জানা ছিল।
ব্রাহের মৃত্যুর পরে ১৬০১ সালে ‘ইউরানিবার্গ’ ভেঙে ফেলা হয় এবং সেই সময় এর বেশিরভাগ উপাদান বিভিন্ন কাজে ফের ব্যবহার করা হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা দাবি করেছেন, ১৯৮৮ ও ১৯৯০ সালের মধ্যে খননের সময় ব্রাহের ল্যাব থেকে মাটির জিনিসপত্র ও কাচের বিভিন্ন টুকরা পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি এইসব মাটির জিনিসপত্রের ভাঙা টুকরা নিয়ে পাঁচটি রাসায়নিক বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা, যাতে প্রাচীনকালে এগুলো যেসব উপাদানের সংস্পর্শে এসেছিল তা উন্মোচন করা যেতে পারে।
এ রাসায়নিক বিশ্লেষণে নেতৃত্ব দিয়েছেন ‘ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ডেনমার্ক’-এর অধ্যাপক কারে লুন্ড রাসমুসেন। পাশাপাশি ডেনমার্কের জাতীয় জাদুঘরের জ্যেষ্ঠ গবেষক পল গ্রাইন্ডার-হ্যানসেন এ গবেষণার ফলাফলকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করতে সহায়তা করেছেন।
এ গবেষণার ফলাফলে পাঁচটি মাটির পাত্রের ভাঙা টুকরার মধ্যে চারটিতেই পুরনো আমলের বেশ কয়েকটি উপাদানের স্তর দেখা গেছে। যা থেকে ইঙ্গিত মেলে, অ্যালকেমিক্যাল পরীক্ষায় এসব উপাদানের ব্যবহার হতে পারে।
এইসব উপাদানের মধ্যে নিকেল, তামা, দস্তা, টিন, অ্যান্টিমনি, টাংস্টেন, সোনা, পারদ ও সীসা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সেই সময় সোনা ও পারদ ব্যবহার হত ধনীদের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায়। তবে এতে টাংস্টেন ব্যবহারের বিষয়টি ছিল বিস্ময়কর। কারণ এরও ১৮০ বছর পর সুইডিশ রসায়নবিদ কার্ল উইলহেলম শিলে প্রথবারের মতো টংস্টেন শনাক্ত করেন।
অধ্যাপক লুন্ড রাসমুসেন অনুমান করেছিলেন, নিজের ল্যাবে অজান্তেই ব্রাহে এইসব টাংস্টেনযুক্ত খনিজ প্রক্রিয়াজাত করে থাকতে পারেন।
এমন সম্ভাবনাও রয়েছে, ব্রাহে সম্ভবত ‘ওল্ফ্রাম’ যা পরে টাংস্টেন নামে পরিচিতি পায় সে সম্পর্কে শুনেছিলেন। অনুমান রয়েছে, ১৫০০ এর দশকের গোড়ার দিকে জার্মান খনিজবিদ জর্জিয়াস অ্যাগ্রিকোলার টিনের আকরিকের একটি সমস্যাজনক উপাদান হিসাবে ওল্ফ্রাম-এর উল্লেখ করেছিলেন। তবে এ বিষয়টি এখনও অনুমাননির্ভর রয়ে গেছে।
জার্মান চিকিৎসক প্যারাসেলসাসের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত অ্যালকেমিস্টদের ঐতিহ্য অনুসরণ করেছিলেন ব্রাহে। তিনি সোনা তৈরির চেষ্টা করার পরিবর্তে ওষুধ তৈরির দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন। প্লেগ, সিফিলিস, কুষ্ঠরোগ, জ্বর ও পেট ব্যথার মতো রোগের চিকিৎসা করায় ছিল ব্রাহের লক্ষ্য।
প্লেগের জন্য ব্রাহের তৈরি অনেক ওষুধের মধ্যে একটি ছিল বেশ জটিল। কারণ এতে ছিল থেরিয়াক (সাপের মাংস ও আফিমসহ ৬০ টি পদার্থের মিশ্রণ), তামা বা আয়রন ভিট্রিয়ল (সালফেটস), বিভিন্ন তেল ও ভেষজ জাতীয় উপাদান।
বিজ্ঞানীদের অনুমান, বেশ কিছু পরিস্রাবণ ও পাতনের পরে এ ওষুধটিকে আরও উন্নত করতে প্রবাল, কচুরিপানা বা পানীয় সোনার টিংচার যোগ করা যেতে পারে।
জ্যোতিষ্ক, পার্থিব পদার্থের সঙ্গে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের সংযোগে বিশ্বাস করতেন ব্রাহে। যেমন— তিনি সূর্যকে সোনা ও হার্টের সঙ্গে এবং চাঁদকে রূপা ও মস্তিষ্কের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
একইভাবে বৃহস্পতি গ্রহকে টিন ও লিভারের সঙ্গে, শুক্রকে তামা ও কিডনির সঙ্গে, শনিকে সীসা ও প্লীহার সঙ্গে, মঙ্গলকে লোহা ও পিত্তথলির সঙ্গে এবং বুধকে পারদ ও ফুসফুসের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
ব্রাহের চুল ও হাড়ের আগের বিশ্লেষণে সোনার চিহ্ন খুঁজে পেয়েছিলেন অধ্যাপক লুন্ড রাসমুসেন। যা থেকে ইঙ্গিত মেলে, ব্রাহে নিজেই সোনার ওষুধ পানীয় আকারে খেয়েছিলেন।
গবেষণার এসব অনুসন্ধান টাইকো ব্রাহের কম পরিচিত অ্যালকেমিক্যাল চর্চার এক রোমাঞ্চকর অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছে। পাশাপাশি চিকিৎসা বিজ্ঞানে অগ্রগতির জন্য তিনি যে রহস্যময় বিভিন্ন উপাদান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন সে বিষয়টিও প্রকাশ্যে এনেছে।