‘ফেইসবুকে মডারেশনের কাজ আমার মনুষ্যত্ব কেড়ে নিয়েছে’

চাকরিতে নিজের প্রথম দিনে প্ল্যাটফর্মটির পোস্ট মডারেশনের কাজ করতে গিয়ে এক ব্যক্তির আত্মহননের ঘটনা দেখতে পান দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রেভিন ব্রাউনি।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2023, 11:32 AM
Updated : 25 April 2023, 11:32 AM

যেসব স্পর্শকাতর কনটেন্ট সামাজিক প্ল্যাটফর্ম ফেইসবুকের নীতিমালা লঙ্ঘন করে, সেগুলো থেকে ব্যবহারকারীদের সুরক্ষা দিতে হাজার হাজার মডারেটর পর্দার আড়ালে থেকে কাজ করেন। কেনিয়ার এমন এক মডারেটর বলছেন তিনি প্ল্যাটফর্মটির মালিক কোম্পানি মেটার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেবেন।

চাকরিতে নিজের প্রথম দিনে প্ল্যাটফর্মটির পোস্ট মডারেশনের কাজ করতে গিয়ে এক ব্যক্তির আত্মহননের ঘটনা দেখতে পান দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রেভিন ব্রাউনি।

“মৃত্যু দেখা (আত্মহনন) সমস্যা ছিল না। সমস্যা হলো, ওই ভিডিওতে লোকটির সঙ্গে থাকা তিন বছরের শিশুটি। ছেলেটা মেঝেতে খেলনা নিয়ে খেলছিল, এমনভাবে যেন সে বুঝতেই পারেনি কী ঘটছে।”

ঘটনা বুঝতে ও নিজের বাবাকে ডাকতে দুই বা তিন মিনিট সময় লেগেছিল শিশুটির। এরপর সে কাঁদতে শুরু করে। অবশেষে রুমে এক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রবেশের পর ওই রেকর্ডিং বন্ধ হয়।

“আমার নিজেকে অসুস্থ লাগছিল। আমি বমি করছিলাম, বুঝতে পারছিলাম না, কেউ এই ধরনের কাজ কীভাবে করতে পারে।” --বলেন ব্রাউনি।

ফেইসবুকের জন্য এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মানবতার সবচেয়ে খারাপ ঘটনাগুলো দেখতে হয়েছে ব্রাউনিকে। এর মধ্যে রয়েছে শিশু নিপীড়ন থেকে শুরু করে নির্যাতন ও আত্মঘাতি বোমা হামলার মতো ঘটনা।

তিনি বলছেন, এই অভিজ্ঞতা তার অনুভূতি ধ্বংস করে দিয়েছে। বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তার কণ্ঠের কাঁপুনি ও সহানুভূতি থেকে বোঝা যায়, তিনি এখনও অন্যদের জন্য গভীরভাবে অনুভব করেন। তবে ব্রাউনির নিজের বিশ্বাস হলো, তার মনুষ্যত্বের একটি অংশ হারিয়ে গেছে।

“কারণ আমি মূলত মৃত্যুর মতো ঘটনা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এটা আমার কাছে স্বাভাবিক বিষয়।” --বলেন তিনি। ব্রাউনির মতে, মৃত্যুর মতো ঘটনা তাকে এখন আর অতটা নাড়া দেয় না, যতোটা দেওয়া উচিৎ।

সামাজিক প্ল্যাটফর্মটির মডারেশন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা কর্মীদের ব্রাউনি দেখেন ব্যবহারকারীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সম্মুখসারীর যোদ্ধা হিসেবে। বিশেষ করে মহামারী চলাকালীন, যখন অনেকেই ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। ফেইসবুক যেভাবে গোটা বিশ্বের মানুষের সংযোগ ঘটিয়েছে, সেটিও তাকে আকৃষ্ট করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বিবিসি।

জানুয়ারিতে ফেইসবুকের পূর্ব আফ্রিকা অংশের মূল মডারেশন হাব ‘সামা’ ঘোষণা দেয়, তারা বিভিন্ন সামাজিক প্ল্যাটফর্মকে কনটেন্ট-রিভিউ পরিষেবা দেওয়া বন্ধ করবে।

নিজস্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ‘কম্পিউটার ভিশন সিস্টেম’ প্রশিক্ষণে সহায়তার উদ্দেশ্যে ‘ভিডিও অ্যানোটেশন’-এ মনযোগ দেওয়ায় গত মাসে ব্রাউনি’সহ দুইশ ৬০ জন মডারেটর ছাঁটাই করেছে সামা।

“এই চাকরির জন্য আমি নিজের মানবীয় দিক বিসর্জন দিয়েছি।  আমি মনে করি না, আপনি এখানে নিজের আত্মার চেয়ে বেশি কিছু দিতে পারবেন। এর পরও আপনাকে এভাবে বের করে দেওয়া হবে?” – প্রশ্ন ব্রাউনির কণ্ঠে।

ব্রাউনি নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত, কারণ তিনি ও তার বাগদত্তা শীঘ্রই বিয়ে করতে চান। এ ছাড়া, দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থান করা ব্রাউনির পরিবারও তার পাঠানো অর্থের ওপর নির্ভরশীল।

ব্রাউনি বলছেন, এইসব বিষয় আগে জানলে তিনি এই চাকরি নিতেন না। তবে তিনি অনুভব করেন, এটি এমন এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যেটাতে তিনি ভালো। আর এখানে তুলনামূলক সিনিয়র ভূমিকায় পদোন্নতিও অর্জন করেন তিনি।

বিবিসি বলছে, তিনি নিজের চাকরি চালিয়ে যেতে চান, তবে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কোম্পানি থেকে আরও সমর্থন দরকার।

ফেইসবুকের মালিক কোম্পানি মেটা, সামা ও মেটার নতুন ঠিকাদার লুক্সেমবর্গ ভিত্তিক কোম্পানি ‘ম্যাজোরেল’-এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে যাওয়া অধিকার দল ‘ফক্সগ্লোভ’ সমর্থিত একশ ৮৪ জন মডারেটর দলের একজন হলেন ব্রাউনি।

মেটা এই কার্যক্রম থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে চাইলেও বৃহস্পতিবারের এক রায়ে উঠে আসে, অন্যায্য উপায়ে কর্মী ছাঁটাইয়ের কারণে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে মামলা করা যেতে পারে।

কোরি ক্রাইডার নামে ফক্সগ্লোভের এক পরিচালক এই সিদ্ধান্তকে ‘মাইকফলক’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “যতো সম্পশালীই হোক না কেন, কোনো প্রযুক্তি জায়ান্টই আইনের উর্ধ্বে নয়।”

মেটা ও সামার বিরুদ্ধে এই অন্তর্বর্তী রায়ের মানে দাঁড়ায়, মডারেটরদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা যাবে না। আর মামলার সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের অবশ্যই বেতন দিতে হবে।

মডারেটররা বলছেন, কাজের পরিস্থিতি নিয়ে অভিযোগ ও শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনচেষ্টার প্রতিশোধ হিসেবে তাদের ছাঁটাই করা হয়।

আদালতে জমা দেওয়া আবেদন অনুসারে অভিযোগের মধ্যে আরও রয়েছে, ‘সামায় আগে কাজ করেছেন’- এই অজুহাতে তারা বৈষম্যের শিকার হওয়ার পাশাপাশি মেজোরেল তাদের কাজ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

বিবিসি’র দেখা ও মডারেটরের আইনি দলের সঙ্গে শেয়ার করা টেক্সট বার্তা দেখাচ্ছে, যেসব মডারেটর মেজোরেলে চাকরির আবেদন দিতে আগ্রহী, তাদেরকে থার্ড পার্টি নিয়োগকারীর মাধ্যমে জানানো হয়, “কোম্পানি সামা থেকে আসা কোনো প্রার্থী গ্রহণ করবে না। এটা একেবারেই না।”

আইনি পদক্ষেপ চলমান থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে বিবিসিকে এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে রাজী হয়নি মেটা। তবে, কোম্পানির বিভিন্ন ঠিকাদারকে প্রশিক্ষিত অনুশীলনকারীদের সার্বক্ষণিক ‘অন-সাইট’ সহায়তার পাশাপাশি কাজে যোগ দেওয়ার প্রথম দিন থেকেই ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসেবার সুবিধার বাধ্যবাধকতার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বিবিসি।

আইনি কার্যক্রমের কারণ দেখিয়ে এই প্রসঙ্গে মেজোরেলও বিবিসিকে কোনো মন্তব্য করতে রাজী হয়নি।

সামার এক মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, তারা মডারেটরদের ন্যায্য মজুরি দিয়ে থাকেন। এর এটি কেনিয়ার শীর্ষ ১২টি চাকরির একটি।