ইন্টারনেট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে জ্যেষ্ঠ পদে বাংলাদেশি জাহেদুজ্জামান

‘ইন্টারনেট ইঞ্জিনিয়ারিং টাস্ক ফোর্স (আইইটিএফ)’ এর ‘ট্রান্সপোর্ট এরিয়া’ পরিচালক হিসেবে সম্প্রতি দায়িত্ব নিয়েছেন একজন বাংলাদেশি। এই প্রযুক্তি পেশাদার পূর্ণকালীন গবেষক হিসেবে যুক্ত আছেন অন্যতম শীর্ষ টেলি যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এরিকসনে। তার নাম আ ন ম জাহেদুজ্জামান সরকার।

আবদুল্লাহ জায়েদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 August 2021, 05:57 PM
Updated : 4 August 2021, 12:24 PM

প্রযুক্তি পণ্য বা সেবা ব্যবহারকারীদের অনেকের কাছেই ‘আইইটিএফ’ নামটি অপরিচিত মনে হতে পারে। ইন্টারনেট ভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কার্যকারিতা ও বৈশ্বিক সাফল্যের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে এই সংস্থাটি।

‘দ্য ইন্টারনেট ইঞ্জিনিয়ারিং টাস্ক ফোর্স’ বা আইইটিএফ একটি ‘ওপেন স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন’। কম্পিউটার নেটওয়ার্ক প্রকৌশলের ভাষায় ‘ইন্টারনেট স্ট্যান্ডার্ড’ বলতে বোঝায় ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রযুক্তির খুঁটিনাটি ও প্রায়োগিক মানদণ্ডকে। আর এই ইন্টারনেট মানদণ্ডগুলো তৈরি ও প্রকাশনার কাজটাই করে থাকে এই সংস্থাটি।

পর্দার পেছন থেকে সিনেমার প্রযোজক, পরিচালক বা চিত্রনাট্যকার যে ভূমিকা পালন করেন, ইন্টারনেটে যে কোনো ডেটা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রেও আইইটিএফ-এর ভূমিকা অনেকটা তেমনই।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সঙ্গে এক আলাপচারিতায় পেশাগত জীবন আর প্রযুক্তি শিল্পে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ও প্রতিশ্রুতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করেছেন সুইডিশ নেটওয়ার্কিং ও টেলিকমিউনিকেশন জায়ান্ট এরিকসনের এই গবেষক।

আইইটিএফ: কী, কেন ও কীভাবে?

‘ইন্টারনেট স্ট্যান্ডার্ড’-এর মধ্যে বিশেষ করে ইন্টারনেট প্রোটোকল স্যুট (টিসিপি/আইপি) নিয়ে গবেষণা, নির্মাণ, মানোন্নয়ন ও প্রকাশনার কাজ করে আইইটিএফ। তবে এই সব কাজই হয় স্বেচ্ছা অংশগ্রহনের মাধ্যমে। আর আইইটিএফ-এর দেখভালের দায়িত্বে আছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘ইন্টারনেট সোসাইটি’।

বিজিপি, আইপিভিফোর, এইচটিটিপি এবং এইচটিটিপিএস-এর মতো শব্দগুলো বেশ কাঠখোট্টা লাগবে সাধারণ লোকজনের জন্য। এই কাঠখোট্টা নামগুলোর ওপরই নির্ভর করে ইন্টারনেটের ঠিকঠাক কাজ করার বিষয়গুলো।

এই কারিগরি নিয়মগুলো তৈরি, মানোন্নয়ন ও প্রকাশনার কাজ করে আইইটিএফ।

আইইটিএফ-এর গোটা কার্যক্রমকে সাতটি ভাগে ভাগ করে কাজ চলে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই অংশগ্রহন থাকে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠান ও ইন্টারনেটভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর।

এর একটি ভাগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাহেদুজ্জামান। কাজের অংশ হিসেবে তিনি ‘ইন্টারনেট ইঞ্জিনিয়ারিং স্টিয়ারিং গ্রুপ (আইইএসজি)’-এরও সদস্য। সেখানে নিজ কর্মস্থল এরিকসনের প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। বর্তমানে আইইএসজি’র সদস্যের তালিকায় আছে গুগল, ফেইসবুক, সিসকো এবং এরিকসন-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো।

কী করছেন তিনি সেখানে?

বর্তমানে এইচটিটিপি/৩, কুইক ও মাস্ক প্রোটোকল নিয়ে কাজ করছেন জাহেদুজ্জামান। হাইপারটেক্সট ট্রান্সফার প্রোটোকল বা এইচটিটিপি’র তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্করণ এটি। এইচটিটিপিএস-এ যোগ হয়েছিলো এনক্রিপশন সুবিধা। এইচটিটিপি/১.১ এবং এইচটিটিপি/২ টিসিপি প্রোটোকল নির্ভর হলেও এইচটিটিপি/৩ কুইক (QUIC) প্রোটোকল ব্যবহার করে যা আদতে একটি ‘ট্রান্সপোর্ট লেয়ার নেটওয়ার্ক প্রোটোকল’। ডেটা প্যাকেট লস সমস্যার সমাধান করবে এই প্রযুক্তি। তবে এখনও ‘ইন্টারনেট স্ট্যান্ড্যার্ড’ পর্যায়ে পৌঁছায়নি এই প্রযুক্তি। ইন্টারনেট ড্রাফট’ পর্যায়ে আছে এটি।

আর আইইটিএফ ‘এরিয়া ডিরেক্টর’ হিসেবে দেখভাল করছেন কুইক, ডিটিএন, এনএফএসভি৪, আরএমক্যাট এবং ট্যাপস প্রোটোকলের ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’গুলোর।

চলতি মহামারী প্রকোপের মধ্যে ব্যবহার ও কদর দুটোই বেড়েছে সফটওয়্যার ও অ্যাপভিত্তিক ভিডিও কলিং সেবার। সেই উদাহরণ টেনেই জাহেদুজ্জামান আইইটিএফ-এর সার্বিক কার্যক্রমের ব্যাখ্যা দিলেন এভাবে--

“দেখুন এখন যে ভিডিও কলিং সেবার বহুল প্রচলন হয়েছে, আমরা সেই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছি আরও প্রায় দশ বছর আগে থেকে। ডিভাইস, অপারেটিং সিস্টেম, নেটওয়ার্ক নির্বিশেষে একই সেবা যেন সব প্লাটফর্মে ব্যবহার করা যায় সেই বিষয়টাই আইপি’র মাধ্যমে নিশ্চিত করার চেষ্টা করি আমরা। এই ইন্টারনেট প্রোটোকলগুলোর কারণেই ওয়াই-ফাই সংযোগ থেকে মোবাইল ডেটা ব্যবহারকারী ডিভাইসে ডেটা পাঠানো সম্ভব হয়।”

দেশের তরুণদের কেমন সম্ভবনা আছে এ পর্যায়ে যাওয়ার?

“আমি তো আমাদের আইইটিএফ-এর রেজিস্ট্রেশন লিস্ট দেখে দেশের মানুষ খুঁজতাম। কাউকে পেলেই তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করতাম। আমার পরিকল্পনা থাকতো, কাউকে পেলে তাকে বলবো যে আপনি দেশে যান। আরও মানুষ নিয়ে আসুন দেশ থেকে।” -- বললেন জাহেদুজ্জামান।

আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি অঙ্গনে বাংলাদেশি মুখের অনুপস্থিতির সমাধান তিনি দেখছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও তরুণদের মধ্যে। আইইটিএফ-এর স্বেচ্ছাসেবকদের সিংহভাগ নেটওয়ার্ক ডিজাইনার, ভেন্ডর, এবং গবেষক হলেও সবার জন্য উন্মুক্ত এই সংস্থাটি। ফলে প্রযুক্তি খাতের শিক্ষার্থীরাও চাইলে এর অংশ হতে পারবেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতার সামঞ্জস্য ঘটানোর উপর জোর দিলেন তিনি।

আর তার নিজের সংস্থার বিষয়ে জানালেন, আইইটিএফ-এর কর্মীরা যোগাযোগ, আলোচনা ও সিংহভাগ কাজ সারেন একটি ওপেন মেইলিং লিস্ট-এর মাধ্যমে।

“বাংলাদেশের একজন শিক্ষার্থী চাইলেই আইইটিএফ-এর সদস্য হয়ে আন্তর্জাতিক শিল্পের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে। ধরুন, বাংলাদেশের একজন শিক্ষার্থী একটা নেটওয়ার্ক বানালো। সেখানে কোনো বাগ বা হার্ডওয়্যার জটিলতার মুখে পড়তে হলো। সেই বিষয়ে আইইটিএফ-এর মেইলিং লিস্ট ধরে সবাইকে প্রশ্ন করতে পারবেন তিনি। আর কেউ না কেউ তার সমস্যার সমাধান দিতে পারবে। এভাবেই আইইটিএফ-এ নতুন নতুন সমস্যার সমাধান করি আমরা।”

“বিশ্ববিদ্যালয়ে যা শেখানো হয় তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এর পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতাও প্রয়োজন। তাত্ত্বিক জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকএন্ডের বিস্তারিতও জানা দরকার।”

এ ছাড়া বছরে তিনবার স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য সভার আয়োজন করে আইইটিএফ। সভার জন্য এককালীন ফি গুনতে হলেও মেইলিং লিস্ট অংশগ্রহনে ইচ্ছুক সবার জন্য খোলা।

যেভাবে এ পর্যায়ে এলেন তিনি

ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি থেকে স্নাতক পাশ করে স্নাতোকোত্তর পড়াশোনার জন্য পাড়ি জমান সুইডেনে। ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার একটা চিন্তাও মাথায় ছিলো বলে জানালেন রংপুর ক্যাডেট কলেজের সাবেক এই শিক্ষার্থী।

সুইডেনের ‘লুলিও ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি’-তে কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে এমএসসি করছিলেন ওই সময়ে। ৪জি নেটওয়ার্কে ভিডিও পাঠানোর কারিগরি ছিল তার গবেষণার বিষয়। থিসিসের অংশ হিসেবে কাজ শুরু করেন এরিকসনে। সেখানে কাজের সুযোগ থেকেই পুরোপুরি চলে যান গবেষণায়।

“আমি তখনি থিসিস করছিলাম। তো ওই সময়েই আমার ম্যানেজার একটা চাকরির প্রস্তাব দেন।”, হাসিমুখে জানান ওই গবেষক।

২০০৭ সালে এরিকসনের গবেষণা বিভাগে যোগ দেন তিনি। ঠিক পরের বছরই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করেন আইইটিএফ-এ। “শুরুতে আমার গবেষণার মূল ক্ষেত্র ছিলো মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি। পরে যখন দেখলাম আমার গবেষণার বিষয় ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তখন সেদিকে ঝোঁক বাড়ে আমার।”