কেন খেপলেন ট্রাম্প? কে এই জ্যাক ডরসি, কেমন মানুষ তিনি?

করোনাভাইরাস লকডাউনে বিপর্যস্ত বিশ্ব, ধসে পড়তে শুরু করেছে অর্থনীতি, সংক্রমণ এড়াতে ট্রেসিং অ্যাপ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে একাধিক দেশের সরকার। ঠিক এরকম একটি সময়ে শুরু হল ‘ডনাল্ড ট্রাম্প বনাম টুইটার’ লড়াই।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 May 2020, 01:01 PM
Updated : 30 May 2020, 01:01 PM

আদতে নেপথ্যের ঘটনা কী? কেন এরকম একটি সময়ে লড়াইয়ে জড়ালেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও প্রখ্যাত মার্কিন মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটার? বিবিসি’র সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের আলোকে চলুন জেনে নেওয়া যাক ঠিক কীভাবে শুরু হয়েছে এ লড়াই, আর কেন-ই বা হচ্ছে এ লড়াই।

অনেক বছর ধরেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত টুইট প্রসঙ্গে নিরব ভূমিকা পালন করেছে টুইটার। আর দশ জন সাধারণ ব্যবহারকারীর মতো টুইটারের বিধিনিষেধ সেভাবে মেনে না চললেও টুইটার তেমন কিছুই বলেনি তাকে। কিন্তু এ সপ্তাহে এসে বদলে গিয়েছে সব। হুট করে প্ল্যাটফর্মটি ‘ফ্যাক্ট-চেক’ লেবেল সাঁটিয়ে দিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের টুইটে।

ঘটনার সূত্রপাত বুধবার। এক টিভি উপস্থাপক এবং সাবেক রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যানকে জড়িয়ে এক অপরাধ অভিযোগে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব শেয়ার করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এ ধরনের টুইট শেয়ার করতে দেওয়ায় শুরু হয় টুইটারের বিরুদ্ধে আলোচনা এবং সমালোচনা।

টুইটার-ও সে আলোচনা-সমালোচনার মুখে ব্যবস্থা নেয়। ওই টুইটের বদলে অন্য দুটি টুইটে জুড়ে দেয় ‘ফ্যাক্ট-চেক’ লেবেল। ফ্যাক্ট-চেক জুড়ে দেওয়া টুইট দুটির মধ্যে একটি ছিল নতুন নীতির অধীনে ডাকযোগে ভোট দেওয়া সম্পর্কে।

সামাজিক মাধ্যম বিশেষজ্ঞ ক্রিস স্টোকেল-ওয়াকার মনে করছেন, শুধু নির্বাচন নিয়ে করা টুইটের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার হিসেবটিকে প্রথমে সতর্ক পদক্ষেপ মনে করেছিল টুইটার। “কিন্তু আপনি যখনই রাজনীতির ব্যাপারে কোনো মন্তব্য বা পরিবর্তনে হাত দেবেন, তখন আপনাকে ধরেই নিতে হবে যে আপনার ৫০ শতাংশ দর্শকের বৈরী মনোভাবের দিকে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে”।

স্বাভাবিকভাবেই টুইটারের প্রথম পদক্ষেপের পর চটে যান ট্রাম্প, হুমকি দিয়ে বসেন সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করার ব্যাপারে। ওই সময় দুটি পথ খোলা ছিল টুইটারের হাতে। একটি পথ হচ্ছে পুরো ব্যাপারটি নিয়ে নিরব হয়ে যাওয়া, দ্বিতীয় পথটি হচ্ছে এটিকে বাড়তে দেওয়া।

টুইটার বেছে নেয় দ্বিতীয় পথটি।

যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপলিসের এক কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যুর ঘটনায় দেশটি জুড়ে চলছে প্রতিবাদ। ওই সম্পর্কে শুক্রবার সকালে এক টুইটে ট্রাম্প জানান, “লুট হওয়া শুরু হলে, গুলি করা শুরু হবে”। প্রধান নির্বাহী জ্যাক ডরসির পরামর্শে ওই টুইটটিকে “সহিংসতা উস্কে দেওয়া হয়েছে” আখ্যা দিয়ে আড়াল করে দেওয়া হয়।    

ব্যবহারকারীরা এখনও টুইটটি দেখতে পারছেন, তবে এখন ক্লিক করে টুইটে লেখা বার্তা দেখতে হচ্ছে। ফলে শেয়ার করা আগের চেয়ে কঠিন হয়ে গেছে।

এর কয়েক ঘণ্টা পরেই আসে পাল্টা আঘাত। অফিশিয়াল হোয়াইট হাউজ অ্যাকাউন্ট থেকে আবার একই টুইট করা হয়। ফলে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হোয়াইট হাউজের টুইট আড়াল করে দেয় টুইটার।

পুরোপুরি লড়াই শুরু হয়ে যায় এর মধ্য দিয়েই, কোনো পক্ষই পিছু হটতে রাজি নয় এখন।

হোয়াইট হাউজ এখন প্রমাণ করতে ব্যস্ত কবে কোন বিশ্ব নেতা্ ‘সহিংসতাকে মহিমান্বিত’ করে টুইট করেছেন, কিন্তু টুইটার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আর অন্যরা বের করছেন ট্রাম্প কবে কোন ভুল তথ্য ছড়িয়ে নিয়ম ভেঙেছেন।

টুইটার প্রধান জ্যাক ডরসি সবসময়ই ‘হালকা-কড়া নীতিমালার’ পক্ষে। কিন্তু পরিস্থিতি এমন দিকে গড়াচ্ছে যে এখন তাকে বিশ্ব নেতাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হতে পারে।

এখন পর্যন্ত টুইটারের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি আরেক সামাজিক মাধ্যম ফেইসবুককে। ফেইসবুক বরং লেজ গুটিয়ে বলতে শুরু করেছে, 'আমরা টুইটারের মতো নই'।

সাধারণত ফেইসবুক অনেক ক্ষেত্রে টুইটারের চেয়ে অনেক বেশি নিয়ম মেনে চলে। কিন্তু ফেইসবুক প্রধান মার্ক জাকারবার্গ আগেই জানিয়েছেন, ডরসির টুইটারের মতো রাজনীতিবিদদের ‘ফ্যাক্ট-চেক’ বা সত্যতা যাচাই করবে না তার ফেইসবুক। ডনাল্ড ট্রাম্পের ফেইসবুক পেইজের পোস্টেও তা-ই কোনো ‘ফ্যাক্ট-চেক’ লেবেল সেঁটে দেওয়া হয়নি।

“এ ধরনের ব্যাপারগুলোতেই আনন্দ পান ডনাল্ড ট্রাম্প। সাবেক রিয়েলিটি টিভি তারকা যিনি জল ঘোলা করতে পছন্দ করেন। এখন তিনি মার্ক জাকারবার্গ ও জ্যাক ডরসিকে একে অপরের বিপক্ষে দাঁড় করাতে পেরেছেন।” – বলেছেন ক্রিস স্টোকেল-ওয়াকার।

তিনি আরও জানিয়েছেন, বাক স্বাধীনতার বড়াই প্রেসিডেন্ট যতোই দেখান না কেন, টুইটার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং এটি নিজ ক্ষেত্রে যা চায় তা-ই করতে পারে আর ট্রাম্পও নিজ বার্তা প্রকাশের মূল প্ল্যাটফর্মটিকে এতে সহজে বন্ধ করে দেবেন বলে মনে হয় না।

কেন খেপলেন ট্রাম্প?

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগেও ডনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় যোগাযোগ মাধ্যম ছিল টুইটার।  আর বর্তমানে প্রতি পাঁচজন মার্কিনীর মধ্যে একজন টুইটারে ডনাল্ড ট্রাম্পের অনুসারী। ভোটের বাজারের হিসাবে এটি বিশাল সংখ্যা। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এই যোগাযোগ মাধ্যমে কোনোরকম চ্যালেঞ্জ ছাড়াই যা খুশি বলে যেতে পারতেন ট্রাম্প। খেয়াল করে দেখবেন, এমনকি হোয়াইট হাউজে আয়োজিত প্রেস কনফারেন্সেও বেয়াদব সাংবাদিকরা বেমাক্কা প্রশ্ন করে বসেন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে। তিনি তখন হয় বলেন- এই প্রশ্নের জবাব আমি দিয়েছি (যেটি ডাহা মিথ্যে কথা), অথবা এটি একটি জঘন্য প্রশ্ন অথবা সাংবাকিরা কোনো সূত্র উল্লেখ করে প্রশ্ন করলে তিনি মুখের ওপর বলে দেন - "ফেইক নিউজ"। এ মাসের শুরুতেই এক সংবাদ সম্মেলনে দুই নারী সাংবাদিকের প্রশ্নের তোড়ে পোডিয়াম ছেড়ে চলেই যান ডনাল্ড ট্রাম্প, একেবারে হোয়াইট হাউজেই। অনেক "ফেইক নিউজ" প্রতিনিধিকে হোয়াইট হাউজে নিষিদ্ধও করেছেন ট্রাম্প।

গত ১৪ এপ্রিল মার্কিন দৈনিক ওংয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদন বলছে প্রেসিডেন্ট হিসাবে মোট ১১৭০ দিনে প্রায় ১৮ হাজার বার  মিথ্যাচার করেছেন বা ভুল তথ্য দিয়েছেন ডনাল্ড ট্রাম্প।

কার্যত দেখা যাচ্ছে একটি জায়গাতেই কোনো বাধা ছাড়াই যা খুশি তাই বলতে পারেন ট্রাম্প এবং সেইটি হচ্ছে টুইটার। পাশাপাশি এটি সেই যোগাযোগ মাধ্যম যার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মার্কিনীর কাছে পৌঁছাতে পারেন তিনি।

এখন সেই টুইটার নাক গলানো শুরু করেছে তার টুইটগুলোয়।

ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন টুইটার তার বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। আর বান্তবতা হলো, ভুল তথ্যের জন্য কোনো টুইট মুছে দেয়নি টুইটার। কেবল একটি লেবেল সাঁটিয়ে দিচ্ছে টুইটের সঙ্গে যেখান থেকে ট্রাম্প অনুসারীরা সঠিক তথ্যটি পেতে পারেন। হয়তো মিথাচার ধরিয়ে দেওয়াই তার বিবেচনায় বাক স্বাধীনতা হরণ।

কেমন মানুষ জ্যাক ডরসি?

ডনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে লোকজন কমবেশি জানেন। তার চোখের পলকে মিথ্যা বলা, মুখের ওপর কোনো সঠিক রেফারেন্সকেও ফেইক নিউজ বলে ছুঁড়ে ফেলা এসবই এতোদিনে সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু জ্যাক ডরসি কে? কেমন মানুষ তিনি? চাপের মধ্যে তার আচরণ কেমন?

এসবের খানিকটা উত্তর মিলবে সাম্পতিক তার কোভিড সহায়তায় অর্থ দান থেকে। টুইটার এবং স্কয়ারের এই প্রধান নির্বাহী স্কয়ার থেকে তার বেশ কিছু শেয়ার বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়েছেন কোভিড-১৯ সহায়তা তহবিলে। যখন প্রশ্ন করা হলো, তিনি কেন টুইটারের শেয়ার বিক্রি না করে স্কয়ার শেয়ার বিক্রি করলেন, জ্যাক ডরসির সোজাসাপ্টা জবাব ছিল- স্কয়ারে তার শেয়ারের অংশ বেশি, সেখানে তার ক্ষমতাও বেশি ফলে সহজেই অর্থের ব্যবস্থা করতে পারছেন তিনি।

জ্যাক ডরসি'র সেই প্রতিশ্রুত অর্থের পারিমান এক বিলিয়ন ডলার বা তার মোট সম্পদের শতকরা ২৮ ভাগ। অনেক প্রতিষ্ঠানই করোনাভাইরাস তহবিলে অর্থ দিয়েছে কিন্তু ব্যক্তিগত শেয়ার বিক্রি করে বিলিয়ন ডলারের তহবিল? খুঁজে দেখুন, সহজে পাওয়া যাবে না।

অনুমান করা যেতে পারে মিশৌরি অঙ্গরাজ্যের সেইন্ট লুইসে জন্ম নেওয়া ডরসির স্বভাবে রয়েছে 'গডফাদার' রচয়িতা মারিয়ো পুজোর ভাষায় 'সিসিলিয়ান রক্ত'। গডফাদার ডন ভিটো কর্লিয়নির ভাষায়-- এমন মানুষ যে কিনা লক্ষে পৌঁছানোর জন্য 'সব কিছু ছেড়ে দিতে পারে'।

ব্যক্তি জীবনে একজন বডি মাসাজ প্রফেশনাল লাাইসেন্সধারী (২০০২ সাল থেকে তার পেশাদার লাইসেন্স আছে) হলেও টুইট নিয়ে যাচ্ছেতাই করার বিষয়ে ডরসি অন্তত ডনাল্ড ট্রাম্পের কাঁধ মাসাজ করে দেবেন না সেটুকু অনুমান করে নেওয়া যায়।

এরপরও অনেক কিছুই ঘটতে পারে। প্রভাবশালী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটি এখন চলে এসেছে রাজনীতির মাঠে। একসময়ে নিউ ইয়র্কের মেয়র হতে চাওয়া জ্যাক ডরসি প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাজনৈতিক চাপ কী করে সামলান সেটি ভবিষ্যতই বলে দেবে।