জাসদের যাত্রাপথের চুয়াল্লিশ বছর: কতিপয় খসড়া উপপাদ্য ও সম্পাদ্য

মুশতাক হোসেন
Published : 30 Oct 2016, 06:59 PM
Updated : 30 Oct 2016, 06:59 PM

১.

আজকাল অনেকেই প্রশ্ন করেন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর যে রাজনৈতিক তাত্ত্বিক অবস্থান ঘোষণা করেছিল, সেখানে স্থির আছে কি? তাত্ত্বিক অবস্থান কী ছিল– এ প্রশ্নের জবাবও জাসদ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাবেক ও বর্তমান নেতৃবৃন্দ এক ভাষাতে দেন না। তবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধরন জন্মলগ্নে যা ছিল, তা যে পাল্টেছে– এটা কেউ অস্বীকার করেন না। জন্মলগ্নের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধরন সঠিক ছিল, না বেঠিক ছিল– এ প্রশ্নের জবাবও এক রকম পাওয়া যায় না সংশ্লিষ্ট নেতৃত্বের কাছ থেকে।

২.

শুধু জাসদ নয়, এ প্রশ্ন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী প্রায় সব রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকগণ তাদের স্ব স্ব নেতৃত্বের কাছে করে থাকেন। জাসদ রাজনীতি যেখানে আটকে আছে, তা শুধু জাসদ রাজনীতির সমস্যা নয়। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনীতির সমস্যা, এমনকি তা গণতান্ত্রিক রাজনীতির সমস্যা। অবশ্য যারা গণতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে দেশের বর্তমান অবস্থার জনবান্ধব পরিবর্তন চান তাদের কথা বলছি, যারা বিদ্যমান অবস্থা ঠিক রেখে ক্ষমতার সেবা করার রাজনীতির জন্য গণতান্ত্রিক রাজনীতির নাম ব্যবহার করতে চান তারা নন।

৩.

এ প্রশ্ন করার কারণটা কী? কারণ সম্ভবত দুটো। কর্মী ও জনগণ জানতে চান– প্রথমত, জাসদ ও অন্যান্য সমাজতন্ত্রপন্থী দল এখন যা করছে, তা কি সঠিক ও কার্যকর? দ্বিতীয়ত, সমাজতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী?

৪.

জাসদ রাজনীতির শুরুটা কেমন ছিল? সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ২১-২৫ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের বর্ধিত সভায় রাজনীতির রূপরেখা গৃহীত হয় এ ভাষায়: "আমরা লড়ছি শ্রেণিসংগ্রাম ত্বরান্বিত করে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য"। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের বর্ধিত সভায় এ প্রস্তাবের কোন বিরোধিতা বা বিকল্প প্রস্তাব হাজির করা হয়নি। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বক্তব্যে যাদের সমর্থন ছিল না, তারা প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করতে না পারলেও মে মাসে ডাকসু নির্বাচন কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতির নেতৃত্বে তারা পৃথক ছাত্রলীগ গঠন করেন ও মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার ডাক দেন।

২১-২৩ জুলাই ১৯৭২ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার পল্টন ময়দানে। একই সময়ে ছাত্রলীগের সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশ মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আরেকটি সম্মেলন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ছাত্রলীগের উভয় অংশের সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানানো হয়। সম্মেলনের দুদিন আগেও বঙ্গভবনে গিয়ে ছাত্রলীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর আগমন নিশ্চিত করার জন্য সর্বজনাব আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, শরীফ নুরুল আম্বিয়া প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মেলনেই যান, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গতিপথ অনেকখানি নির্ধারণ করে দেয়।

৫.

ছাত্রলীগ বিভক্তির ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়। জাসদের জন্মকালীন ঘোষণাতে ছাত্রলীগে গৃহীত রাজনীতির রূপরেখাই লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়। ঘোষণাতে বলা হয়: "শ্রেণিদ্বন্দ্ব অবসানের জন্য শ্রেণিসংগ্রাম তীব্রতর করে সামাজিক বিপ্লব ত্বরান্বিত করার জন্য… জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক জনযুদ্ধ ঘোষণা করছে।" "বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শ্রেণিহীন-শোষণহীন সমাজ ও কৃষক-শ্রমিকরাজ কায়েম।" ইত্যাদি।

৬.

১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও জাতীয় রক্ষীবাহিনীর নিপীড়নের প্রতিবাদে তদানীস্তন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব মনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাও করা হয়, যার পরিসমাপ্তি ঘটে রক্তাক্তভাবে। অন্তত ৫০ জন নিহত হন রক্ষী বাহিনীর গুলিতে, গ্রেপ্তার হন জাসদ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ অনেক শীর্ষ নেতা। সারা দেশে রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে ৬ মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়, জ্বালিয়ে দেওয়া হয় জাসদ, ছাত্রলীগ (বৈ. স.), দৈনিক গণকণ্ঠ কার্যালয়সমূহ।

৭.

জাসদ রাজনীতিকে আদর্শগত নির্দেশনা দেওয়ার প্রয়োজনে ৩২ শীর্ষ নেতা (যাদের অপ্রকাশিত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি 'সিওসি'র সদস্য বলা হত) প্রণীত খসড়া থিসিসে (এ দলিলের প্রকাশক ও প্রকাশনার তারিখ উল্লেখ ছিল না) বাংলাদেশকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক বলা হয়। ১৯৭৪ সালের মার্চে প্রকাশিত সাম্যবাদ পত্রিকাতে বিপ্লবের রূপ গণঅভ্যুত্থানমূলক বলে উল্লেখ করা হয়। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারীতে প্রকাশিত লড়াই পত্রিকাতে বিপ্লবী গণবাহিনীর পরিচিতি ও কর্মতৎপরতার বিবরণ ছাপা হয়।

৮.

পরিমার্জিত খসড়া থিসিসে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর– এ মূল্যায়ন ঠিক রেখে অসম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ও জাতীয় করণীয় সমাপ্ত করতে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠনএবং তা অর্জন করতে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। বাংলাদেশের পুঁজিবাদ অনুন্নত পুঁজিবাদ বলে পুনর্মূল্যায়ন করা হয়।

৯.

১৯৮০ সালে জাসদ থেকে আলাদা হয়ে বাসদ গঠিত হয়। ১৯৮৫ সালে জাসদ বিভক্ত হয়ে জাসদ (মীর্জা-সিরাজ-ইনু) ও জাসদ (রব) গঠিত হয়। ১৯৮৬ সালে জাসদ (সিরাজ-ইনু) আবার বিভক্ত হয়ে জাসদ (আরেফ-ইনু) ও জাসদ (সিরাজ) গঠিত হয়। জাসদ (সিরাজ) বিলুপ্ত হয়ে একাংশ বিএনপি, একাংশ আওয়ামী লীগ, অবশিষ্টাংশ গণফোরামে যোগদান করে।

১০.

১৯৮০ সালে সমন্বয় কমিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধেঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের তাত্ত্বিক যুক্তি তুলে ধরা হয়, যা জাসদকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে ঐক্যের রাজনীতিতে সামিল করে। এ তাত্ত্বিক যুক্তি ধারণ করে ৯ বছর ব্যাপী এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী সংগ্রামে জাসদ ও সহযোগী সংগঠনসমূহ আপোষহীন সংগ্রাম গড়ে তোলে। কিন্তু জনাব আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে জাসদের একটি অংশ পৃথক জাসদ গঠন করেন এবং তাঁরা এরশাদের সামরিক শাসনের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে ১৯৮৮-৯০ এর সংসদে সরকার অনুগত বিরোধী দলের ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাঁরা সমন্বয় কমিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ উপেক্ষা করেন ও শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবীদের ঐক্যবদ্ধ করে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার রাজনৈতিক তত্ত্ব প্রচার করেন। সর্বজনাব মীর্জা সুলতান রাজা, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাসদ সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে প্রথমে ১৫ দল ও পরে ৫ দলের মাধ্যমে অংশ নেন।

১১.

এরশাদ পতনের আন্দোলনে সমন্বয় কমিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ কাজে লাগে, কিন্তু আন্দোলনের সফলতার পরে সংসদীয় রাজনীতিতে তা সফলতার পথ দেখাতে পারেনি। মতান্তরে সংসদীয় রাজনীতিতে সমন্বয় কমিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুসরণ করা হয়নি, তাই সফলতা আসেনি।সংসদীয় নির্বাচনে ব্যর্থতার পটভূমিতে জাসদ (আরেফ-ইনু) ১৯৯২ সালে গণতন্ত্রের ছয় শত্রু চিহ্নিত করে এবং সংগঠনের প্রতিনিধিদের ভোটের মাধ্যমে ৯ নেতার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এতেও সংগঠনে গতি আসেনি। সংগঠনের বিকাশে পুরনো তাত্ত্বিক যুক্তিও আর কাজে আসেনি। সেসময় জাসদ (আরেফ-ইনু) বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

১২.

জাসদ (আরেফ-ইনু) আন্দোলনে জয়ী হলেও সংসদে একটি আসনও না পাওয়ায় হতাশায় নিমজ্জিত হয়। এরশাদ পতনের পর জাসদ (রব) একঘরে হয়ে পড়লেও ১৯৯৬এর নির্বাচনে জনাব আ স ম আবদুর রব সংসদে জয়লাভ করার পরে আবার পাদপ্রদীপের আলোয় ফিরে আসেন। দীর্ঘ ২১ বছর পরে আওয়ামী লীগ কর্তৃক সরকার গঠনে জাসদ (রব)-এর একটি আসনের সমর্থন ছিল নির্ধারক। আওয়ামী লীগের সরকারে তিনি মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। তারপরের বছর ১৯৯৭ সালে জাসদ (আরেফ-ইনু), জাসদ (রব), বাসদের একাংশ (বাদল) একীভূত হয়ে জাসদ ঐক্যবদ্ধ ও পুনর্গঠিত হয়। জাসদ বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়।

পুনর্গঠিত জাসদ ১৯৮০ সালে প্রণীত সমন্বয় কমিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ধারাবাহিকতা ছিন্ন করে মূলত জাসদ (রব)-এর শ্রমজীবী-পেশাজীবী-কর্মজীবী কেন্দ্রিক তাত্ত্বিক যুক্তিগুলো কেন্দ্র করে নতুন ঘোষণাপত্র রচনা করে। তত্ত্বগতভাবে জাসদ এখান থেকেই একটা নতুন জায়গাতে এসে দাঁড়ায়। জাসদ তার রাজনৈতিক লক্ষ্যহিসেবে সমাজতন্ত্রে স্থির আছে কি না– সে বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে। এগুলোর সুস্পষ্ট জবাব দিতে হলে জাসদ নেতৃত্বকে ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে একটা তাত্ত্বিক অবস্থান রচনা করতে হবে।

ইতোমধ্যে ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত জাসদ তিন ভাগে বিভক্ত হয়েছে। কিন্তু ১৯৭২ সালে প্রণীত জাসদের রাজনৈতিক নীতি-কৌশলের ধারাবাহিকতা দ্বারা বর্তমান পর্যায়ের রাজনৈতিক নীতি-কৌশলের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার এখনও সুরাহা হয়নি। সে কাজটি শুরু করতে হবে পেছনে ফেলে আসা সমন্বয় কমিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আধুনিক ও হালনাগাদ করেই। তাহলে তা জাসদ রাজনীতির তাত্ত্বিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে; অর্থাৎ খসড়া থিসিস (১৯৭৪)– পরিমার্জিত থিসিস (১৯৭৬) – সমন্বয় কমিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (১৯৮০) – প্রস্তাবিত তাত্ত্বিক দলিল (২০১৬-১৭)।

১৩.

অতীতে জাসদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধারা সঠিক না বেঠিক তা মূল্যায়ন করতে হলে লক্ষ্য হিসেবে ১৯৭২এ ঘেষিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র সঠিক না বেঠিক সে প্রশ্নের ফয়সালা করাটা সামনে চলে আসে। আবার বর্তমান যুগে সমাজতন্ত্রের রূপ, সমাজতন্ত্র অর্জনের জন্য কোন পথে সংগঠন-আন্দোলন গড়তে হবে– সেটা নিয়েও একাধিক মত রয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য হিসেবে সমাজতন্ত্র তথা সাম্যবাদে স্থির থাকবো, না প্রচলিত রাজনীতির ধারায় সমর্পিত হয়ে সমাজতন্ত্র তথা সাম্যবাদের লক্ষ্য বর্জন করব– এ প্রশ্নটিও কেউ তুলছেন।

তবে এ ধরনের প্রশ্ন জাসদেই শুধু সীমাবদ্ধ নেই। কমবেশি অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দলে ছিল এবং আছে। কেউ কেউ সমাজতান্ত্রিক/সাম্যবাদী দলের পরিচয় মুছে ফেলে নতুন (বুর্জোয়া) গণতান্ত্রিক দল গঠন করে বা যোগ দিয়ে রাজনৈতিক সাফল্য লাভের চেষ্টা করেছেন। বলা যায়, দলগতভাবে সে সব দল এখন পর্যন্ত সফল হতে পারেনি, বরঞ্চ ছেড়ে আসা সমাজতান্ত্রিক/কমিউনিস্ট দলের চাইতে তাদের অবস্থা আরও করুণ হয়েছে। কিন্তু যারা ব্যক্তিগতভাবে বড় বুর্জোয়া দলে যোগ দিয়েছেন, তারা কেউ কেউ এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন।

১৪.

১৯৭২ সালে জাসদ কি গতানুগতিক রাজনৈতিক দল হিসেবে জন্ম নিয়েছিল? নিশ্চয়ই না। ব্রিটিশ-পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র-সমাজ কাঠামো বদলে স্বাধীন দেশের উপযোগী ব্যবস্থা ও কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে জাসদ যাত্রা শুরু করেছিল। বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে ১৯৭২ সালের ৭ জুন সে লক্ষ্যেই কর্মসূচিই দিয়েছিলেন জাসদের জন্মদাতা তৎকালীন ছাত্র-শ্রমিক নেতৃবৃন্দ। একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শ ধারণ করেই জাসদ যাত্রা শুরু করে যা দেশের সবচাইতে উদীয়মান ও সংগ্রামী শ্রেণি-গোষ্ঠীকে আকর্ষিত করে। জাসদের আন্দোলন-সংগ্রামের ধরন-ধারণ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্য সঠিক ছিল কি না– সেটিই হল বিবেচ্য বিষয়। সে গৌরবান্বিত জাসদকে আদর্শহীন, রাজনৈতিক লক্ষ্যবিহীন দলে কিংবা অন্য কারো গোপন ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত লক্ষ্য বাস্তবায়নের উপ-ঠিকাদার দলে পরিণত করা যাবে না।

১৫.

প্রতিষ্ঠালগ্নে জাসদের প্রতিষ্ঠাতা নেতৃত্ব দর্শন হিসেবে মার্কসবাদ প্রয়োগ করেছেন বা চেষ্টা করেছেন। সেটি আজ অব্যাহত আছে কি না– সে প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মার্কসবাদী পদ্ধতি প্রয়োগ ছাড়া কোনো সমাজতান্ত্রিক দল পরিচালিত হতে পারে না। কিন্তু আজও মার্কসবাদেরদ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ সমাজ-অর্থনীতি-চিন্তা-প্রকৃতিজগৎ ব্যাখ্যার মূল ও কার্যকর পদ্ধতি। তবে মার্কসবাদ ধর্মের মতো বিবেচনা করলে হবে না।

নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে মার্কসবাদেরও বিকাশ ঘটেছে। যেমন লেনিনের হাত ধরে বস্তুর সংজ্ঞার নবায়ন/হালনাগাদ হয়েছে। জীবদ্দশায় কার্ল মার্কস যা লিখেছেন মার্কসবাদ সেখানে সীমাবদ্ধ নয়। এটি ক্রমবিকাশমান ও যুগোপযোগী জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে হালনাগাদযোগ্য। মার্কস ছাড়াও মার্কস পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত অনেক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক জ্ঞানের বিশ্বভাণ্ডারে নতুন নতুন আবিষ্কার ও তত্ত্ব সংযুক্ত করেছেন। সেগুলোও সমাজতন্ত্রীদের অধ্যয়ন ও বিবেচনায় নিতে হবে।

১৬.

কেউ কেউ এ মত প্রকাশ করছেন যে, "সাম্যবাদ হচ্ছে চূড়ান্ত লক্ষ্য, সমাজতন্ত্র নয়; পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে যাবার পথে আলাদা করে সমাজতান্ত্রিক স্তর পার হবার দরকার নেই।" তত্ত্বগতভাবে এটা নিয়ে বিশদ আলোচনার অবকাশ আছে। কিন্তু এ কথার রাজনৈতিক সরল অনুসিদ্ধান্ত হতে পারে ক্ষতিকর। এতে প্রচ্ছন্নভাবে পুঁজিবাদের বর্তমান ধারা মেনে নেওয়ার আবহাওয়া তৈরি হয়। সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের রাজনীতি আধুনিক ও হালনাগাদ করার নামে সেটা বর্তমান চেহারার পুঁজিবাদ টিকিয়ে রাখার রাজনীতিতে বিলীন হয়ে যাবার আশংকা তৈরি হয়ে যায়। শ্রেণিসংগ্রাম ও বিপ্লবের ধরন-ধারণ নিয়ে আলোচনা হতে পারে, সমাজতন্ত্র-বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের রূপ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু চূড়ান্ত লক্ষ্য ঐতিহাসিক বস্তুবাদের পথে সমাজ বিকাশের ধারায় সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা নিয়ে অস্পষ্টতা থাকা উচিত নয়।

১৭.

সমাজতন্ত্র মানে সেভিয়েত মডেলে রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা, অর্থনৈতিক নীতি-কৌশল গ্রহণ করাই আমরা বুঝেছি, যেটা চীন পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। চীন তাদের মতো করে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে, চীন এখনও পর্যন্ত নিজেকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে দাবি করেনি। তারা বলছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছে।

১৮.

লেনিনের রাষ্ট্রবিষয়ক তত্ত্বের কোনো কোনো বিষয় যেমন পুনর্মূল্যায়ন দরকার, তেমনি একই কথা স্ট্যালিন, ট্রটস্কি, মাও'র বেলায়ও খাটে।

১৯.

চূড়ান্ত সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য বলতে সাম্যবাদ বোঝানো যেতে পারে। শ্রেণিহীন সমাজ গঠন হচ্ছে সাম্যবাদের প্রধান দিক। সমাজতন্ত্র তথা সাম্যবাদের লক্ষ্যে সব ধরনের বৈষম্য ও অসমতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাটাই প্রধান করণীয়। সে সংগ্রামটা হচ্ছে শ্রেণি বৈষম্যের বিরুদ্ধে, নারী-পুরুষ বৈষম্যের বিরুদ্ধে, জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে, আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে, পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে।

সমাজের সবচাইতে নিপীড়িত অথচ সংঘবদ্ধ অংশ সামাজিক শ্রেণি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবে, নারী-পুরুষ বৈষম্যের বিরুদ্ধে নারী সমাজ নেতৃত্ব দেবে, জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিপীড়িত জাতি নেতৃত্ব দেবে, আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বঞ্চিত অঞ্চল নেতৃত্ব দেবে, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার সংগ্রামে প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী নেতৃত্ব দেবে। প্রধান শত্রু হবে সমাজের শোষক শ্রেণির মধ্যে সবচাইতে ক্ষমতাবান ও সংঘবদ্ধ শ্রেণি, পুরুষদের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিকতার সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষক ক্ষমতাবান ধারক-বাহক গোষ্ঠী, শোষক জাতির ক্ষমতাবান গোষ্ঠী, আঞ্চলিক শোষণের সুফলভোগী ক্ষমতাবান গোষ্ঠী, প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের মহোৎসবকারী ক্ষমতাবান গোষ্ঠী প্রভৃতি। প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে বাকি সব শ্রেণি ও গোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দানকারী শ্রেণি ও গোষ্ঠীর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ করাটাই সমাজ পরিবর্তনকারী রাজনৈতিক দলের মূল কাজ।

২০.

সংগ্রামের পাশাপাশি সমন্বয়ের কথাটিও এসে যায়। সংগ্রাম ও সমন্বয় মিলিয়েই রাজনৈতিক কার্যক্রমের ধরন বেছে নিতে হবে। সংগ্রাম চলবে, আবার সংগ্রামের ফলাফল কাঠামোবদ্ধ করার জন্য সংগ্রামীদের নতুন কাঠামো গড়ার কাজ করে যেতে হবে। অবস্থিত কাঠামোর পুরাতন হয়ে যাওয়া জীর্ণ কাঠামো বাতিল করে সংগ্রামের কাঠামো প্রতিস্থাপন, গ্রহণযোগ্য অবস্থিত কাঠামোর সঙ্গে সংগ্রামের কাঠামোর সমন্বয় (উদাহরণ: ঐক্যের রাজনীতি ও ঐক্যবদ্ধ সরকার গঠন), আবার পরমুহূর্ত থেকে সমাজ প্রগতির নতুন চাহিদা অনুযায়ী নতুন কাঠামো গড়ার সংগ্রাম শুরু হবে। তবে সংগ্রামের মাত্রা যেমন সব সময় এক রকম থাকবে না, তেমনি সমন্বয়ের মাত্রাও সবসময় এক রকম থাকবে না। সমাজ পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক দলকে তা বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে।

২১.

সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে বিপ্লবের প্রসঙ্গটি অবধারিতভাবেই এসে যায়। ধারাবাহিক সংগ্রামের এক নির্ধারক পর্যায়ে যখন নিপীড়িত শ্রেণি-গোষ্ঠী শোষক শ্রেণি-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অন্যান্য সব শ্রেণি-গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়, তখন গণরায় ও যুক্তির কাছে হেরে গিয়ে শোষক শ্রেণি-গোষ্ঠী শক্তি প্রয়োগ করে নিপীড়িত জনতার জয় ঠেকাতে চায়। তার বিরুদ্ধে প্রয়োজন হয় শোষক বাদে সব শ্রেণি-গোষ্ঠীর মিলিত গণজাগরণ-গণঅভ্যুত্থান, যার পরিণতিতে নতুন শ্রেণি-গোষ্ঠী ক্ষমতাসীন হয়, সেটাই হল বিপ্লব।

২২.

বিপ্লব তথা দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তনের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক দল অবশ্যই প্রয়োজন। সেটিই বিপ্লবী পার্টি বলে লেনিন অভিহিত করেছেন। এর নাম কমিউনিস্ট পার্টি হতে পারে, ওয়ার্কার্স পার্টি, পপুলার পার্টি, সমাজতান্ত্রিক দলও (নামটা জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও গ্রহণযোগ্যতা অনুযায়ী হতে পারে) হতে পারে। বিপ্লবী পার্টি গড়ার জন্য বিশ শতকের প্রথমার্ধে লেনিন যা করেছিলেন রাশিয়াতে, বাংলাদেশে তা অনুকরণের চেষ্টা করা হয়েছে, সফলতা আসেনি। চীনে মাও জে দং যা করেছেন, বাংলাদেশে তাও চেষ্টা করা হয়েছে। ফলাফল একই। ১৯৭২-৭৫ সালে জাসদের জনপ্রিয়তার অন্যতম তাত্ত্বিক কারণ ছিল: জাসদ কোনো বিশেষ দেশের পন্থী ছিল না। একটি দেশে অন্য কোনো দেশের পন্থী রাজনীতি গ্রহণযোগ্য নয়।

২৩.

অভিজ্ঞতা নিতে হবে সফলতার, সে সফলতা যত সাময়িকই হোক না কেন! স্বাধীনতার পূর্বাপর সময়ে জাসদসহ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী যেসব দল যতটুকু সময়ে সফলতার সঙ্গে আন্দোলন-সংগঠন পরিচালনা করেছেন, তাদের সফলতার অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যৎ বিপ্লবী সংগঠন গড়ার উপাদান ও সূত্র বর্তমান সময়ের উপযোগী করে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।

২৪.

বিপ্লবের মাধ্যমেই চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে। সে বিপ্লব কি ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বরের রুশ বিপ্লবের পুনরাবৃত্তি হবে? ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবরের চীন বিপ্লবের মতো হবে? ১৯৫৮ সালের ১ জানুয়ারির কিউবা বিপ্লবের মতো? ইতিহাস বলে কোনো ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে না। আমাদের বাংলাদেশের সফল বিপ্লব (বা বিপ্লবী প্রচেষ্টা), গণঅভ্যুত্থানের উদাহরণ থেকে ভবিষ্যৎ বিপ্লবের রূপ ও করণীয় খুঁজতে হবে।

২৫.

বর্তমান যুগে বিপ্লব শান্তিপূর্ণও হতে পারে। বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণঅভ্যুত্থানের কাছে নতি স্বীকার করে স্বৈরশাসক এরশাদের বিদায় শান্তিপূর্ণ গণবিপ্লবের এক উদাহরণ। ২০০৮ নেপালে সমাজতন্ত্রী দলের দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে সব গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দলের সম্মিলিত নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ গণঅভ্যুত্থানের পরিণতিতে রক্তপাতহীনভাবে রাজতন্ত্রের বিলোপ ঘটে, 'আরব বসন্ত'-এর ঝাপটায় ২০১১ থেকে ধারাবাহিকভাবে তিউনিসিয়া, মিসর দীর্ঘস্থায়ী স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়েছে রক্তপাত ছাড়াই।

২৬.

ষাট-সত্তর-আশির দশকজুড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিপ্লবী আন্দোলন ও সশস্ত্র সংগ্রামের ঢেউ উঠেছিল। কোন কোন দেশে বিপ্লব ও মুক্তিযুদ্ধ সফল হয়েছিল? বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, মোজাম্বিক, এঙ্গোলা, নিকারাগুয়াতে সশস্ত্র সংগ্রাম জয়ী হয়ে কোথাও জাতীয় স্বাধীনতা ও কোথাও সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেসব দেশে সশস্ত্র লড়াই হয়েছিল, অথচ যুদ্ধের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ জয় পাওয়া যায়নি, তাদের অনেক দেশে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পথে রাজনৈতিক বিজয় (যেমন: দক্ষিণ আফ্রিকা, পূর্ব তিমুর, নেপাল) অর্জিত হয়েছে; আবার অন্য দেশে আলোচনার মাধ্যমে সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন ও ব্যক্তি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতে অংশ নিয়েছেন (যেমন: স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ, এল সালভাদর, গুয়াতেমালা, চিলি, শ্রীলঙ্কা, সর্বশেষ কলোম্বিয়া)। কোনো কোনো বিপ্লবী দল ও নেতা শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জয়লাভ করে সরকার গঠন করেছেন। সব দেশেই একভাবে বিপ্লবী সংগ্রাম সফল হয়নি। বিপ্লবী আন্দোলনে যারা সফল হয়েছেন, তাদের প্রতিটি দেশই নিজস্ব ধারায় এগিয়েছে।

২৭.

আরেকটি জরুরি প্রশ্ন। এখনকার বিশ্ব পরিস্থিতিতে গণঅভ্যুত্থান হলেই কি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল পরিবর্তন ঘটবে? সমাজতান্ত্রিক শক্তি তথা প্রগতিশীল শক্তি জনগণের চেতনার রাজনৈতিক রূপ অনুধাবন না করেই যদি অন্য কোনো শক্তির রাজনীতি-সংস্কৃতির জমিনে দাঁড়িয়ে গণঅভ্যুত্থান উৎসাহিত করেন বা উস্কে দেন, তাহলে কি গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল পরিবর্তন ঘটবে? ১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লব, ২০১১ সাল থেকে চলে আসা 'আরব বসন্ত' নামের আরব বিপ্লব কী ধরনের অভিজ্ঞতা দিয়েছে আমাদের?

বিশ্ব পরিস্থিতিতে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অনুপস্থিতির কারণে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণেও গণঅভ্যুত্থানের সফলতা বা সফল হবার পরে তাকে টিকিয়ে রাখার কাজটি অনেক জটিল হয়ে পড়েছে। বিশ্ব রাজনীতির সমীকরণ নিজের পক্ষে না এনে সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। জনগণকে আদর্শগতভাবে সজ্জিত না করে শুধুমাত্র বিদ্রোহ, গণঅভ্যুত্থানের ডাক দিলেই তা প্রগতিশীল পরিবর্তন নিয়ে আসবে না। উদাহরণ: ইরানের ইসলামী বিপ্লব, আরব বসন্ত। সে বিবেচনায় বাংলাদেশে এ মুহূর্তের রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ছাড়া যে কোনো ধরনের গণঅভ্যুত্থান উৎসাহ দেওয়া বা উস্কে দেওয়া উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে। ক্ষমতাসীনদের সীমিত গণতন্ত্রের শাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পন্থাই এ মুহূর্তে গ্রহণযোগ্য। বিষয়টি আরও বিশদ আলোচনার দাবি রাখে।

২৮.

জাসদ নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে দীর্ঘ সময়ের সংগ্রামের বিশেষ করে জন্ম লগ্নের সংগ্রামী ঐতিহ্য। জাসদের আদর্শ ও চূড়ান্ত লক্ষ্য স্থির থাকতে হবে। 'যখন যেমন তখন তেমন' এ ধরনের আদর্শ ও লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল সংগঠিত ও বিকশিত হতে পারে না। তবে কর্মকৌশলে হতে হবে সর্বোচ্চ নমনীয়।

২৯.

বর্তমান সময়ে জাসদসহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দল ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে সঠিক ও কার্যকর কর্মকৌশল ও তার তাত্ত্বিক যুক্তি সন্ধানে ব্যস্ত। এ জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ। দলের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মতের পার্থক্য ও ঐক্যের দিকগুলো চিহ্নিত করে বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ করে নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। মতাদর্শগত সংগ্রামের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিকতা ও দলীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কেন্দ্রীকতা থাকতে হবে।

৩০.

দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈষম্য-অবিচার-সীমিত গণতন্ত্র-দুর্নীতি-লুটপাটের বিপরীতে শান্তি-উন্নয়ন-সমতা-ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার করতে হবে। ১৪ দলের ভেতর থেকেই হোক বা বাইরে থেকে হোক, ক্ষমতাসীনদের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার রাজনীতি উপস্থাপন করতে হবে। ১৪ দলের ভেতরে থাকলে দ্বন্দ্ব-সমন্বয় উভয়ভাবেই সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকতে হবে। আর ১৪ দলের বাইরে থাকলে ক্ষমতাসীনদের বিকল্প সরকার গঠনের রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে কর্মসূচি-সংগঠন-আন্দোলন জারি রাখতে হবে।

৩১.

পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে সোভিয়েত নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক শিবির থাকা অবস্থায় যে নীতিতে সমাজতান্ত্রিক দল পরিচালিত হত, এখন কি একই নীতি অনুসরণ করা উচিত? নাকি প্রধানত দ্বিপাক্ষিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে তা পরিচালিত হবে? তবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নিপীড়িত জাতির মুক্তি আন্দোলন, কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব লংঘন না করা ইত্যাদি প্রশ্ন দ্বিপাক্ষিক নয়, বহুপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক। সে সব বিষয়ে আন্তর্জাতিক কর্তব্য পালন তথা ভিন্ন দেশের সংগ্রামীদের সঙ্গে একাত্মতার প্রশ্নটি সামনে এসে যায়। রাশিয়াতে ১৯৯১ সালে পুঁজিবাদের প্রত্যাবর্তনের পরে তাকে আমরা কোন কাতারে ফেলব? অর্থনৈতিক শক্তির ক্ষেত্রে ক্রমশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা চীনকে আমরা কোন ধরনের রাষ্ট্র বলে অভিহিত করব? এসব প্রশ্নও গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল আন্দোলনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৩২.

বর্তমান রাজনীতির সঙ্গে অতীতের মেলবন্ধন করতে হলে জাসদকে অতীতের ধারাবাহিকতার পথ ধরেই তা করতে হবে। অতীত অস্বীকার করলে কর্মী ও জনগণের আস্থা থাকবে না। জাসদের চলার পথে সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে জীবন দিয়েছেন শত শত কর্মী ও নেতা। শহীদদের প্রতি মর্যাদাপূর্ণ শ্রদ্ধা, অতীত সংগ্রামে শ্রদ্ধা জানাতে আমাদের কার্পণ্য করলে চলবে না। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে অতীত যতই ভিন্ন মনে হোক, অতীত সংগ্রামকে ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে। শহীদ সাথীরা আমাদের রাজনৈতিক পরিচয় তৈরি করে দিয়ে গেছেন, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ভিত্তি রচনা করে গেছেন। জাসদের জন্মের ৪৪তম বার্ষিকীতে শহীদদের আত্মদানের গৌরব মাথায় তুলে ধরে ভবিষ্যতের রাস্তা তৈরি করতে হবে।

২৮ অক্টোবর ২০১৬