কারখানা বন্ধ করে পুঁজিবাজার ছাড়তে চায় বেক্সিমকো সিনথেটিকস

লোকসানে ডুবে যাওয়া বেক্সিমকো সিনথেটিকস লিমিটেড কারখানা বন্ধ করে দিয়ে পুঁজিবাজার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আবেদন করার পর এ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Sept 2020, 09:22 AM
Updated : 10 Sept 2020, 01:33 PM

ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার জানিয়েছে, বিনিয়োগকারীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেজন্যই বাংলাদেশ সিকিউরটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বেক্সিমকো সিনথেটিকসের শেয়ার লেনদেন স্থগিত রাখার এই সিদ্ধান্ত দিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেক্সিমকো সিনথেটিকসের ডিলিস্টিংয়ের খবরে অস্বাভাবিক কম দামে কেউ যাতে এ শেয়ার কিনে নিতে না পারে এবং বিনিয়োগকারীরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্যই আমরা লেনদেন স্থগিত করেছি।”

দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানি বেক্সিমকো সিনথেটিকস ১৯৯০ সালে যাত্রা শুরুর পর পলিয়েস্টার সুতা উৎপাদন শুরু করে। ১৯৯৩ সালে তারা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) এবং ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়।

এ কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল এফ রহমান। আর প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এ কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান।

মঙ্গলবার বেক্সিমকো সিনথেটিকসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৯৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তারা নিয়মিত লভ্যাংশ ঘোষণা করে এলেও এরপর কোম্পানি ‘কঠিন পরিস্থিতিতে’ পড়ে।

সরকার আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেওয়ায় বিদেশ থেকে সস্তা পলিয়েস্টার সুতা আসতে থাকে এবং প্রতিযোগিতায় পেরে না ওঠায় ক্ষতির মুখে পড়ে বেক্সিমকো সিনথেটিকসের ব্যবসা।

ফলে গত সাত বছরে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি পুঁজিবাজারে তালিতাভুক্ত এ কোম্পানি। গত কয়েক বছর ধরে বাজারে এ শেয়ার লেনদেন হচ্ছে ফেইস ভ্যালুর নিচে। 

এই পরিস্থিতিতে বেক্সিমকো সিনথেটিকস শেষ পর্যন্ত উৎপাদন ও কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। সকল কর্মী ও অধিকাংশ কর্মকর্তাকে আইন অনুযায়ী তাদের ‘পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার’ কথাও বলা হয়েছে বিবৃতিতে।

সেখানে বলা হয়, “এটা খুবই দুঃখজনক, কিন্তু আর কোনো উপায় ছিল না। পরিচালনা পর্ষদ মনে করেছে, ডিএসই ও সিএসইর তালিকা থেকে এখন বেরিয়ে যাওয়া উচিৎ কোম্পানির। কিন্তু এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো নিয়ম যেহেতু নেই, কোম্পানির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কাছে দিক নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।”

বেক্সিমকো সিনথেটিকসের বর্তমান বজার মূলধন ৭৩ কোটি টাকা, আর পরিশোধিত মূলধন ৮৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা; রিজার্ভের পরিমাণ ৩৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।

ডিএসইর ওয়েবসাইটের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কোম্পানিটির স্বপ্লমেয়াদে ১৫ কোটি এবং দীর্ঘমেয়াদে ২৮ কোটি টাকার ওপর ঋণ রয়েছে। ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য ছিল ১৪ টাকা ১৩ পয়সা।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে এই প্রথম কোনো নিবন্ধিত কোম্পানি স্বেচ্ছায় তালিকা থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে জানিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) উপ-মহাব্যবস্থাপক শফিকুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এর আগে ডিএসই কয়েকটি কোম্পানিকে তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। কিন্তু স্বেচ্ছায় ডিলিস্ট হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম।”

বিনিয়োগকারীদের কী হবে?

পুঁজিবাজারে এ কোম্পানির ৮ কোটি ৬৭ লাখ ১২ হাজার ৩৫৯টি শেয়ারের মধ্যে ৪৬ দশমিক ৩৮ শতাংশই রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।

এছাড়া ৩৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ শেয়ার পরিচালকদের হাতে, ১৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ শেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে এবং দশমিক শূন্য ২ শতাংশ শেয়ার বিদেশিদের হাতে আছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পারচালক শাকিল রিজভী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পরে একটি কোম্পানি দুইভাবে তালিকা থেকে বের হতে পারে। উপযুক্ত কারণ থাকলে স্টক এক্সচেঞ্জ ওই কোম্পানিকে তালিকা থেকে বের করে দিতে পারে। আবার কোনো কোম্পানি স্বেচ্ছায় তালিকা থেকে নাম কাটিয়ে বাজার থেকে বেরিয়ে যেতে পারে।

“যখন স্টক এক্সচেঞ্জ কোনো কোম্পানিকে তালিকা থেকে বের করে দেয়, তখন স্টক এক্সচেঞ্জের দায়িত্ব থাকে কোম্পানির সম্পদ বিক্রি করে শেয়ার হোল্ডারদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়া। আর যখন কোনো কোম্পানি স্বেচ্ছায় তালিকা থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, তখন ওই কোম্পানিকেই শেয়ার হোল্ডারদের টাকা বুঝিয়ে দিতে হয়।”

বেক্সিমকো সিনথেটিকস যেহেতু স্বেচ্ছায় পুঁজিবাজার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আবেদন করেছে, এখন নিয়ম অনুযায়ী তারাই শেয়ার হোল্ডারদের টাকা বুঝিয়ে দেবে বলে শাকিল রিজভী জানান।

বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, কোনো কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে সেই আবেদন করতে হয় স্টক এক্সচেঞ্জে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে আবেদন করার কোনো সুযোগ নেই।   

“স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে বিষয়টি আমাদের কাছে এলে আমরা কর্মপরিকল্পনা তৈরি করব, ভেবে দেখব কীভাবে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা যায় এবং সেভাবেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

শেষ দিকে অস্বাভাবিক লেনদেন

ধারাবাহিক লোকসানে থাকা বেক্সিমকো সিনথেটিকস লিমিটেড ২০১২ সালের পর বিনিয়োগকারীদের আর লভ্যাংশ দিতে পারেনি।

২০১৭ সালে এ কোম্পানির লোকসান ছিল ২২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে তা বেড়ে ২৭ কোটি টাকা হয়। পরের বছর লোকসান আরও বেড়ে হয় ২৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।

এই দুর্দশার মধ্যেও গত মে মাসের শেষ থেকে কোনো কারণ ছাড়াই অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে শুরু করে বেক্সিমকো সিনথেটিকসের দাম। এর কারণ জানতে চেয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে নোটিসও দেওয়া হয়।

জবাবে গত ২৩ আগাস্ট বেক্সিমকো সিনথেটিকসের পক্ষ থেকে ডিএসইকে জানানো হয়, শেয়ার দর বৃদ্ধি পাওয়ায় মত অপ্রকাশিত কোনো মূল্য সংবেদিনশীল তথ্য তাদের হাতে নেই।

গত ৩১ মে এ কোম্পানির ১০ টাকা ফেইস ভ্যালুর শেয়ার যেখানে ৩ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে, লেনদেনের শেষ দিন সোমবার তা হাতবদল হয়েছে ৮ টাকা ৪০ পয়সায়।

৩১ মে থেকে গত রোববার পর্যন্ত বেক্সিমকো সিনথেটিকসের ২ লাখ থেকে ৬ লাখের মত শেয়ার প্রতিদিন লেনদেন হতে দেখা গেছে। আর তাদের স্বেচ্ছায় ‘ডিলিস্টিং’ এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা যেদিন এল, তার আগের দিন সোমবার এ কোম্পানির ২১ লাখ হাতবদল হয়েছে।