আড়াইশ কোম্পানির শেয়ার ক্রেতাশূন্য

ব্রিটিশ অ্যামেরিকান ট্যোবাকোর শেয়ার বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় শেয়ারের মধ্যে অন্যতম। শক্ত মৌলভিত্তির এ শেয়ারটি বৃহস্পতিবার ছিল ক্রেতাশূন্য।

রিয়াজুল বাশারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 June 2020, 03:38 PM
Updated : 4 June 2020, 04:53 PM

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লেনদেন শেষ হওয়ার আধা ঘণ্টা আগে দেখা গেল, দিনের সর্বনিম্ন দরে বিক্রির জন্য ১ লাখ ৬৩ হাজার ৩৯৪টি শেয়ার বসানো রয়েছে। কিন্তু কোনো ক্রেতা নেই।

সারাদিনে কোম্পানিটির ২ হাজার ৪৮৯টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে সর্বনিম্ন দরে অর্থাৎ ৯০৭ টাকা ৬০ পয়সা করে।

এদিন ব্যাংক ও আর্থিকখাত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, ওষুধ, প্রকৌশলসহ প্রায় সব খাতেই একই চিত্র দেখা গেছে বহু শক্ত মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারের ক্ষেত্রে। বিক্রেতারা বসে আছে, ক্রেতা নেই।

ডিএসইর ওয়েবসাইটের তথ্যে, দেশের প্রধান এই পুঁজিবাজারের বৃহস্পতিবার লেনদেন হয়েছে ৩১১টি কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড। এরমধ্যে দর বেড়েছে ১১টির, কমেছে ৩৬টির এবং ২৬২টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।

যে ২৬২টি শেয়ারের দর আগের দিনের তুলনায় অপরিবর্তিত রয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই ছিল ক্রেতাশূন্য।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন অবস্থা আগে কখনও দেখা যায়নি, এমনকি ২০১০ সালের বড় ধ্সের সময়েও।

শক্ত মৌলভিত্তিসম্পন্ন শেয়ারেরও ক্রেতাশূন্য হওয়ার পেছনে মহামারীর আতঙ্ক এবং ‘কৃত্রিমভাবে’ শেয়ারের সর্বনিম্ন দর বেঁধে দেওয়াকেই দায়ী করছেন তারা।

এইমস অব বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী ইয়াওয়ার সায়ীদ বিডিনিউজ টোযেন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুরকম প্রভাব হতে পারে। এইরকম একটা সময়ে (মহামারী) শেয়ার কেনাটা প্রায়োরিটি লিস্টে কমই আছে। যার টাকার দরকার সে হয়ত বিক্রি করে কিছু টাকা তুলে নিতে চাইবে।

“এখন নতুন করে বিনিয়োগ করি, সেরকম মানসিকতা বোধহয় এখন মানুষের নাই। থাকার কথাও না, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া অবধি।”

আরেকটি প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, “বাজার খুলেছে। কিন্তু বাজারে একটা মূল্য সীমা দিয়ে রাখা হয়েছে যে, এর কমে কেনা-বেচা করা যাবে না। শেয়ার মূল্যে একটা কৃত্রিম ব্যারিয়ার দেয়া রয়েছে।

“এটা তো হতে পারে না। সে ওই দামে কিনতে রাজি না। সেজন্য মানুষে যাচ্ছে না।”

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে আতঙ্ক আর টানা দরপতনের পর গত ১৯ মার্চ সার্কিট ব্রেকারের নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়।

তাতে বলা হয়, ১৯ মার্চের আগের পাঁচ দিন প্রতিটি কোম্পানির শেয়ারের ক্লোজিং প্রাইসের গড় হবে ওই কোম্পানির শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস। পাঁচদিনের গড় দামের নিচে কোনো শেয়ার লেনদেন হবে না।

যেমন ব্রিটিশ অ্যামেরিকান ট্যোবাকোর প্রতিটি শেয়ারের দর ৯০৭ টাকা ৬০ পয়সার নিচে নামতে পারবে না। একারণেই বিক্রির জন্য অনেকে অপেক্ষা করলেও ক্রেতা নেই বললেই চলে।

দুই মাস বন্ধ থাকার পরে প্রথম লেনদেনে রোববার সূচক বেড়েছিল দেশের দুই পুঁজিবাজারে। পরের চারদিনই কমেছে সূচক। এসময় বিক্রির চাপও বেড়ে যায়।

ডিএসইতে বৃহস্পতিবার ৪২ কোটি ৯৭ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ক্রেতা না থাকাটাই লেনদেন কমে যাওয়ার বড় কারণ হিসেবে দেখছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী মনে করেন, শেয়ারের সর্বনিম্ন দর বেঁধে দেওয়ার কারণেই হয়ত এরকম হচ্ছে। সর্বনিম্ন দর বেঁধে না দিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে লেনদেন হলে হয়ত দর কমে যেত, কিন্তু এত সংখ্যক শেয়ার ক্রেতাশূন্য হতো না। আবার বাজার ঘুরেও দাঁড়াতো।

“তবে মহামারীর মধ্যে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি বাড়িয়ে দিতে পারে সেজন্যই হয়ত সাময়িক সমাধান হিসাবে এটা করা হয়েছে।”

তবে দীর্ঘমেয়াদি এই নিয়ম রাখা ঠিক হবে বলে মনে করেন ডিএসইর সাবেক এই সভাপতি।

তিনি বলেন, “মহামারী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এটা তুলে দেওয়া উচিৎ। কারণ এতে বিনিয়োগকারীরা বাজার আসতে অনুৎসাহিত বোধ করবে। তারা যদি ভাবে যে, এই বাজারে শেয়ার কেনা যায়, বিক্রি করা যায় না, তাহলে সমস্যা।”

রোববার বাজার চালু হওয়ার প্রথমদিন বেশ কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার দর হঠাৎ বেড়ে যায়। কিন্তু বিক্রির চাপে সেগুলোরও বেশিরভাগই দর হারিয়েছে। কোনো কোনো কোম্পানি গত পাঁচ দিন একইদরে লেনদেন শেষ করেছে।   

কীভাবে এর সমাধান- প্রশ্নে ইয়াওয়ার সায়ীদ বলেন, “এই ধরনের ব্যারিয়ার দেওয়াটা কখনোই যুক্তিসঙ্গত না। একটা নির্দিষ্ট সার্কিট ব্রেকার দিয়ে রাখা যেতে পারে যে, একদিনে এর বেশি বাড়বে বা কমবে না। কিন্তু কখনোই এই দামের কমে নামবে না, কোনোদিনও না, এইটা তো হয় না।”

সর্বনিম্ন দর বেঁধে দেয়ার আগে বাজারের সার্কিট ব্রেকার অনুযায়ী ২০০ টাকার নিচে যে কোনো শেয়ার দিনে ১০ শতাংশ বাড়তে বা কমতে পারত।

২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, ১০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং ২০০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত ৫ শতাংশ এবং ৫০০০ টাকার পরে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে বা কমতে পারত।

কিন্তু ১৯ মার্চের আগের পাঁচ দিন প্রতিটি কোম্পানির শেয়ারের ক্লোজিং প্রাইসের গড় হিসাব করে যে সর্বনিম্ন দর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, তাতে কোনো কোম্পানির শেয়ার আগের সার্কিট ব্রেকার অনুযায়ী সর্বোচ্চ বাড়তে পারলেও বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন দরের নিচে নামতে পারবে না।

দর বেঁধে দেওয়ার ক্ষতিকর দিক নিয়েও সতর্ক করলেন ইয়াওয়ার সায়ীদ।

তিনি বলেন, “আর্টিফিসিয়াল ব্যারিয়ার সরিয়ে নিতে হবে। মার্কেট যদি পড়ে, পড়ুক না। তাতে সমস্যা কী?

“এখন এখানে যে বেচাকেনা করতে আসবে, সে তো আর্টিফিসিয়াল ব্যারিয়ার দেখবে। যদি ভাবে, আজ আমি কিনব, কাল ব্যারিয়ার উঠিয়ে দিলে শেয়ার দর যদি পড়ে যায়?”