দুই মিউচুয়াল ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপনা: হাই কোর্টের আদেশ স্থগিতই থাকল

গ্রিন ডেল্টা মিউচুয়াল ফান্ড ও ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার আদালতের দেওয়া স্থিতাবস্থা প্রত্যাহার করেছে আপিল বিভাগ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 March 2020, 04:43 PM
Updated : 12 March 2020, 05:55 PM

বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগ এই আদেশ দেয়। এর ফলে এই দুই মিউচুয়াল ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এলআর গ্লোবালকে রাখতে হাই কোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশটি আর থাকছে না।

তবে এই সংক্রান্ত রুলটি হাই কোর্টে বিচারাধীন থেকে যাচ্ছে। যে রুলে এসইসিসহ অন্য বিবাদীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কোন কর্তৃত্বে এসইসি এই দুই মিউচুয়াল ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপনা থেকে এলআর গ্লোবালকে সরানোর সিদ্ধান্তে অনুমোদন দিয়েছিল?

এলআর গ্লোবালের আইনজীবী ব্যারিস্টার আরিফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এলআর গ্লোবালই ওই দুই মিউচুয়াল ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপক থাকছে বলে তারা আশা করছেন।

বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগে দুটি লিভ টু আপিলের  শুনানি হয়। এর একটি দায়ের করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), অন্যটি ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডসহ ছয় ইউনিট হোল্ডার।  

গত ২৩ ডিসেম্বর গ্রিন ডেল্টা মিউচুয়াল ফান্ড ও ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপনা থেকে এলআর গ্লোবালকে অপসারণের অনুমোদন দেয় বিএসইসি। এই অনুমোদন চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্ট রিট আবেদন করে এলআর গ্লোবাল।

ওই আবেদনের প্রাথমিক শুনানির পর হাই কোর্ট বিবাদীদের কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়ার পাশপাশি এসইসির ওই সিদ্ধান্ত ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে দেয়।

আপিল বিভাগে বিএসইসির পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। ছয় ইউনিট হোল্ডারের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান খান।

এলআর গ্লোবালের আইনজীবী হাবিবুল ইসলাম ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার আরিফুল ইসলাম এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, “এলআর গ্লোবাল একটা কোম্পানির ১০০ টাকার শেয়ার ১২ হাজার ৫০০ টাকায় কিনেছে। …. এখানে (মিউচুয়াল ফান্ডে) লাভের জন্য বিনিয়োগ করেছি। এখন এভাবে বিনিয়োগ করলে আমরা কোথাও যেতে পারব না।”

এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, “স্টে (হাই কোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে) থাকুক।”

তখনও আইনজীবীর ডায়াসে ছিলেন মাহবুবে আলম, শুনানির সুযোগ পাননি এলআর গ্লোবালের আইনজীবীরা।

এ সময় বসা থেকে দাঁড়িয়ে এলআর গ্লোবালের আইনজীবীরা স্থিতাবস্থাও বজায় রাখতে বলেন। তবে শেষ পর্যন্ত আপিল বিভাগ তাদের যুক্তি শোনেননি।

পরে এক প্রশ্নের জবাবে এলআর গ্লোবালের আইনজীবী আরিফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশের বেসরকারি সম্পদ ব্যবস্থাপকদের মধ্যে ‘বেস্ট পারফর্মিং সম্পদ ব্যবস্থাপক’ এলআর গ্লোবাল ২০০৯ সাল থেকে গ্রিন ডেল্টা মিউচুয়াল ফান্ড ও ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপনা করে আসছে।

রিট আবেদনের শুনানিতে এলআর গ্লোবালের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরা হয়।

যার মধ্যে রয়েছে, ইউনিট হোল্ডারদের কোনো রকম সভা করা ছাড়াই গ্রিন ডেল্টা মিউচুয়াল ফান্ড ও ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপনা থেকে এলআর গ্লোবালকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে বিএসইসির সম্মতি সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বিধি-২০০১ এর ৩১(২) বিধি লঙ্ঘিত হয়েছে।

এই অপসারণের আগে কোনো কারণ দর্শানোর নোটিসও দেওয়া হয়নি বা শুনানির সুযোগও দেওয়া হয়নি উল্লেখ করে বলা হয়, এটা না করায় ন্যায়বিচারের চিরায়ত নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছে।

এই যুক্তিও দেখানো হয়, সম্পদ ব্যবস্থাপক হিসেবে এলআর গ্লোবালকে অপসারণে বাংলাদেশ জেনারেল ইন্সুরেন্স কোম্পানি (বিজিআইসি) কোনো সুনির্দিষ্ট আদেশ দেয়নি। তাই আইডিএলসিকে সম্পদ ব্যবস্থাপক করার সিদ্ধান্তে দেওয়া অনুমোদন কর্তৃত্ববহির্ভূত বলে পরিগণিত হতে পারে।

আদালতকে আরও বলা হয়, ‘ট্রাস্ট ডিড’ অনুসারে তখনই আবেদনকারীকে অপসারণ করা যেতে পারে, যখন তার বিরুদ্ধে বিশ্বাস ভঙ্গ ও বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার শর্ত লঙ্ঘনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যাবে। যেহেতু এ রকম কোন অভিযোগ নেই, তাই তাকে অপসারণের অনুমোদন কর্তৃত্ব বহির্ভূত বলে ঘোষণা হতে পারে।

আদালত থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন কয়েকটি ইউনিট হোল্ডারের আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, “আমরা হলাম, ইউনিট হোল্ডার। বিজিআইসি হল ট্রাস্ট্রি। আমরা এলআর গ্লোবালের ব্যবস্থাপনায় থাকা দুইটা মিউচুয়াল ফান্ডে ইনভেস্ট করেছি।

“এলআর গ্লোবাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরে ৫০ কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছে। এর মধ্যে ২৫ কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছে ১০০ টাকার শেয়ার সাড়ে ১২ হাজার টাকায় কিনেছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে বিদ্যমান শেয়ার। বাকি ২৫ কোটি টাকাও ১০০ টাকার শেয়ার সাড়ে ১২ হাজার টাকায় ইনভেস্ট করেছে।

“বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। মিউচুয়াল ফান্ডের টাকা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে ইনভেস্টও করা যায় না। এত উচ্চমূল্যে তো প্রশ্নই আসে না।”

তিনি বলেন, “ব্যালেন্সশিট অনুসারে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর একটা লস মেকিং কোম্পানি। এখানে এত টাকা ইনভেস্ট করার দরকারও নাই। কোনো যুক্তিতেই আসে না।

“এই পরিস্থিতিতে আমরা যারা ইউনিট হোল্ডার তাদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি বিজিআইসির কাছে একটা চিঠি দিলাম যে, ওকে বিমুভ কর। বিজিআইসি এটা এসইসির কাছে মতামতের জন্য পাঠাল। এক পর্যায়ে গত ডিসেম্বরে তাকে অপসারণ করে এসইসি। সেই সিদ্ধান্ত হাই কোর্ট স্থগিত করে দেয়।”

“(আপিল বিভাগের এই আদেশের) ফলে ওই ‍দুই মিউচুয়াল ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপক হিসেবে এলআর গ্লোবাল থাকছে না। সম্পদ ব্যবস্থাপনায় তাদের জায়গায় আসছে আইডিএলসি,” বলেন তিনি।

একটি খ্যাতনামা কোম্পানির ভ্যালুয়েশনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের যে দাম উঠেছে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর বরং তার তার এক-তৃতীয়াংশ দামে শেয়ার বিক্রি করেছে- এই বিষয়টি এক সাংবাদিক তুলে ধরলে এই আইনজীবী বলেন, “আমি আপনার কাছেই এটা প্রথম শুনলাম। আমি এটা সম্পর্কে কিছু জানি না।

“তবে ভ্যালু ৩০০ কোটি থাকুক, আর ৩ হাজার কোটি টাকা থাকুক, একটা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে কোনো মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগ করতে পারে না। এখানে দুইটা দিক আছে, একটা হচ্ছে, ইনফ্ল্যাটেড ভ্যালুতে ইনভেস্ট করা হয়েছে। আরেকটা হচ্ছে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে ইনভেস্ট করা হয়েছে।”

তবে এলআর গ্লোবালের  কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা যায়। এই বিনিয়োগের আগে অন্তত পাঁচটি খ্যাতনামা লিগ্যাল ফার্মের মত নেওয়া হয়েছে।

এই ফার্মের মধ্যে রয়েছে, হাসান অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস, শেখ অ্যান্ড চৌধুরী, তানজীব আলম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস, ভূঁইয়া ইসলাম অ্যান্ড জায়দী।

এলআর গ্লোবালের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের সবার মতামত ছিল, এভাবে বিনিয়োগ করা যায়। এছাড়া বিএসইসির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও পরামর্শ করা হয়েছে।

বেসরকারি বিনিয়োগের আরও উদাহরণ রয়েছে উল্লেখ করে তারা রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের নাম বলেন।

এলআর গ্লোবালের কর্মকর্তারা বলেন, ননলিস্টেড কোম্পানি বা তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক কোম্পানির ক্ষেত্রে ভ্যালুয়েশন বা মূল্যায়নের রীতি-পদ্ধতিই আলাদা।

“এ ধরনের কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন অনেক সময় অনেক কম হতে পারে। যার ফলে মূল্যায়িত দাম অনেক বেশি মনে হতে পারে। যাকে অনেকে ইনফ্লেইটেড বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত এখানে এই ঘটনাই ঘটেছে।”