বিশ্বকাপে নজর থাকবে যে ৫ গোলরক্ষকের দিকে

কাতারে এই গোলরক্ষকদের দেয়াল ভাঙা কঠিন হয়ে উঠতে পারে প্রতিপক্ষের জন্য।

আবু হোসেন পরাগবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Nov 2022, 01:11 PM
Updated : 18 Nov 2022, 01:11 PM

ফুটবল গোলের খেলা। গোলই এখানে শেষ কথা। তাই যারা গোল দেয়, তারাই বেশিরভাগ সময় হয়ে ওঠে সবার চোখের মণি। তবে অনেক সময় গোল না করেও হয়ে ওঠা যায় ম্যাচের নায়ক। সেই কাজটি গোলরক্ষক ছাড়া আর কে ভালো করতে পারে! আবার একটি ভুল করলে সেই গোলরক্ষকই হয়ে ওঠে খলনায়ক। এসব যদি হয় বিশ্ব মঞ্চে?

কাতার বিশ্বকাপে এমন কিছু গোলরক্ষক থাকবেন, যাদের দেয়াল ভাঙা সত্যিই কঠিন হয়ে উঠতে পারে প্রতিপক্ষের জন্য। তেমন পাঁচ জন গোলরক্ষককে নিয়ে এই আয়োজন।

আলিসন, ব্রাজিল

তিতের ব্রাজিল দলে আলিসন এক নম্বর গোলরক্ষক অনেক দিন ধরেই। এবারের বিশ্বকাপেও গোলপোস্টে দলের বড় ভরসা তিনি। দুই দশকের খরা কাটিয়ে, সবচেয়ে বেশিবার বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ডটা পাঁচ থেকে ছয়ে নিয়ে যাওয়ার যে স্বপ্ন দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি দেখছে, সেখানে নেইমার-ভিনিসিউসদের পাশাপাশি সবার চোখ থাকবে আলিসনের দিকেও।

ক্লাব ফুটবলে আলিসন সামলান লিভারপুলের গোলপোস্ট। প্রিমিয়ার লিগের গত আসরে শেষ দিন পর্যন্ত দলকে শিরোপা লড়াইয়ে রাখতে তার ছিল বড় অবদান। সেবার ৩৬ ম্যাচের ২০টিতে জাল অক্ষত রেখে সবচেয়ে বেশি ‘ক্লিন শিট’ এর কীর্তি ছিল তার যৌথভাবে। ৩৭ ম্যাচের ২০টিতে জাল অক্ষত রেখেছিলেন ব্রাজিলের দ্বিতীয় পছন্দের গোলরক্ষক, ম্যানচেস্টার সিটির এদেরসনও।

এই মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুলের অবস্থা যদিও ভালো নয়। আলিসন এখনও পর্যন্ত ১৪ ম্যাচে জাল অক্ষত রাখতে পেরেছেন কেবল চারটিতে। তবে জাতীয় দলে তিনি বড় নির্ভরতা সবসময়ই।

ঘরের মাঠে ব্রাজিলের ২০১৯ কোপা আমেরিকা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন আলিসন। পুরো আসরে ছয় ম্যাচে তিনি গোল হজম করেছিলেন স্রেফ একটি, সেটিও পেনাল্টি থেকে। আসরের সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার তার হাতে উঠেছিল অবধারিতভাবে।

এই নিয়ে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপে খেলবেন ৩০ বছর বয়সী এই গোলরক্ষক। ২০১৮ সালের রাশিয়া আসরে ব্রাজিল বিদায় নিয়েছিল কোয়ার্টার-ফাইনালে বেলজিয়ামের কাছে হেরে। দলের পাঁচ ম্যাচের সবগুলো খেলে তিনটিতে ‘ক্লিন শিট’ রেখেছিলেন আলিসন, আসরে পাঁচ জনের সঙ্গে যা যৌথভাবে সর্বোচ্চ।

এমিলিয়ানো মার্তিনেস, আর্জেন্টিনা

কোচ লিওনেল স্কালোনির আগমন ও দল পুনর্গঠনের পর আর্জেন্টিনার চেহারাই বদলে গেছে। কোপা আমেরিকা জয়ের মধ্য দিয়ে ঘুচেছে তাদের ২৮ বছরের শিরোপা খরা। ক্লাব ফুটবলে প্রায় সবকিছুই জেতা লিওনেল মেসি অবশেষে পেয়েছেন আন্তর্জাতিক শিরোপার স্বাদ। অপরাজিত আছে তারা টানা ৩৬ ম্যাচ ধরে। আর এত সব সাফল্যে অনেক বড় অবদান গোলরক্ষক মার্তিনেসের।

২০২১ সালের জুনে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেকের পর থেকে মেসির নেতৃত্বাধীন দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ তিনি। গোলপোস্টে নির্ভরতার প্রতীক।

গত বছর ব্রাজিলকে তাদের মাঠেই ১-০ গোলে হারিয়ে কোপা আমেরিকার শিরোপা উৎসব করে আর্জেন্টিনা। ফাইনালে দারুণ কয়েকটি সেভ করে ভূমিকা রাখেন মার্তিনেস। তার আগে সেমি-ফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে টাইব্রেকারে তিনটি শট ঠেকিয়ে দলকে ফাইনালে তোলার নায়কও তিনিই।

ইংলিশ ক্লাব অ্যাস্টন ভিলার এই গোলরক্ষক ওই আসরে ৬ ম্যাচ খেলে ৪টিতে রাখেন ‘ক্লিন শিট’। গোল হজম করেন স্রেফ ২টি। টুর্নামেন্ট জুড়ে অসাধারণ পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি হিসেবে জেতেন সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার।

পরে লন্ডনের ওয়েম্বলিতে ইউরোর চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে হারিয়ে আর্জেন্টিনা জিতে নেয় ফিনালিস্সিমা ট্রফি। মার্তিনেস যথারীতি আরও একবার অক্ষত রাখেন জাল। দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে ম্যাচটি জিতেছিল ৩-০ গোলে। 

১৯৮৬ সালে দিয়েগো মারাদোনার নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জয়ের পর আর বৈশ্বিক আসরে শিরোপার স্বাদ পায়নি আর্জেন্টিনা। কাতারে ফেভারিটদের তালিকায় ওপরের দিকেই রাখা হচ্ছে তাদের। সেখানেও ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার মার্তিনেসের দেয়াল ভেদ করা কঠিন হবে প্রতিপক্ষের জন্য।  

মানুয়েল নয়ার, জার্মানি

এক দশকের বেশি সময় ধরে জার্মানির প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক নয়ার। আধুনিক ফুটবলে গোলরক্ষকদের হালচাল অনেকটাই বদলে দিয়েছেন তিনি। ‘সুইপার কিপার’ হিসেবে তার মতো কার্যকর এই সময়ে আর কে আছে!

সুইপার কিপার হলো তারাই, যারা সাধারণ গোলরক্ষকের মতো প্রতিপক্ষের শট আটকানোর পাশাপাশি অতিরিক্ত একজন ডিফেন্ডারের কাজ করে থাকেন, আবার প্রয়োজনে ডি-বক্স থেকে বেরিয়ে এসে ভেস্তে দেন প্রতিপক্ষের আক্রমণ। এই কাজের জন্য নয়ারের আলাদা পরিচিত আছে অনেক দিন ধরেই।

ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখেও গত প্রায় এক যুগ ধরে এক নম্বর গোলরক্ষক তিনি। দলটির অসংখ্য সাফল্যে তার আছে অবদান।

এই নিয়ে টানা চতুর্থ বিশ্বকাপে খেলবেন ৩৬ বছর বয়সী এই গোলরক্ষক। প্রথমবার তিনি বৈশ্বিক আসরে সুযোগ পান ২০১০ সালে। এর আগের বছর রবার্ট এঙ্কার মৃত্যু ও পরে রেনি আডলারের মারাত্মক চোটে দক্ষিণ আফ্রিকার ওই আসরে দলের প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক হয়ে যান নয়ার।

গ্রুপ পর্বে তিন ম্যাচে তিনি গোল হজম করেন স্রেফ একটি। এমনকি শেষ ষোলোয় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ে মিরোস্লাভ ক্লোসার গোলে অ্যাসিস্টও করেন তিনি। ওই ম্যাচ, এরপর আর্জেন্টিনা, স্পেনের মতো দলগুলোর বিপক্ষে দারুণ সব সেভ করেন সেই সময়ের ২৪ বছর বয়সী নয়ার। সেবার ছয় ম্যাচের তিনটিতে জাল অক্ষত রাখেন তিনি। জার্মানি বিদায় নেয় সেমি-ফাইনালে স্পেনের কাছে হেরে।

২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে তো জার্মানির শিরোপা জয়ের নায়কদের একজন নয়ার। সুইপার কিপার ধরনকে সেবার তিনি নিয়ে যান অন্য পর্যায়ে। আসরে সাত ম্যাচের চারটিতে জাল অক্ষত রেখে জিতে নেন সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার।

২০১৮ সালের রাশিয়া আসরে আবার মুদ্রার উল্টো পিঠও দেখতে হয় নয়ার ও জার্মানিকে। সেবারই প্রথম বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দেন তিনি। কিন্তু তার দল তিন ম্যাচের দুটিতে হেরে বিদায় নেয় গ্রুপের তলানিতে থেকে।

এবার অবশ্য প্রথম দল হিসেবে বাছাই পেরিয়ে বিশ্বকাপের মূল পর্বে জায়গা করে নেয় চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। বাছাইয়ে ১০ ম্যাচের মধ্যে তারা জেতে ৯টি। সবশেষ আট ম্যাচে তাদের জয় যদিও স্রেফ দুটি। এর একটি আবার বিশ্বকাপের প্রস্তুতিমূলক ম্যাচে ওমানের বিপক্ষে, ১-০ গোলে।

তবে, সাম্প্রতিক ব্যর্থতা পেছনে ফেলে চার বছর আগের দুঃখ ভুলবার লক্ষ্যেই বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করবে হান্স ফ্লিকের দল।

থিবো কোর্তোয়া, বেলজিয়াম

রবের্তো মার্তিনেসের বেলজিয়াম দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য কোর্তোয়া, দেশের ‘সোনালী প্রজন্মের’ অংশ।

৩০ বছর বয়সী এই গোলরক্ষকের ক্যারিয়ারই তার হয়ে কথা বলে। এর আগে তিনি খেলেছেন দুটি বিশ্বকাপে। ২০১৪ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে দলের প্রতিটি মিনিট পোস্টের নিচে ছিলেন তিনি। ১০ ম্যাচের ৬টিতেই রেখেছিলেন ক্লিন শিট।

২০০২ বিশ্বকাপের পর প্রথমবার কোনো বড় টুর্নামেন্টের মূল পর্বে খেলার সুযোগ তারা পেয়েছিল সেবার। ব্রাজিল আসরে দলের পাঁচ ম্যাচেই খেলে দুটিতে জাল অক্ষত রাখেন কোর্তোয়া। তাদের পথচলা থেমে যায় কোয়ার্টার-ফাইনালে।

চার বছর পর রাশিয়া বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের তৃতীয় হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন কোর্তোয়া। কোয়ার্টার-ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে ২-১ গোলের জয়ে পোস্টে তিনি ছিলেন দেয়াল হয়ে। ১৯৮৬ সালের পর প্রথমবার বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে উঠে সেখানে ফ্রান্সের কাছে হেরে যায় তারা।

আসরে সাত ম্যাচে মোট ২৭টি সেভ করেন কোর্তোয়া, অন্য যেকোনো গোলরক্ষকের চেয়ে যা বেশি। টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার পান তিনিই।

ক্লাব ফুটবলে কোর্তোয়া খেলেন রিয়াল মাদ্রিদে। গত মৌসুমে দলের লা লিগা ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়েও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তার। বিশেষ করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে লিভারপুলের বিপক্ষে ৯টি অসাধারণ সেভ করে জয়ের নায়ক ছিলেন তিনিই।

২০০৩-০৪ মৌসুম থেকে প্রতিযোগিতাটির ফাইনালে সবচেয়ে বেশি সেভ করার রেকর্ড সেটি। ২০০৮ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এডউইন ফন ডার সারের পর প্রথম গোলরক্ষক হিসেবে ফাইনালে ‘ম্যান অব দা ম্যাচ’ হওয়ার কীর্তিও গড়েন কোর্তোয়া।

পুরো আসরে তিনি সেভ করেন মোট ৫৯টি। আর এসবের স্বীকৃতি হিসেবে ব্যালন ডি’অর অনুষ্ঠানে ২০২২ সালের বর্ষসেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার ইয়াশিন ট্রফি জিতে নেন ৩০ বছর বয়সী এই ফুটবলার।

কাতারে বেলজিয়াম দলেও তিনি থাকবেন নির্ভরতার প্রতীক হয়ে। দেশটির সোনালী প্রজন্মের একটি আন্তর্জাতিক ট্রফি জয়ের আরেকটি সুযোগ এটি। 

ইয়ান সমের, সুইজারল্যান্ড

গত এক দশকে সুইজারল্যান্ড ফুটবলের পুনরুত্থানে সামনের সারির সেনানীদের একজন সমের। বিশ্বকাপ ও ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে দলটির দারুণ পারফরম্যান্সে তার আছে বড় অবদান।

২০১৪ ও ২০১৮, দুটি বিশ্বকাপেই সুইসরা উঠেছিল শেষ ষোলোয়। দুই আসরেই খেলেন সমের।

২০১৬ ইউরোতেও সুইজারল্যান্ড খেলে শেষ ষোলোয়। সেবার দলের চার ম্যাচেই গোলপোস্টের নিচে ছিলেন সমের।

এক বছর পিছিয়ে গত বছর অনুষ্ঠিত ২০২০ ইউরোয় চমক দেখিয়ে সুইজারল্যান্ড উঠে যায় কোয়ার্টার-ফাইনালে। শেষ ষোলোয় টাইব্রেকারে কিলিয়ান এমবাপের নেওয়া ফ্রান্সের শেষ শট ঠেকিয়ে দলকে উচ্ছ্বাসে ভাসান সমের।

শেষ আটে স্পেনের বিপক্ষে তিনি দাঁড়িয়ে যান চীনের প্রাচীর হয়ে। মোট আটটি সেভ করেন তিনি, আসরে এক ম্যাচে যা সর্বোচ্চ। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে ১-১ গোলের পর টাইব্রেকারে হেরে যায় সুইসরা।

বিশ্বকাপেও সমেরের সামনে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের।

পাদপ্রদীপের আলোয় থাকবেন আরও কয়েক জন

ফ্রান্সের উগো লরিস, স্পেনের উনাই সিমোন, ডেনমার্কের কাসপের স্মাইকেল, কোস্টা রিকার কেইলর নাভাস- কাতারে বিশ্ব সেরার লড়াইয়ে এই নামগুলোও হয়ে উঠতে পারে রোমাঞ্চের নায়ক।