বারবার প্রত্যাখ্যাত সেই আকুনিয়া ভরসা আর্জেন্টিনার

কার্ডের খাড়ায় ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ খেলতে না পারা এই লেফট-ব্যাকের দিকে ফাইনালে তাকিয়ে থাকবেন আর্জেন্টিনা কোচ।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরদোহা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Dec 2022, 05:17 AM
Updated : 17 Dec 2022, 05:17 AM

কাতার বিশ্বকাপে তিনি যতক্ষণ রক্ষণ সামলেছেন, আর্জেন্টিনা ততক্ষণ গোল হজম করেনি! বিস্ময়কর শোনাতে পারে, কিন্তু মার্কোস আকুনিয়া খেলাকালীন সময়ে সত্যিই প্রতিপক্ষ আলবিসেলেস্তেদের জালের নাগাল পায়নি। ফাইনালের মঞ্চে আসার পথে যতগুলো গোল তারা হজম করেছে, তা আকুনিয়া মাঠে নামার আগে বা মাঠ ছাড়ার পরে! 

সৌদি আরবের কাছে ২-১ গোলে হেরে মরুভূমির আসরে যাত্রা শুরু আর্জেন্টিনার। ওই ম্যাচে আকুনিয়াকে ৭১তম মিনিটে যখন বদলি নামান লিওনেল স্কালোনি, তার আগেই গোল দুটি হজম করে বসে দল। 

মেক্সিকোর বিপক্ষে বাঁচা মরার ম্যাচে ৩১ বছর বয়সী এই লেফট-ব্যাক সুযোগ পেলেন শুরুর একাদশে। খেললেন পুরো নব্বই মিনিট। ম্যাচের স্কোরলাইন আর্জেন্টিনা-২, মেক্সিকো-০। 

পোল্যান্ডের বিপক্ষে শুরু থেকে রবের্ত লেভানদোভস্কিকে পাহারা দেওয়ার কাজটুকু নির্ভরতার সঙ্গে করে গেলেন আকুনিয়া। ওই ম্যাচে হলুদ কার্ড দেখায় তাকে ৫৯তম মিনিটে তুলে নেন কোচ। লিওনেল মেসি ও এনসো ফের্নান্দেসের গোলে জেতা আর্জেন্টিনার জালের নাগাল অবশ্য পরেও পায়নি পোলিশরা। 

শেষ ষোলোয় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে যথারীতি শুরুর একাদশে তিনি। মেসি ও হুলিয়ান আলভারেসের গোলে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ আর্জেন্টিনার মুঠোয়। ৭১তম মিনিটে আকুনিয়াকে তুলে নিলেন স্কোলোনি, ঠিক এর ছয় মিনিট পর আত্মঘাতী গোল হজম করল দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। 

নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে আকুনিয়া যতক্ষণ মাঠে উপস্থিত, বাঁ দিক দিয়ে আক্রমণের সুবিধে করতে পারেনি ডাচরা। নাহুয়েল মোলিনা এগিয়ে নেওয়ার পর মেসি স্পট কিক থেকে গোল করলে সহজ জয়ের পথে ছুটতে থাকে আর্জেন্টিনা। ওই ম্যাচে রক্ষণ সামলানোর ফাঁকে আক্রমণে উঠে পেনাল্টি আদায় করেছিলেন আকুনিয়াই। 

হলুদ কার্ড দেখা আকুনিয়াকে ৭৮তম মিনিটে তুলে হেরমান পেস্সেইয়াকে নামান কোচ। ভঠ ভেহর্স্টের সমতা ফেরানো দুটি গোলও এরপর। কোনোবারই ডাচ ফরোয়ার্ডকে আটকাতে পারেননি পেস্সেইয়া। তবে টাইব্রেকারে জিতে সেমি-ফাইনালে ওঠে মেসি-মার্তিনেসরা। 

দুই হলুদ কার্ডের খাড়ায় ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে খেলা হয়নি আকুনিয়ার। তাকে ছাড়াই জাল অক্ষত রেখে ৩-০ গোলের জয় নিয়ে ফাইনালের মঞ্চে উঠে আসে আর্জেন্টিনা। রোববার ফাইনালে তারা মুখোমুখি হবে ফ্রান্সের। 

শিরোপা লড়াইয়ে অলিভিয়ে জিরুদ, উসমান দেম্বেলের আক্রমণ ফেরানোর ভার থাকবে আকুনিয়ার কাঁধে। ফাইনালের মহারণ সামনে রেখে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ঘাম ঝরিয়েছেন শৈশব-কৈশরে অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আসা এই ডিফেন্ডারও। 

জাপালার সেই শৈশব তার জন্য ছিল বড্ড দুঃসহ। বিষণ্ণতায় ভরা। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের সময় তার বয়স মাত্র চার। আজ মায়ের সঙ্গে, তো কাল নানির আশ্রয়ে, অভাবের তাড়নায় এমনই ছোটাছুটি চলে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। 

কৈশোরও যন্ত্রণাময়। স্কুলের ছোট মাঠে পায়ের কারিকুরি দেখাতেন। বাহবাও পেতেন। কিন্তু তাকেও একসময় দমে যেতে হয়! সংগ্রামী মায়ের হাত ধরে সাড়ে ১৫ ঘণ্টা ভ্রমণ করে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স এইরেসে বড় স্বপ্ন নিয়ে এসে যে প্রত্যাখাত হলেন রিভার-প্লেট, কুইলমেস, তিগ্রে-সব ক্লাব থেকে! 

বয়স তখন ১৩ বছর, ধর্ণা দিলেন সান লরেন্সো দে আলমাগ্রো এবং বোকা জুনিয়র্সের দরজায়। ট্রায়ালে তার দিকে কেউ সেখানে তাকালও না, পত্রপাঠ বিদায় বলে দিল! ছোট্ট আকুনিয়ার তখন চোখের পানি আটকে রাখা দায়। মা’কে বলে দেয়, “দয়া করে আমার পেছনে আর এক আনাও খরচ করো না।” 

একসময় নিয়তি তার দিকে মুখ ফেরায় বটে, কিন্তু সে আরেক বিড়ম্বনা। মাকে ঘরে ফিরতে বলে তিনি একাকী রয়ে যান বুয়েন্স এইরেসে। উঠেন এক হোটেলে। ফেররো কারিল ওয়েস্তে ক্লাবে ট্রায়ালের জন্য ডাক পান। ভেবে নিলেন শেষ সুযোগ। 

সপ্তাহ ব্যাপী চলা ট্রায়ালে টিকে গেলেন, নতুন বিপত্তিরও শুরু। খেলতে পারবেন, কিন্তু থাকার জায়গা নেই। মাথা গোঁজার জন্য ছোট্ট একটা রুম ভাড়া নিলেন। মাস খানেকের মধ্যে চুরির শিকার হলেন তিনবার! চোরেরা পেল দু-এক আনা, আকুনিয়া হারালেন স্বর্বস্ব। কিন্তু স্বপ্ন যার আকাশ ছোঁয়া, তাকে আটকায় কে। 

ফেররো কারিস ওয়েসতের সিনিয়র টিমের দরজা তার জন্য খুললো ২০১০ সালে। সেই যে ঢুকলেন, রক্ষণের নির্ভরতা হতে সময় নিলেন না। ২০১৩-১৪ মৌসুমে রক্ষণ আগলে রাখার পাশাপাশি নিখুঁত পাসে বেঁধে দিতে লাগলেন আক্রমণের সুর। ওই মৌসুমে ২৩ অ্যাসিস্ট করেছিলেন! নজর কাড়লেন আর্জেন্টিনার নামকরা ক্লাবগুলোর। 

২০১৪ সালে স্বপ্নের ক্লাব রেসিংয়ে আঙিনায় পা রাখা আকুনিয়ার। মূলত এখান থেকেই তার পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসা। ২০১৩-১৪ কোপা আর্জেন্টিনার নকআউট পর্বে ধুন্দুমার পারফরম্যান্স করলেন, সান মার্তিন দে সান হুয়ানের বিপক্ষে করলেন দলের জয়সূচক একমাত্র গোলটি। ২০১৪ সালে রেসিংয়ের প্রিমেরা ডিভিশনের শিরোপা জয়েও রাখলেন অবদান। এর পর আর পিছু ফিরে তাকানো নয়। 

দুই বছর বাদে ডাক এলো আর্জেন্টিনা দলে। ২০১৬ সালের নভেম্বরে কলম্বিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচ দিয়ে স্বপ্নের আকাশি নীল-সাদা জার্সিতে অভিষিক্ত হলেন। ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপেও খেললেন, কিন্তু শেষ ষোলো থেকে আর্জেন্টিনার বিদায়ে প্রথম বিশ্বকাপ রাঙানো হলো না। 

এবার মরুভূমির বিশ্বকাপ কী দারুণভাবেই না রাঙাচ্ছেন আকুনিয়া। রক্ষণের পাহারায় তিনি থাকলে যে প্রতিপক্ষ জালের দেখাই পাচ্ছে না!