ইউরোপ নাকি লাতিন, কাতারে মুকুট পরবে কারা?

এই দুই অঞ্চলের বাইরের কোনো দল এখনও ফাইনালেই যেতে পারেনি।

আব্দুল মোমিনআব্দুল মোমিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Nov 2022, 05:29 AM
Updated : 19 Nov 2022, 05:29 AM

সেই যে ২০০২ বিশ্বকাপে বিশ্ব জয়ের উল্লাস করেছিল ব্রাজিল, তারপর পেরিয়ে গেছে বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের আরও চারটি আসর। প্রতিবারই ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছে ইউরোপের কোনো দল। এবার সেই ধারায় ছেদ পড়ার সম্ভাবনা দেখছে অনেকে। ফুটবল বিশেষজ্ঞদের প্রায় সবাই এগিয়ে রাখছে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাকে।

জাপান-কোরিয়ার যৌথ আয়োজনে ২০০২ আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল রোনালদো-রিভালদো-রোনালদিনিয়োর ব্রাজিল। এরপর ২০০৬ সালে ইতালি, ২০১০ বিশ্বকাপে স্পেন, ২০১৪-তে জার্মানি এবং সবশেষ ২০১৮ আসরে ফ্রান্স বিশ্বকাপ জেতে।

ছয় মাস আগেও বাজিকরদের হিসেবে ফেভারিটদের তালিকায় লাতিনের দুই পরাশক্তির সঙ্গে সমানভাবেই ছিল ইউরোপের কয়েকটি দল। তবে গত কয়েক মাসের আন্তর্জাতিক বিরতিতে ইউরোপিয়ান দলগুলোর পথ হারানোয় সবকিছু বদলে গেছে। বিশেষ করে সেপ্টেম্বরে শেষ হওয়া নেশন্স লিগের গ্রুপ পর্বে কয়েকটি সাবেক চ্যাম্পিয়নসহ বড় দলগুলোর পারফরম্যান্স তেমন আশা জাগানিয়া হয়নি। তাতে বিশ্বকাপ ঘিরে তাদের সম্ভাবনাও ফিকে হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা পরিষ্কারভাবে জানান দিয়েছে তাদের শক্তিমত্তার। বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব দাপটের সঙ্গে শেষ করার পর এ বছরে খেলা প্রীতি ম্যাচগুলোতেও আশানুরূপ ফল পেয়েছে তারা।

আর্জেন্টিনা তিন বছরের বেশি আর ব্রাজিল প্রায় দেড় বছর ধরে অপরাজিত থাকার আত্মবিশ্বাস নিয়ে শুরু করতে যাচ্ছে বিশ্বকাপ।

তারপরও ইউরোপের ফেভারিট ফ্রান্স

আক্রমণভাগে কিলিয়ান এমবাপে, করিম বেনজেমা, অঁতোয়ান গ্রিজমান, উসমান দেম্বেলে; মাঝমাঠে দুই তরুণ অহেলিয়া চুয়ামেনি ও এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা; রক্ষণে পরীক্ষিত রাফায়েল ভারানে, লুকা এরনঁদেজদের পাশে জুল কুন্দের মতো সম্ভাবনাময় তরুণ। পোস্টের নিচে বিশ্বস্ত উগো লরিস, বিকল্প আলফুঁস আরিওলা।

বিশেষ করে আক্রমণে তিন তারকার উপস্থিতিই ফরাসিদের করে তুলেছে শক্তিশালী। তারপরও আছে কিছু ‘কিন্তু।’

সবচেয়ে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে চোটের আঘাতে; যা ছিনিয়ে নিয়েছে মাঝমাঠের মূল দুই খেলোয়াড়, এনগোলো কঁতে ও পল পগবাকে। রাশিয়া বিশ্বকাপে দলের সাফল্যে যাদের ছিল অনেক বড় ভূমিকা।

চোটের ছোবলে দল ঘোষণার পরপরই পরিবর্তন আনতে হয়েছে কোচ দিদিয়ে দেশমকে। শেষ মুহূর্তে ছিটকে গেছেন পিএসজি ডিফেন্ডার প্রেসনেল কিম্পেম্বে। মাঝমাঠে কঁতে-পগবার অনুপস্থিতির পাশাপাশি রক্ষণে কিম্পেম্বের শূন্যতা হয়ে উঠতে পারে অনেক বড়।

সাম্প্রতিক সময়ে দলটির পারফরম্যান্সও আশানুরূপ নয়।

গত জুনে নেশন্স লিগে চার ম্যাচ খেলে অবিশ্বাস্যভাবে জয়শূন্য থাকে তারা। ডেনমার্কের বিপক্ষে হেরে আসর শুরুর পর ওই মাসেই আরও তিন ম্যাচ খেলে দুটিতে ড্র করে ও আরেকটি হারের স্বাদ পায় ফরাসিরা।

তাতে শঙ্কা জাগে দলটির আগামী নেশন্স লিগে ‘বি’ নেমে যাওয়ার শঙ্কা। সেপ্টেম্বরের আন্তর্জাতিক বিরতিতে অস্ট্রিয়াকে ২-০ গোলে হারিয়ে আসরে প্রথম জয়ের স্বাদ পায় তারা। তারপরও ছিল অবনমনের শঙ্কা; শেষ রাউন্ডে ডেনমার্কের বিপক্ষে ফের হারলেও অন্য ম্যাচের ফল পক্ষে আসায় কোনোমতে টিকে থাকে দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।

একটা বিষয় অবশ্যই উল্লেখযোগ্য যে, সবশেষ দুই ম্যাচে চোটের ছোবলে এক ডজনের বেশি খেলোয়াড়কে স্কোয়াডে পাননি কোচ দেশম। তারপরও জুন থেকে তাদের পারফরম্যান্স এবং বিশ্বকাপে গুরুত্বপূর্ণ তিন খেলোয়াড়কে হারানোয় দুশ্চিন্তার জায়গা রয়েই গেছে।

দুর্ভাবনার জায়গা আছে আরও। দলে একগাদা তারকা ফরোয়ার্ড থাকার পরও সবশেষ ৬ ম্যাচে প্রতিপক্ষের গোলমুখে যেভাবে ভুগেছে তারা, তা ভীষণ দৃষ্টিকুট। উদ্বেগের। নেশন্স লিগের এই ম্যাচগুলোয় মাত্র ৫টি গোল করতে পারে তারা, বিপরীতে হজম করে ৭টি!

পাশাপাশি এই ছয় ম্যাচের পাঁচটিতেই জাল অক্ষত রাখতে ব্যর্থ হয় ফ্রান্স।

বিশ্বকাপেও গ্রুপ পর্বে ডেনমার্ককে পেয়েছে ফ্রান্স; যাদের বিপক্ষে গত চার মাসে দুইবারের দেখায় দুটিতেই হেরেছে। ‘ডি’ গ্রুপের অন্য দুই দল অস্ট্রেলিয়া ও তিউনিসিয়া। নামের ভারে হতে পারে ফ্রান্সের জন্য তুলনামূলক কিছুটা সহজ প্রতিপক্ষ। তবে, মঞ্চটা বিশ্ব সেরার, যেখানে সত্যিকার অর্থে ছোট দল বলতে কিছু নেই।

সার্বিক বিবেচনায় একটা মাত্র হোঁচটই পাল্টে দিতে পারে ফ্রান্সের গতিপথ। বিশ্বকাপ শিরোপা ধরে রাখার অভিযানে দেশমের দলের সামনে তাই খুব, খুব কঠিন চ্যালেঞ্জ।

তারুণ্যনির্ভর স্পেনের শক্তি ও দুর্বলতা

দশক আগে পরাশক্তি স্পেন যাচ্ছে পালাবদলের মধ্যে দিয়ে। তাদের স্কোয়াডে অভিজ্ঞতার ঘাটতি স্পষ্ট। তবে, তরুণ ও অভিজ্ঞ ফুটবলারদের মিশেলে গড়া দলটির সম্ভাবনা একেবারে কমও নয়।

নেই কোনো প্রতিষ্ঠিত তারকা। আক্রমণভাগে শক্তির ঘাটতি স্পষ্ট। অভিজ্ঞদের মধ্যে ভরসার জায়গা বলতে আলভারো মোরাতা এবং ২২ বছর বয়সী ফেররান তরেস। সবশেষ নেশন্স লিগের ম্যাচে পর্তুগালের বিপক্ষে অনেকটা সময় কোণঠাসা থেকে তার শেষ সময়ের গোলেই ফাইনালসে জায়গা করে নেয় স্প্যানিশরা।

নিজের দিনে মোরাতা ভেঙে দিতে পারেন প্রতিপক্ষের জমাট রক্ষণ; তবে তার পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতার বড্ড অভাব। নেশন্স লিগের গ্রুপ পর্বেই যেমন ছয় ম্যাচ খেলে প্রথম ও শেষটিতে জালের দেখা পান তিনি।

দলটির মাঝমাঠ অবশ্য বেশ শক্ত। অভিজ্ঞ সের্হিও বুসকেতস, কোকেদের পাশে আছেন দারুণ প্রতিভাবান পেদ্রি ও গাভি। পরীক্ষিত জর্দি আলবা, দানি কারভাহাল, সেসার আসপিলিকুয়েতা এবং তরুণ এরিক গার্সিয়াকে রক্ষণ বেশ জমাট।

চলতি বছরে এখন পর্যন্ত মোট আটটি ম্যাচ খেলা স্পেনের পারফরম্যান্স অবশ্য তেমন আহামরি নয়। তবে মাঠে পেদ্রি-গাভিদের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল।

সেই সঙ্গে ক্লাব ফুটবলে দারুণ সফল লুইস এনরিকের ডাগআউটে উপস্থিতিও হতে পারে বড় নিয়ামক। ডেসিং রুমে তরুণ-অভিজ্ঞদের এক সুতোয় গাঁথার কাজটা তিনি ভালোভাবেই করেছেন। তবে বড় মঞ্চে অভিজ্ঞতার ঘাটতি বড় হয়ে উঠতে পারে।

তাই বিশ্ব সেরার লড়াইয়ে তাদেরকে যেমন একপাশে সরিয়ে রাখা যাচ্ছে না, তেমনি চূড়ান্ত সাফল্যের প্রশ্নেও তাদের পক্ষের বাজি ধরার লোক খুঁজে মেলা ভার।

আগামী ২৩ নভেম্বর কোস্টা রিকার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হবে ২০১০ আসরের চ্যাম্পিয়নদের। ‘ই’ গ্রুপের অন্য দুই দল হলো জার্মানি ও জাপান।

কক্ষচ্যূত ইংল্যান্ড

সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। ২০১৮ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালের পর গত বছর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল। দিন শেষে শিরোপা সাফল্য না মিললেও গ্যারেথ সাউথগেটের কোচিংয়ে একটা সুখী পরিবার হয়ে উঠেছিল ইংল্যান্ড শিবির।

হ্যাঁ, ‘উঠেছিল’ বলতে হচ্ছে। কারণ হঠাৎ করেই যেন চেনা পথটা হারিয়ে ফেলেছে তারা। আচমকা এক দমকা হওয়ায় সব যেন এখন এলোমেলো।

দাপট ধরে রেখে বিশ্বকাপ বাছাই শেষ করার পর এ বছরের শুরুতে দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলেও জয় তুলে নেয় ইংল্যান্ড। এরপরই তাদের রংটা ফ্যাকাসে হতে শুরু করে।

গত জুনে নেশন্স লিগে চারটি ম্যাচ খেলে জয়শূন্য থাকে দলটি। হাঙ্গেরির বিপক্ষে দুই দেখায় দুটিতেই হারে তারা; এর মধ্যে ঘরের মাঠে বিধ্বস্ত হয় ৪-০ গোলে।

সেপ্টেম্বরে ওই আসরের প্রথম ম্যাচেও ইতালির বিপক্ষে হেরে বসে তারা। তাতে নেমে যায় নেশন্স লিগের নিচের স্তরে। ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দী হয়ে পড়া ইংল্যান্ডের নামের পাশ থেকে পড়ে গেছে ফেভারিটের ট্যাগ।

দলটিকে এখন ভঙ্গুর বললেও খুব কি ভুল বলা হয়?

নেশন্স লিগের শেষ ম্যাচে জার্মানির বিপক্ষে খাদের কিনারা থেকে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে হারানো আত্মবিশ্বাস কিছুটা ফিরে পেলেও বিশ্বকাপের আগে দলটির মাঠের অনুভূতি সুখকর নয়। সঙ্গে সমালোচনা ঢেউ তো আছেই।

সব মিলিয়ে প্রবল চাপ সামলে দলটিকে নিয়ে বড় কোনো আশা হয়তো করতে পারছে না ইংল্যান্ডের ঘোর সমর্থকরাও।

দলটির সেরা তারকা ও অধিনায়ক হ্যারি কেইন অবশ্য আশাবাদী। জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচ শেষে তিনি বলেছিলেন, “এই ম্যাচে দলের মনোবল ও লড়াইয়ের মানসিকতা ফুটে উঠেছে।”

কিছুদিন আগে কোচ সাউথগেটও আশার পালে দিয়েছেন হাওয়া। এবার তাদের সামনে মুখের কথাকে মাঠে প্রমাণের চ্যালেঞ্জ।

বিশ্বকাপ শুরুর পরদিনই মাঠে নামবে ১৯৬৬ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা, প্রতিপক্ষ ইরান। ‘বি’ গ্রুপে তাদের অন্য দুই প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েলস।

জার্মানি যেন এক ক্ষয়িষ্ণু শক্তি

দলে সবচেয়ে বড় তারকা মানুয়েল নয়ার; পোস্টের অতন্দ্র প্রহরী। প্রতিপক্ষের শত আক্রমণের মুখে তিনি একাই গড়ে দিতে পারেন ব্যবধান। কিন্তু… ম্যাচ জিততে হলে তো শাণাতে হবে আক্রমণ, করতে হবে গোল। সেখানে তাদের যে খুব ঘাটতি আছে, তা কিন্তু নয়। তবে এইখানটায় একাই প্রতিপক্ষের রক্ষণ ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার মতো কেউ নেই। 

অবশ্য জার্মানি বরাবরই দলীয় শক্তির দল। প্রথম মিনিট থেকে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিকতা নিয়েই মাঠে নামে তারা। দলগত ফুটবলে তাদের সে শক্তি অবশ্য ভালোই আছে। তারপরও কেন যেন, সময়টা ভালো যাচ্ছে না চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের।

হতাশার পালা শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের বেশে ২০১৮ সালে বিশ্বকাপে নেমে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় দলটি। ব্যর্থতার ধারাবাহিকতায় গত বছরের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে তাদের পথচলা থেমে যায় শেষ ষোলোয়।

এরপরই দায়িত্ব নেন হান্স ফ্লিক।

২০১৯ সালে তখন হঠাৎই কিছুটা এলোমেলো হয়ে পড়া বায়ার্ন মিউনিখের হাল ধরে অল্প সময়ে দলটিকে তিনি করে তুলেছিলেন অপ্রতিরোধ্য। দলটিকে জিতিয়েছিলেন ২০১৯-২০ মৌসুমের ট্রেবল।

ফ্লিকের হাত ধরে জার্মানিও ছুটছিল অদম্য গতিতে। দেশটির ইতিহাসে কোচ হিসেবে প্রথম ছয় ম্যাচের সবগুলো জিতে রেকর্ড গড়েন সাবেক এই মিডফিল্ডার। তার হাত ধরে জেতে পরের দুটি ম্যাচও। এরপরই পুরনো ভূত যেন পেয়ে বসে তাদের।

পরের চার ম্যাচে টানা ড্র, প্রত্যেকটি ম্যাচের ফল ১-১। এর তিনটিই নেশন্স লিগে, গত জুনে। পরের ম্যাচে ইতালিকে ৫-২ গোলে গুঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস দিলেও ছন্দপতন হতে সময় লাগেনি। সেপ্টেম্বরে হাঙ্গেরির বিপক্ষে ঘরের মাঠে হেরে পড়ে যায় প্রতিযোগিতাটির ‘বি’ লিগে নেমে যাওয়ার শঙ্কায়।

শেষ পর্যন্ত তা না হলেও বিশ্বকাপের আগে কোনোকিছুই তাদের জন্য স্বস্তির নয়।

এই যেমন, গত বুধবার বিশ্বকাপের শেষ প্রস্তুতিমূলক ম্যাচেও তাদের পারফরম্যান্স ছিল বড়ই সাদামাটা। দুর্বল ওমানের বিপক্ষে তাদের ঘাম ছুটে যায়। অভিষেক ম্যাচে বদলি নেমে শেষ দিকে নিকলাস ফুয়েলখুগ গোল করলে জয় ঠিকই পায় তারা; কিন্তু বিশ্বকাপ শুরুর দুদিন আগে এমন পারফরম্যান্স কেবল দুর্ভাবনাই বাড়ায়।

ফ্লিক অবশ্য আত্মবিশ্বাসী। শোনালেন নিজেদের চিরচেনা আক্রমণাত্মক কৌশলেই প্রতিপক্ষকে বধ করার প্রত্যয়। কোচের কথাকে সত্যি প্রমাণ করতে এবং দেশের মানুষের চাওয়া পূরণের জন্য এখন মাঝমাঠে সুর বেঁধে দিতে হবে ইলকাই গিদোয়ান, জামাল মুসিয়ালাদের আর আক্রমণে সুযোগ কাজে লাগাতে হবে সের্গে জিনাব্রি, লেরয় সানে, টমাস মুলারদের।

বিশ্বকাপ মিশনে গ্রুপ পর্বেই কঠিন পরীক্ষায় পড়তে হতে পারে জার্মানিকে। ‘ই’ গ্রুপে তাদের সঙ্গী স্পেন, কোস্টা রিকা ও জাপান।

বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্মের শেষ সুযোগ

কেভিন ডে ব্রুইনে, রোমেলু লুকাকু, থিবো কোর্তোয়া- অনেক আগেই এই নামগুলোর পাশে জুড়ে গেছে তারকাখ্যাতি। একের পর এক চোটের ছোবলে এদেন আজার অনেকটা ফিকে হয়ে গেলেও প্রতিপক্ষের জন্য যখন-তখন ভয়ানক অস্ত্র হয়ে ওঠার সামর্থ্য তার আছে।

স্কোয়াডের বাকি নামগুলো এতটা বিশেষ না হলেও নিজ নিজ ক্লাবে সবাই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আর জাতীয় দলে তারা একসঙ্গে ভয়ঙ্কর এক গ্রুপ। এমনিতে তো আর দলটিকে বলা হয় না বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্ম।

দিনে দিনে তাদের ঘিরে দেশের মানুষের প্রত্যাশা বেড়েছে। বিশ্ব জুড়ে আকার বেড়েছে দলটির সমর্থক গোষ্ঠীর। কিন্তু আকাশছোঁয়া প্রত্যাশার বিপরীতে মাঠে তেমন আলো ছড়াতে পারেনি লুকাকুরা।

বৈশ্বির আসরে এই সোনালী প্রজন্মের অভিষেক ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপ। সেবার কোয়ার্টার-ফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়া দলটি আরও অভিজ্ঞ হয়ে পা রাখে রাশিয়া বিশ্বকাপে। নিজেদের ইতিহাসে সেরা সাফল্য ২০১৮ সালের ওই আসরেই পায় তারা। কিন্তু বিশ্ব জয়ের স্বপ্নে অভিযানে গিয়ে তৃতীয় হওয়ার সান্ত্বনা পুরস্কারে কী আর মন ভরে।

অনেকের মতে এটিই হতে যাচ্ছে তারকাখচিত এই প্রজন্মের শেষ বিশ্বকাপ। কাগজে-কলমে, পরিসংখ্যানের আলোয় কিংবা খেলোয়াড়দের নামের ভারে এবারও তারা সম্ভাবনাময়। তবে গত দুই বিশ্বকাপের মতো এবার আর তাদেরকে শিরোপার মূল দাবিদার হিসেবে ভাবা হচ্ছে না।

তাই নেই আগের মতো প্রত্যাশার চাপ, অতি ভারে ভেঙে পড়ার ভয়ও। সবার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দলটি যদি কাতারের জমকালো মঞ্চে সেরার মুকুট মাথায় তোলে, খুব কী অবাক হওয়ার কিছু হবে?

ফেভারিট নয় নেদারল্যান্ডস, ক্রোয়েশিয়া, পর্তুগাল; কিন্তু…

২০১৬ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে উঠতে ব্যর্থ হওয়ার পর রাশিয়া বিশ্বকাপেরও বাছাইয়ে আটকে গিয়েছিল নেদারল্যান্ডস। পরপর দুটি বড় টুর্নামেন্টে খেলতে না পারা দলটি এরপর যায় পালাবদলের মধ্যে দিয়ে। তরুণদের নিয়ে শুরু করে ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। তারাই এখন বেশ অভিজ্ঞ। বেশ কয়েকজন হয়ে উঠেছেন তারকা। এবার বিশ্ব মঞ্চে পরীক্ষা দেওয়ার পালা।

শক্তির বিবেচনায় তারা খুব একটা পিছিয়ে নেই। এখন কোচ লুই ফন খালের পরিকল্পনা যদি দল মাঠে সঠিকভাবে মেলে ধরতে পারে, তাহলে ১৯৭৪, ১৯৭৮ আর ২০১০ বিশ্বকাপের কষ্ট, হতাশা হয়তো এখানে ভুলতে পারবে ডাচরা।

আগামী সোমবার সেনেগালের বিপক্ষে আসরে প্রথম ম্যাচ খেলবে নেদারল্যান্ডস। ‘এ’ গ্রুপে তাদের সঙ্গে আরও আছে স্বাগতিক কাতার ও একুয়েডর।

বিশ্ব ফুটবলে সবচেয়ে দ্রুত উন্নতি করা দলগুলোর একটি ক্রোয়েশিয়া। ১৯৯৪ বিশ্বকাপের সময় তারা ফিফার সদস্যই ছিল না। সেখানে স্বাধীনতা লাভের তিন বছরের মধ্যে ১৯৯৮ সালের পরের বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েই চমকে দেয় ক্রোয়াটরা, তৃতীয় হয়েছিল তারা।

সেই সাফল্যকে তারা ছাড়িয়ে যায় রাশিয়ায়। দারুণ সব পারফরম্যান্স উপহার দিয়ে দলটি উঠে যায় ফাইনালে। ফ্রান্সের বিপক্ষে হেরে শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলেও শক্তির জানান দেয় তারা। সেই দলের অনেকেই আছে এবারের দলে। আছে দলের মধ্যমণি লুকা মদ্রিচ। তাদের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সও বেশ ভালো। সেপ্টেম্বরে শেষ হওয়া নেশন্স লিগে ফ্রান্স ও ডেনমার্কের গ্রুপ থেকে চার দলের ফাইনালসে ওঠে তারা। ৬ ম্যাচ খেলে জেতে ৪টি, একটি ড্র। পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা বিশ্বকাপেও টেনে নিতে পারলে দলটির পক্ষে শেষ ধাপ পর্যন্ত যাওয়া খুবই সম্ভব।

বিশ্বকাপ শুরুর দুই দিন পর ২৩ নভেম্বর মরক্কোর বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে যাত্রা শুরু হবে ক্রোয়েশিয়ার। ‘এফ’ গ্রুপে তাদের বাকি দুই প্রতিপক্ষ বেলজিয়াম ও কানাডা।

ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো, বছর কয়েক আগেও পর্তুগালের সব সম্ভাবনা যেন এই একজনকে ঘিরেই ছিল। সময় পাল্টেছে। এখন আর তারা কেবলই রোনালদোময় দল নয়। অনেকের চোখে, ৩৭ বছর বয়সী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তারকাকে ছাড়াই দলটি বেশি শক্তিশালী।

বিতর্কিত এই মন্তব্যকে সত্যি ধরে নিয়ে এগোলেও পর্তুগালের শক্তির মাপকাঠিটা বোঝা যায়। মাঝমাঠে ব্রুনো ফের্নান্দেস-বের্নার্দো সিলভারা যদি সুরটা বেধে দিতে পারেন, সেটা কাজে লাগানোর রসদ আক্রমণভাগে আছে। তরুণ গতিময় ফরোয়ার্ড জোয়াও ফেলিক্স ও রাফায়েল লেয়াওদের সঙ্গে অসংখ্য সাফল্যের নায়ক রোনালদোর উপস্থিতি তাদের আক্রমণকে আরও শাণিত করেছে।

আগামী বৃহস্পতিবার ঘানার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে পর্তুগালের এবারের বিশ্বকাপ অভিযান। ‘এইচ’ গ্রুপে অন্য দুই দল উরুগুয়ে ও দক্ষিণ কোরিয়া।

হট ফেভারিট ব্রাজিল

একবিংশ শতাব্দীর প্রথম বিশ্বকাপে রোনালদো-রিভালদোদের সেই বিশ্ব জয়ের পর পেরিয়ে গেছে ২০ বছর। কেটে গেছে চারটি আসর। কিন্তু ‘হেক্সা’ জয়ের মিশনে সাফল্য আর মেলেনি।

প্রতিবারই তারা নতুন স্বপ্নে বুক বেঁধেছে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দল; কিন্তু ব্যর্থতার বৃত্ত ভাঙা যায়নি। ২০১৪ সালে দেশের মাটিতে সেমি-ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে ৭-১ গোলে হারের সেই জ্বালা জুড়ানোর আশায় তারা পা রেখেছিল রাশিয়ায়। বেলজিয়ামের বিপক্ষে হেরে কোয়ার্টার-ফাইনালেই শেষ হয় তাদের পথচলা।

এরপর, গত চার বছরে তিতের হাত ধরে অনেক পরিবর্তন এসেছে স্কোয়াডে। দারুণ সব সম্ভাবনাময় তরুণ খেলোয়াড় দলে জায়গা শক্ত করেছে।

আক্রমণভাগে ভিনিসিউস-রদ্রিগো-আন্তোনির মতো তরুণদের পাশে জ্বলজ্বল করছে নেইমারের মতো বিশ্ব সেরা তারকা। আরও আছেন দারুণ ছন্দে থাকা রিশার্লিসন ও গাব্রিয়েল জেসুস।

রক্ষণে আন্তর্জাতিক ফুটবলের রেকর্ড শিরোপা জয়ী অভিজ্ঞ দানি আলভেসের সঙ্গে অভিজ্ঞ চিয়াগো সিলভা, মার্কিনিয়োস, এদের মিলিতাও। তাদের পেছনেই ‘চীনের প্রাচীর’ গোলরক্ষক আলিসন। দ্বিতীয় পছন্দের গোলরক্ষক ম্যানচেস্টার সিটির অন্যতম সেরা তারকা এদেরসন।

তারকায় ঠাসা দলটিতে সামান্য একটু ঘাটতি যদি থেকে থাকে, সেটা মাঝমাঠে। অবশ্য সেখানেও আছে কাসেমিরোর মতো একজন। রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক এই মিডফিল্ডার যদি মিডফিল্ডের নেতা হয়ে উঠতে পারেন, তাহলে তাকে সঙ্গ দেওয়ার সামর্থ্য ভালো করেই আছে ফ্রেদ ও লুকাস পাকেতাদের।

আর ডাগআউটে তিতের উপস্থিতি দলটিকে করে তুলেছিল অপ্রতিরোধ্য। রাশিয়ায় ওই ব্যর্থতার পরের বছরই কোপা আমেরিকা জয়ের মধ্য দিয়ে এই দলের ছুটে চলার শুরু। গত বছরের কোপা আমেরিকাও জয়ের পথেই ছিল তারা; হেরে বসে ফাইনালে গিয়ে।

ওই এক হারের পর আবার অজেয় হয়ে উঠেছে ব্রাজিল।

লাতিন আমেরিকার বিশ্বকাপ বাছাইয়ে অপরাজেয় পথচলায় শীর্ষে থেকে মূল পর্বে জায়গা করে নেয় দলটি। ১৭ ম্যাচ খেলে জেতে ১৪টি, ড্র বাকি তিনটি। এই ম্যাচগুলোয় তারা গোল করে ৪০টি, বিপরীতে হজম করে মোটে ৫টি!

এই পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে আক্রমণে নেইমার-ভিনিসিউস-রিশার্লিসনদের বিধ্বংসী রুপ, সেই সঙ্গে রক্ষণে আলভেস, সিলভা এবং গোলপোস্টে আলিসনের দেয়াল কতটা মজবুত।

বাছাই শেষে এ বছর চারটি প্রীতি ম্যাচও খেলেছে তারা এবং ফলাফল একইরকম। সবকটি জয়ের পথে প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠায় ১৪ বার, হজম করে মাত্র দুটি।

দলটি কতটা শক্তিশালী, তার একটা প্রমাণ হতে পারে লিভারপুলের ফরোয়ার্ড রবের্তো ফিরমিনো মতো খেলোয়াড়ের জায়গা না পাওয়া। অ্যানফিল্ডের দলটির কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ যেমন বলেছেন, “এতেই প্রমাণ হয়, ব্রাজিলের স্কোয়াড কতটা ভালো ও প্রতিভাবান খেলোয়াড়ে ভরা, যে তারা ববির (ফিরমিনো) মতো একজন খেলোয়াড়কে বাদ দিতে পারে।”

নির্ধিদ্বায় তাই বলে দেওয়া যায়, শক্তি-সামর্থ্যে এই ব্রাজিলকে পেছনে ফেলার মতো দল এবারের বিশ্বকাপে নেই। এখন তাদের কেবল মাঠে নিজেদের জানান দেওয়ার পালা।

বিশ্বকাপে ‘জি’ গ্রুপে ব্রাজিলের তিন প্রতিপক্ষ সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ড ও ক্যামেরুন।

আগামী ২৪ নভেম্বর সার্বিয়ার বিপক্ষে গ্রুপ পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলবে ব্রাজিল।

মেসির প্রথম, আর্জেন্টিনার তৃতীয় সম্ভব?

ব্রাজিল বিশ্বকাপে শিরোপার খুব কাছে গিয়ে খালি হাতে ফেরার কষ্ট কি আজও তাড়া করে লিওনেল মেসিকে? আর্জেন্টিনাকে? তাদের সারা বিশ্বের লাখো-কোটি সমর্থকদের?

জার্মানির বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ের শেষ দিকের একমাত্র গোলে হারের সেই জ্বালা মেসিকে কতটা পুড়িয়েছিল, তা তিনি নিজেই বলেছিলেন। মারাকানার ওই রাতের পর সাবেক এজেন্ট ফাবিয়ান সোলদিনিকে মেসি বলেছিলেন, “বছর ধরে ব্রাজিলের সেই ফাইনালে হারের কষ্টে রাতে ঘুম ভেঙে যায় আমার। আমি ঘুমাতে পারি না।”

সেই ঘা শুকানোর আগেই পরের দুই বছরে আর্জেন্টিনা হেরে বসে টানা দুটি কোপা আমেরিকার ফাইনাল। ২০১৮ বিশ্বকাপে তারা বিদায় নেয় শেষ ষোলো থেকে।

এরপরই লিওনেল স্কালোনির হাত ধরে নতুনভাবে শুরু করে দলটি। নতুন কোচের ছায়ায় নতুন শুরুর জানান দেয় তারা।

একসময় কেবল মেসির কাঁধেই নির্ভর করত দলটি। হ্যাঁ, এখনও তাদের পরিকল্পনার কেন্দ্রে মেসিই আছেন; তবে এর মাঝেও ভিন্নতা অনেক। দলে যোগ হয়েছে দারুণ সব অস্ত্র। প্রয়োজনের মুহূর্তে তারাও হয়ে উঠতে পারেন দলের নায়ক।

স্কালোনির কোচিং আর মেসির নেতৃত্বে এই আর্জেন্টিনা সত্যিকার অর্থে হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য। এরা যেন হারতে জানে না। সত্যিই তো তাই, অপরাজেয় রথে চেপে তারা পার করে দিয়েছে তিন বছরের বেশি।

ব্রাজিলের মতো বিশ্বকাপ বাছাইয়ে কোনো ম্যাচ হারেনি তারাও; ১৭ ম্যাচে ১১ জয়ের পাশে ড্র ৬টি। সব মিলিয়ে টানা ৩৬ ম্যাচে কেউ হারাতে পারেনি তাদের।

বিশ্বকাপের আগে আগে বড় এক ধাক্কা লাগার শঙ্কা জাগে; চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে যান আনহেল দি মারিয়া। এক মাস পর মাঠে ফিরলেও তার ছন্দে ফেরা নিয়ে ছিল অনিশ্চয়তা।

তবে গত বুধবার শেষ প্রস্তুতি ম্যাচে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে মাঠে নেমেই যেভাবে জ্বলে উঠলেন এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার, তাতে তাকে নিয়ে সব দুশ্চিন্তা মিটে গেছে। ৫-০ ব্যবধানে জয়ের পথে জোড়া গোল করেন তিনি।

প্রস্তুতির পালা শেষ, এবার যুদ্ধে নামার পালা। গত বছর ব্রাজিলকে তাদের মাটিতেই হারিয়ে কোপা আমেরিকার জয়ের মধ্য দিয়ে ২৮ বছরের শিরোপা খরা কাটায় আর্জেন্টিনা। মেসির নামের পাশে যোগ হয় প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা।

রেকর্ড সাতবারের ব্যালন ডি’অর জয়ীর সামনে এবারের চ্যালেঞ্জ দেশকে ৩৬ বছর পর প্রথম বিশ্বকাপ জেতানোর, সঙ্গে নিজের প্রথম।

‘সি’ গ্রুপে আর্জেন্টিনার সঙ্গী সৌদি আরব, মেক্সিকো ও পোল্যান্ড। ২২ নভেম্বর সৌদি আরবের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে অভিযান শুরু করবে দুই বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।