বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন ভাঙল যাদের

চোটের কারণে কাতার আসরে নেই যে সকল ফুটবলার।

আবু হোসেন পরাগবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2022, 05:20 AM
Updated : 20 Nov 2022, 05:20 AM

প্রতিটা ফুটবলারই লালন করেন বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন। কাতার বিশ্বকাপে সেই স্বপ্ন পূরণের অপেক্ষায় ছিলেন অনেকেই। আবার কেউ দ্বিতীয়বার বিশ্ব মঞ্চে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু বিধি বাম! চোটের জন্য চুরমার হয়ে গেছে তাদের সব স্বপ্ন-আশা। 

রোববার শুরু বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কয়েক জন ফুটবলারকে নিয়ে এই আয়োজন। 

পল পগবা (ফ্রান্স) 

কাতার বিশ্বকাপে পগবার খেলা নিয়ে শঙ্কা ছিল অনেক আগে থেকেই। গত গ্রীষ্মের দলবদলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে তিনি ইউভেন্তুসে যোগ দেন। জুলাইয়ে ইতালিয়ান দলটির প্রাক-মৌসুম সফরের সময় ডান হাঁটুতে চোট পান এই মিদফিল্ডার। 

শুরুতে বিশ্বকাপ খেলার ঝুঁকি বিবেচনায় অস্ত্রোপচার করানোর পক্ষে ছিলেন না পগবা। পরে অস্ত্রোপচার করাতে রাজি হন তিনি। ওই সময় তার ক্লাব ইউভেন্তুস কোচ মাস্সিমিলিয়ানো আল্লেগ্রি বলেন, আগামী জানুয়ারির আগে পগবার মাঠে ফেরার সম্ভাবনা দেখেন না তিনি। 

তবে অক্টোবরের মাঝামাঝি পগবা ইউভেন্তুসের অনুশীলনে ফিরলে অনেক করে জাগে আশা। ফ্রান্স কোচ দিদিয়ে দেশম অবশ্য আগেই স্পষ্ট করে দেন, শতভাগ ফিট না হলে কাউকে বিশ্বকাপ দলে রাখা হবে না। অক্টোবরের শেষ দিন পগবার এজেন্ট নিশ্চিত করে দেন, বিশ্বকাপের আগে পুরোপুরি সেরে ওঠার সম্ভাবনা নেই ২৯ বছর বয়সী এই ফুটবলারের। 

ফ্রান্সের ২০১৮ বিশ্বকাপ জয়ে পগবার ছিল বড় অবদান। 

এনগোলো কঁতে (ফ্রান্স) 

চার বছর আগে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ে মাঝমাঠে বড় ভরসা ছিলেন কঁতে। তাকেও এবার পাচ্ছে না বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। ক্লাব চেলসির হয়ে গত অগাস্টে টটেনহ্যাম হটস্পারের বিপক্ষে ম্যাচে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পান তিনি। 

এরপর ছিলেন পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায়। অক্টোবরের শুরুতে অনুশীলনের সময় আবার চোট পান তিনি। অস্ত্রোপচারের পর আরও চার মাসের জন্য মাঠের বাইরে ছিটকে যান ৩১ বছর বয়সী ফুটবলার। 

এই মৌসুমে চেলসির হয়ে কেবল দুটি ম্যাচ তিনি খেলেছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে। 

টিমো ভেরনার (জার্মানি) 

এই মাসের শুরুতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে শাখতার দেনেৎস্কের বিপক্ষে লাইপজিগের ম্যাচে গোড়ালির গাঁটে চোট পান ভেরনার। পরদিন তার ক্লাব জানায়, চলতি বছর আর মাঠে ফেরার সম্ভাবনা নেই ২৬ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডের। 

২০১৮ বিশ্বকাপে খেলা ভেরনারকে হারানো জার্মানির জন্য বড় ধাক্কা। হান্স ফ্লিকের দলে মূল স্ট্রাইকার হিসেবে নিয়মিত খেলছিলেন তিনি। সবশেষ ছিলেন এবারের উয়েফা নেশন্স লিগের গত সেপ্টেম্বরের গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলোর দলে। জাতীয় দলে ২০১৭ সালে অভিষেকের পর থেকে এখনও পর্যন্ত ৫৫ ম্যাচ খেলে ২৪ গোল করেছেন তিনি। 

রিস জেমস (ইংল্যান্ড) 

গত অক্টোবরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এসি মিলানের বিপক্ষে চেলসির জয়ের ম্যাচে হাঁটুতে চোট পান জেমস। মাঠে চিকিৎসা দেওয়ার পর তাকে উঠিয়ে নেওয়া হয়। পরে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজের দলটি জানায়, আট সপ্তাহের জন্য মাঠের বাইরে থাকতে হবে ২২ বছর বয়সী এই রাইট-ব্যাককে। 

২০২০ সালের অক্টোবরে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক থেকে এখনও পর্যন্ত ইংল্যান্ডের হয়ে ১৫ ম্যাচ খেলেছেন জেমস। ফিট থাকলে নিশ্চিতভাবেই গ্যারেথ সাউথগেটের বিশ্বকাপ দলে থাকতে তিনি। প্রথমবার বৈশ্বিক আসরে খেলার স্বপ্নটা তার স্বপ্নই রয়ে গেল এবার। 

দিয়োগো জটা (পর্তুগাল) 

প্রিমিয়ার লিগে গত অক্টোবরে ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে লিভারপুলের জয়ের ম্যাচে পায়ের পেশিতে চোট পান জটা। স্ট্রেচারে করে মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। একদিন পর লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ নিশ্চিত করে দেন, বিশ্বকাপে খেলতে পারবেন না ২৫ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড। অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন না হলেও লম্বা সময় তাকে মাঠের বাইরে থাকতে হবে বলে জানান ক্লপ। 

২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষিক্ত জটা পর্তুগালের হয়ে এখন পর্যন্ত ২৯ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন ১০টি। গত ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে শেষ ষোলো থেকে বিদায় নেওয়ার আগে দলের সব ম্যাচেই খেলেন তিনি। কিন্তু বিশ্বকাপে খেলার আশা পূরণ হলো না। তাকে হারানো ফের্নান্দো সান্তোসের দলের জন্য বড় ধাক্কাই।                                                                                

আর্থার মেলো (ব্রাজিল) 

ইউভেন্তুস থেকে ধারে লিভারপুলের হয়ে খেলা আর্থার গত অক্টোবরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রেঞ্জার্সের বিপক্ষে ম্যাচে পায়ের পেশিতে চোট পান। ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার পরে নিজেই জানান, বিশ্বকাপে খেলা হচ্ছে না তার। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবার ব্রাজিল দলে ডাক পেলেও তার অভিষেক হয় পরের বছরের সেপ্টেম্বরে। তাই এখনও বিশ্বকাপে খেলা হয়নি ২৬ বছর বয়সী এই ফুটবলারের। 

জিওভানি লো সেলসো (আর্জেন্টিনা) 

এই মাসের শুরুর দিকে লা লিগায় ভিয়ারিয়ালের হয়ে আথলেতিক বিলবাওয়ের বিপক্ষে ম্যাচে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন লো সেলসো। পরে ক্লাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, চোট সারাতে অস্ত্রোপচার করাতে হবে তার। এতে শেষ হয়ে যায় তার বিশ্বকাপে খেলার সম্ভাবনা। 

লিওনেল স্কালোনির আর্জেন্টিনা দলে মাঝমাঠের বড় ভরসা তিনি। বিশ্বকাপের দল ঘোষণার সময় স্কালোনি যেমন বলেন, লো সেলসোর বদলি হয় না। 

২০১৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দলে ছিলেন লে সেলসো। তবে কোনো ম্যাচ তার খেলা হয়নি সেবার। এবার বিশ্ব মঞ্চেই যেতে পারলেন না।

মার্কো রয়েস (জার্মানি) 

অ্যাঙ্কেলের চোট থেকে সময়মতো সেরে না ওঠায় জার্মানির বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাননি বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের অধিনায়ক মার্কো রয়েস। একই চোট ২০১৪ বিশ্বকাপ থেকেও ছিটকে দিয়েছিল তাকে। 

সেবার বাছাইপর্বে ছয় ম্যাচে পাঁচটি গোল ও তিনটি অ্যাসিস্ট করে বিশ্বকাপ দলে ডাক পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু প্রস্তুতি ম্যাচে চোট পেয়ে ভেঙে যায় প্রথমবার বিশ্বকাপের খেলার স্বপ্ন। তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয় ২০১৮ রাশিয়া আসরে। চোটে না পড়লে কাতার আসরের দলেও সুযোগ পেতেন জার্মানির হয়ে ৪৮ ম্যাচে ১৫ গোল করা এই উইঙ্গার। 

বেন চিলওয়েল (ইংল্যান্ড) 

এই মাসের শুরুর দিকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে দিনামো জাগরেবের বিপক্ষে চেলসির জয়ের ম্যাচে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পান চিলওয়েল। যা তাকে ছিটকে দেয় বিশ্বকাপ থেকে। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক থেকে ইংল্যান্ডের হয়ে এখন পর্যন্ত তিনি ম্যাচ খেলেছেন ১৭টি। 

প্রেসনেল কিম্পেম্বে (ফ্রান্স) 

ফ্রান্সের হয়ে ২০১৮ বিশ্বকাপ জেতা কিম্পেম্বে দেখছিলেন আরেকটি বৈশ্বিক আসরে খেলার স্বপ্ন। এই মাসের শুরুতে তার হ্যামস্ট্রিং চোটের কথা জানায় ক্লাব পিএসজি। তবু বিশ্বকাপের জন্য দিদিয়ে দেশমের প্রাথমিক দলে সুযোগ পেয়েছিলেন এই সেন্টার-ব্যাক। কিন্তু চূড়ান্ত দলে আর সুযোগ হয়নি। 

ত্রিস্তোফা এনকুনকু (ফ্রান্স) 

এনকুনকুর কষ্টটা যেন একটু বেশিই। ফ্রান্সের চূড়ান্ত দলে সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। হাতছানি ছিল প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলার। কিন্তু গত মঙ্গলবার অনুশীলনের সময় সতীর্থ এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গার সঙ্গে সংঘর্ষে হাঁটুর লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২৫ বছর বয়সী স্ট্রাইকারের। যা তাকে ছিটকে দেয় বিশ্বকাপ থেকে। 

গত মার্চে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষিক্ত এনকুনকু ফ্রান্সের হয়ে এখন পর্যন্ত আট ম্যাচ খেলে কোনো গোল অবশ্য করতে পারেননি। তবে ক্লাব লাইপজিগের হয়ে এই মৌসুমে দারুণ ছন্দে ছিলেন তিনি। বিশ্বকাপ বিরতির আগে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২৩ ম্যাচে গোল করেন ১৭টি। 

সাদিও মানে (সেনেগাল) 

এই মাসের শুরুর দিকে বুন্ডেসলিগায় ভার্ডার ব্রেমেনের বিপক্ষে বায়ার্ন মিউনিখের জয়ের ম্যাচে হাঁটুতে চোটে পান মানে। তখন থেকেই তাকে নিয়ে জাগে শঙ্কা। 

সেনেগাল কোচ আলিয়ু সিসে তবু বিশ্বকাপে মানেকে পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। তাকে নিয়েই ঘোষণা করা হয় চূড়ান্ত দল। পরে দেশটির ফুটবল ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘শুরুতে একাধিক ম্যাচে’ খেলতে পারবেন না মানে। 

আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায়, চোট সারিয়ে তুলতে অস্ত্রোপচার করাতে হবে মানের। এতেই শেষ হয়ে যায় সেনেগালের সবচেয়ে বড় তারকার বিশ্বকাপ খেলার সম্ভাবনা। 

এর আগে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলেছেন মানে। কাতার আসর হতে পারত ৩০ বছর বয়সী ফরোয়ার্ডের টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। 

হোয়াকিন কোররেয়া ও নিকোলাস গনসালেস, আর্জেন্টিনা 

দুই জনই জায়গা পান লিওনেল স্কালোনির চূড়ান্ত দলে। দলের সঙ্গে তারা আসেন আবু ধাবিতে। সেখানে গত বুধবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে ৫-০ ব্যবধানে জয়ের প্রীতি ম্যাচে বদলি নেমে একটি গোলও করেন কোররেয়া। কিন্তু অস্বস্তি অনুভব করার পর পরীক্ষায় তার ‘অ্যাকিলিস টেন্ডনে’ চোট ধরা পড়ে। 

আর দলের অনুশীলনের সময় পেশিতে চোট পান গনসালেস। এতে দুই ফরোয়ার্ডই ছিটকে যান বিশ্বকাপ থেকে। দুজনের সামনেই ছিল প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলার হাতছানি। 

তাদের দুর্ভাগ্যে কপাল খুলে যায় ফরোয়ার্ড আনহেল কোররেয়া ও মিডফিল্ডার থিয়াগো আলমাদার। বদলি হিসেবে এই দুজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় দলে।

করিম বেনজেমা (ফ্রান্স)

ঊরুর চোটে বিশ্বকাপ শুরুর ২৪ ঘণ্টারও কম সময় বাকি থাকতে সব স্বপ্ন তছনছ হয়ে যায় বেনজেমার।

চলতি মৌসুমের শুরু থেকেই চোট ভোগাচ্ছিল রিয়াল মাদ্রিদ তারকাকে। মৌসুমের শুরুতে তিনি চোট পান হাঁটুতে, পরে পায়ের পেশিতে। ফলে বিশ্বকাপের আগে ক্লাবের সবশেষ চার ম্যাচে খেলতে পারেননি ৩৪ বছর বয়সী স্ট্রাইকার।

ওই চোট কাটিয়ে শনিবার পুরোদমে জাতীয় দলের সঙ্গে অনুশীলনে যোগ দেন বেনজেমা। তবে নতুন করে পাওয়া চোটের কারণে অনুশীলন শেষ করতে পারেননি বলে তখন জানায় ফ্রান্সের ক্রীড়া পত্রিকা লেকিপে ও আরএমসি স্পোর্ট।

পরে ফ্রেঞ্চ ফুটবল ফেডারেশন নিশ্চিত করে দেয়, বিশ্বকাপে পাওয়া যাবে না এবারের ব্যালন ডি’অর জয়ীকে।

২০১৪ বিশ্বকাপে খেলা বেনজেমা মাঝে সেক্সটেপ কাণ্ডে সতীর্থকে ব্ল্যাকমেইল করার অভিযোগে জাতীয় দলের বাইরে ছিলেন সাড়ে পাঁচ বছর। গত মৌসুমে রিয়ালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও লা লিগা জয়ে বড় অবদান রাখা তারকা আশায় ছিলেন দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপে খেলার। খুব কাছে এসে শেষ হয়ে গেল সব আশা।