আর্জেন্টিনার ‘অ্যালবাট্রস’ আলিস্তের

পোল্যান্ড ম্যাচে গোলের জন্য ধুঁকতে থাকা আর্জেন্টিনার জন্য সৌভাগ্যের পাখি হয়েই এলেন এই মিডফিল্ডার।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরদোহা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Dec 2022, 07:12 AM
Updated : 1 Dec 2022, 07:12 AM

১৯৯৮ সালে বড়দিনের ঠিক আগের দিন অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বরে জন্ম শিশুটির। বড়দিনের আগে পৃথিবীর আলোয় আসা বলে সান্তা রোসার ধনী পরিবারটির কাছে সে হয়ে উঠল সৌভাগ্যের বার্তাবাহক। সেই শিশুটি আজকের ২৩ বছর বয়সী মিডফিল্ডার আলেক্সিস মাক আলিস্তের। যিনি এখন আর্জেন্টিনার জন্যও যেন সৌভাগ্যের বার্তাবাহক ‘অ্যালবাট্রস’ পাখি!

সবশেষ পোল্যান্ড ম্যাচেও যিনি হতাশার সমুদ্রে গোলের জন্য খাবি খেতে থাকা দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের গোল করে দেখিয়ে দিয়েছেন গ্রুপ সেরা হয়ে নকআউট পর্বে ওঠার পথটা।

কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার শুরুটা সৌদি আরবের কাছে হেরে। ওই হারের ধাক্কায় হেলে পড়া আলবিসেলেস্তাদের বিশ্বকাপ স্বপ্ন ফের উঠে দাঁড়ায় মেক্সিকোর বিপক্ষে পাওয়া জয়ে। কিন্তু তাতে ছিটকে পড়ার শঙ্কার দোলুনি কমে না পুরোপুরি। পোল্যান্ডের বিপক্ষে তাই লিওনেল স্কালোনির দল নামে আরেকটি ‘ফাইনাল’ খেলতে। হারলে বাজবে বিদায়ের ঘণ্টা, ড্র করলে ভাগ্য অন্যদের হাতে, সেখানে জয়ই একমাত্র ‘সহজ’ সমাধান। কিন্তু স্টেডিয়াম ৯৭৪-এর আঙিনায় জয়ের জন্য দরকারি গোলের দেখা যে নেই।

শুরু থেকে আক্রমণের ঝড় বয়ে যায়, কিন্তু দূর্ভেদ্য দেয়াল তুলে পোল্যান্ডকে আগলে রাখেন গোলরক্ষক ভয়চেখ স্ট্যাসনি। লিওনেল মেসি, আনহেল দি মারিয়াদের মরিয়া প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে বারবার। মার্কোস আকুনিয়ার জোরাল শট পোস্ট ঘেঁষে বেরিয়ে যায়, ৩২তম মিনিটে দি মারিয়ার কর্নারে বাঁক খেয়ে দূরের পোস্ট দিয়ে ঢোকার আগে স্ট্যাসনির থাবায় হয়ে যায় কর্নার।

৩৫তম মিনিটে আক্রমণ আটকাতে গিয়ে মেসির মুখে অনিচ্ছাকৃত আঘাত করে বিপদ ডেকে আনেন স্ট্যাসনি। আবার তিনিই ত্রাতা আর্জেন্টিনা অধিনায়কের পেনাল্টি শট ফিরিয়ে। পেনাল্টির ওই সিদ্ধান্ত অবশ্য ছিল কিছুটা বিতর্কিত, মেসির শটও ছিল না যথেষ্ট ভালো। স্নায়ুর চাপ পেয়ে বসায় শট ছিল জাদুহীন, সাদামাটা। ব্যর্থতা আর হতাশার কালিতে লেখা হয় আর্জেন্টিনার প্রথমার্ধের চিত্রনাট্য।

চার ধার দিয়ে এত আক্রমণ, কিন্তু গোলের দেখা নেই। যেন ‘দ্যা রাইম অব দ্যা অ্যানসিয়েন্ট মেরিনার’  নামের গীতিনাট্যের মতো চার দিকে পানি, কিন্তু পান করার মতো একফোটাও নেই-এমন হাহাকার আর্জেন্টিনার শিবিরে। এমন সন্ধিক্ষণে, দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে আলিস্তেরের আগমণ সৌভাগ্যের দূত হয়ে।

ঘড়ির কাঁটায় তখন ৪৬ মিনিট ৮ সেকেন্ড। নাহুয়েল মোলিনার পাস বক্সে পেয়ে কোনাকুনি শট নিলেন তিনি। দূরের পোস্ট দিয়ে ঠিকানা খুঁজে নিল বল। বিশ্বকাপ তো বটেই, আন্তর্জাতিক ফুটবলে গোলের খাতাও খুললেন আলিস্তের। সুযোগ নষ্টের হতাশার সময় পেরিয়ে আর্জেন্টিনাও খুঁজে পেল পথের দিশা। এরপর হুলিয়ান আলভারেসের গোল বাকি দুর্ভাবনার অবসান ঘটিয়ে দলকে পৌঁছে দিল কাঙ্ক্ষিত বন্দরের দোরগোড়ায়।

২০১৯ সালে অভিষেকের পর এ নিয়ে জাতীয় দলের জার্সিতে দশম ম্যাচ খেললেন আলিস্তের। কৌশলী, প্রথম ছোঁয়ায় বলের নিয়ন্ত্রণে পারদর্শী এবং বল বণ্টনে গতিময় ও কার্যকরী বলে ব্রাইটনের এই ফুটবলার আগের নয় ম্যাচের মতো পোল্যান্ডের বিপক্ষেও নেমেছিলেন মাঝমাঠের সুর বেঁধে দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে। যদিও তার ক্যারিয়ারের বাঁকে বাঁকে বঞ্চনার ফিরিস্তিও কম নয়!

আর্জেন্টিনার হয়ে দুটি ম্যাচ খেলার পর আড়াই বছর দলে ব্রাত্য ছিলেন আলিস্তের। আন্তর্জাতিক ফুটবলের আলো থেকে বেশ দূরে থাকা এই মিডফিল্ডার কাতার বিশ্বকাপের বাছাইয়ের দলে জায়গা পেলেন বটে, কিন্তু করোনাভাইরাসের থাবায় ফেরা হল আরও বিলম্বিত। এরপর ফিরলেন, হাঁটুর চোটে ভুগলেন। ইতালির বিপক্ষে ওয়েম্বলিতে ফিনালিস্সিমার ফাইনালে বদলি তালিকায় থাকলেও পেলেন না খেলার সুযোগ। তারপরও আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ দলে জায়গা পেলেন আলিস্তের।

কিন্তু কাতার বিশ্বকাপেও শুরুতে ফের উপেক্ষিত আলিস্তের। সৌদি আরবের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পেলেন না। শুরুতে এগিয়ে গিয়ে পরে পথ হারিয়ে আর্জেন্টিনা ডুবল ২-১ গোলের হতাশায়। মেক্সিকো ম্যাচের একাদশ তাকে রেখে সাজালেন স্কালোনি, ২-০ গোলের জয়ে ভেসে উঠল আর্জেন্টিনার ডুবন্ত তরি। পোল্যান্ডের বিপক্ষের মহারণেও শুরু থেকে আস্থা আলিস্তেরে, এবার দিশেহারা দলকে গোল এনে দিয়ে দেখালেন ঠিকানায় পৌঁছানোর পথ!                                                         

এই আলিস্তেরকে এখন থেকে ‘সৌভাগ্যের পাখি’ অ্যালবাট্রস নামে ডাকতেই পারেন আর্জেন্টাইন সমর্থকরা।