বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দুই মারিয়ার গল্প

পাকিস্তানের মারিয়া জামিল খানের চেয়ে নিজেদের মারিয়াকে এগিয়ে রাখছেন গোলাম রব্বানী ছোটন-সাবিনা খাতুনরা।

কাঠমান্ডু থেকে মোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Sept 2022, 02:18 PM
Updated : 8 Sept 2022, 02:18 PM

দুজনের নাম মারিয়া। দুজনেই ফুটবলার। বাংলাদেশের মারিয়া মান্দার সাথে পাকিস্তানের মারিয়া জামিল খানের মিল বলতে এতটুকুই। দুজনের বেড়ে ওঠা, চলন-বলন-গড়ন, জীবনের পথচলার প্রতিটি বাঁকের গল্প একেবারেই ভিন্ন। বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচে মুখোমুখি হবেন দুজনে। এগিয়ে কে? বাংলাদেশ অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের সোজাসাপ্টা উত্তর-আমাদের মারিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের মারিয়ার তুলনাই চলে না।

মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে এবার মালদ্বীপকে ৩-০ গোলে হারিয়ে রঙিন শুরু পেয়েছে বাংলাদেশ। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের কাছে একই ব্যবধানে হেরেছে পাকিস্তান। আগামী শনিবার মুখোমুখি হবে দুই দল। দুই মারিয়া তাই ভিন্ন অনুভূতি নিয়ে মুখোমুখি হবেন। বাংলাদেশের মারিয়া নামবেন জয়ের সুবাস মেখে, হারের বিষাদ সঙ্গী পাকিস্তানের মারিয়ার।

বিত্ত-বৈভব, খ্যাতির মধ্যে বেড়ে ওঠা পাকিস্তানের মারিয়ার। খেলাধুলায় তার পরিবারের ঐতিহ্যও ঈষর্ণীয়। দাদা হাশিম খান, চাচা জাহাঙ্গীর খান স্কোয়াশের কিংবদন্তি। হাশিম ব্রিটিশ ওপেন জিতেছেন সাতবার, জাহাঙ্গীর ওয়ার্ল্ড ওপেন ছয়বার, ব্রিটিশ ওপেন জিতেছেন টানা দশবার। পাকিস্তানের পেশোয়ারের এই বিখ্যাত খান পরিবারের উত্তরসূরি মারিয়া বড় হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোর আলো-বাতাসে। শৈশবে পা পড়েছিল স্কোয়াশের আঙিনায়, বাস্কেটবলও খেলেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হৃদয়ের টানে বেছে নিয়েছেন ফুটবল।

তার ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্পেও আছে রোমাঞ্চ। ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয় দলে তার ভূমিকা ছিল গোলরক্ষক। ২০১৩ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি করতে গিয়েছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে, সেখানে মাঝমাঠ সামলেছেন। বর্তমানে ডিফেন্ডার। খুব সম্ভবত আরেকটি বিরল কীর্তিও গড়া হয়ে গেছে তার। গত মঙ্গলবার ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই যে মারিয়ার খেলোয়াড় ও অধিনায়ক হিসাবে আন্তর্জাতিক অভিষেক!

বিপরীতে বাংলাদেশের মারিয়ার বেড়ে ওঠা লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। খান পরিবারের মতো ঐতিহ্য তার ছিল না। বরং সঙ্গী ছিল অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। যে বাবার শক্ত হাত ধরে স্বপ্ন দেখার পথে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেই হাতটিও তিনি হারান মাত্র তিন বছর বয়সে। পরিবারকে অথৈ সাগরে ফেলে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বীরেন্দ্র মারাত।

শুরু হয় মা এনতা মান্দার একক সংগ্রাম। চার ছেলে-মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিতে কখনও ধান লাগিয়েছেন, ধান কেটেছেন, কখনও গৃহকর্মীর কাজও করেছেন। শৈশবে জীবনের কঠিন রূপ দেখা মারিয়া চেষ্টা করতেন নরম তুলতুলে হাতে মায়ের কাজে সাহায্য করতে, কিন্তু মা এটা চাননি, তিনি চেয়েছিলেন মেয়ের হাতে বই দেখতে। সেই সুবাদে মারিয়ার ময়মনসিংহের কলসিন্দুর স্কুলে যাওয়া এবং মফিজ উদ্দিন স্যারের হাত ধরে ফুটবলের সবুজে পা রাখা। এখন তিনি বাংলাদেশ দলের মাঝমাঠের প্রাণভোমরা, পরিবারেরও।

এবারের সাফে দুই মারিয়ার পথচলাও শুরু হয়েছে ভিন্নভাবে। পাকিস্তানের মারিয়া অভিষেক ম্যাচে দুর্ভাগ্যের ফেরে করেছেন আত্মঘাতী গোল। বাংলাদেশের মারিয়া মালদ্বীপ ম্যাচেও আলো ছড়িয়েছেন। মাসুরা পারভীনের গোলের সুরটা বেঁধে দেন ১৯ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার।

দুই মারিয়াকে নিয়ে বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়, কোচদের সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দেখার অভিজ্ঞতা থেকে দুই মারিয়াকে মূল্যায়ন করেছেন তারা। সেখানে ধোবাউড়ার ধুলেমাখা পথ পেরিয়ে, শতবাধা মাড়িয়ে এতদূর আসা মারিয়া যোজন যোজন এগিয়ে।

কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের মতে, তার মারিয়া বিশেষ প্রতিভা।

“ও হচ্ছে গড-গিফটেড প্লেয়ার। মাঠে প্রতিটি মুহূর্তে ওর দৃঢ়তা, মানসিকতা, আত্মবিশ্বাস (ফুটে ওঠে)…ও একজন ফাইটার। বলের নিয়ন্ত্রণে ও খুবই ভালো। পাকিস্তানের মারিয়ার তুলনায় আমাদের মারিয়া অবশ্যই অনেক ফিট।”

ছোটনের মতো সহকারী কোচ মাহবুবুর রহমান লিটু দীর্ঘদিন কাছ থেকে দেখছেন মারিয়াকে। তার চোখে ম্যাচের সুর বেঁধে দেওয়ার বেলায় জুড়ি নেই এই মিডফিল্ডারের।

“সে আমাদের মূল খেলোয়াড়, সেই দলটাকে খেলায়। চেষ্টা করে দলকে ধরে রাখার। পাসিংয়ে আগের চেয়ে অনেক উন্নতি করেছে, আসলে ভালোর তো কোনো শেষ নেই। মারিয়া আসলেই গড-গিফটেড খেলোয়াড়। ওর টার্ন, মুভ অনেক আলাদা, অনেকের চেয়ে ব্যাতিক্রম, বল হোল্ড করার ক্ষমতা বেশি।”

দুই মারিয়ার তুলনার প্রসঙ্গ পাড়তেই বিস্ময়ভরা চোখে তাকালেন বাংলাদেশ অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। তুলনার কোনো সুযোগই যে দেখছেন না তিনি!

“ওদের মারিয়ার খেলা গতকাল দেখেছি, ওর কিছু লং শট দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে ও ভালো খেলোয়াড়, কিন্তু আমাদের মারিয়ার সঙ্গে ওর তুলনা করা যায় না, আমাদের মারিয়া অনেক ভালো। আমাদের মারিয়া খেলা তৈরি করতে পারে, ওর টার্নিং, পজিশনাল সেন্স সবকিছুই ভালো।”

মারিয়া নিজে কী ভাবছেন? পাকিস্তানের প্রতিপক্ষকে অবশ্য প্রশংসা করলেন তিনি। তবে প্রাণখোলা হাসিতে জানিয়ে দিলেন নিজের লক্ষ্য, স্বপ্ন।

“ওদের মারিয়ার খেলা দেখেছি, ও অনেক ভালো খেলে। আমি চেষ্টা করব ওর চেয়ে ভালো খেলার এবং আমার দল যেন জিতে, সে জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”

ভারত ম্যাচের পরের সংবাদ সম্মেলনে দৃপ্ত কণ্ঠে মারিয়া জামিল খানও বলেছিলেন, পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানের ফুটবলকে এগিয়ে নিতে চান তিনি। জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ ম্যাচ নিয়েও নিজের ভাবনা।

“বাংলাদেশের বিপক্ষেও আমাদের একই প্রস্তুতি থাকবে। একই মানসিকতা নিয়ে আমরা খেলতে নামব। যেটা আমাদের হোম-ওয়ার্ক থাকবে, সেগুলো করব।”

জীবনের গল্পে দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা হলেও ফুটবল নিয়ে চাওয়া, স্বপ্ন কিন্তু একই। বাংলাদেশ-পাকিস্তান দ্বৈরথে কোন মারিয়ার মুখে জয়ের হাসি ফুটবে, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা। জীবনের কঠিন মঞ্চে স্বপ্নবাজ ও সংগ্রামীরা জয়ী হয়-এটা মানলে পাল্লা ভারি কিন্তু বাংলাদেশের মারিয়ারই।