বাংলাদেশের জার্সি পরা আমার জন্য ঐতিহাসিক মুহূর্ত: কিংসলে

বাংলাদেশের হয়ে অবশেষে খেলতে পেরেছি, ঐতিহাসিক দিন আমার এবং আমার পরিবারের জন্য, বলেছেন এই ফরোয়ার্ড।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরসিলেট থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 March 2023, 02:08 AM
Updated : 26 March 2023, 02:08 AM

হোটেলের লবিতেই দেখা এলিটা কিংসলের সঙ্গে। স্ত্রী ও একমাত্র মেয়ের সঙ্গে সোফায় বসে গল্পে মেতে আছেন। একটু কথা বলতে চাইলে আগ্রহভরে সাড়া দিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় মেতে উঠলেন। সেখানে বাংলাদেশের হয়ে অভিষেকের স্বপ্ন পূরণ, জয় পাওয়া, সুযোগ হারানোসহ নানা বিষয়ে কথা বললেন খোলা মনে। 

কথপোকথনের এক পর্যায়ে এলো সাহসিকতার প্রসঙ্গ। নাইজেরিয়ান থেকে ২০২১ সালে বাংলাদেশি হয়ে যাওয়া কিংসলে মেলে ধরলেন এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ। 

২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে খেলা কিংসলে ২০১২ সালে বিয়ে করেন বাংলাদেশের মেয়ে লিজা জাফরকে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। তা পেয়েও যান ২০২১ সালে। এরপর ফিফা ও এএফসির সম্মতি পাওয়া সংক্রান্ত নানা জটিলাতার বাঁক পেরিয়ে অবশেষে সিশেলসের বিপক্ষে খেললেন তিনি। লাল-সবুজের জার্সি পরতে ছোটাছুটির সেই দিনগুলোর দিকেও পিছু ফিরে দেখলেন ৩৩ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড। 

শেষ পর্যন্ত স্বপ্নটা সত্য হলো, কেমন লাগছে? 

এলিটা কিংসলে: এটা আমার জন্য ঐতিহাসিক বিষয়। যে অনুভূতি আসলে ভাষায় প্রকাশ করার নয়। খুব খুব ভালো লাগছে। বাংলাদেশের হয়ে অবশেষে খেলতে পেরেছি, ঐতিহাসিক দিন আমার এবং আমার পরিবারের জন্য। 

বাংলাদেশ-মালাবির বিপক্ষের প্রস্তুতি ম্যাচে খেলেছিলেন, সেটা আন-অফিসিয়াল ম্যাচ ছিল। সিশেলসের বিপক্ষে অফিসিয়াল ম্যাচে অভিষেক হলো। এখন তো আপনি অফিসিয়ালি বাংলাদেশি খেলোয়াড়…।

বিংসলে: (হাসি) যেটা একটু আগেও বলছিলাম, এটা আমার জন্য বিশাল ব্যাপার এবং আমি অভিষেক ম্যাচে জয়ের স্বাদও পেয়েছি। এই মুহূর্তটা নিয়ে আমি আসলেই ভীষণ খুশি। 

অভিষেক ম্যাচে জয় পেলেন। গোলটাই কেবল পেলেন না…। 

কিংসলে: দলের জয়ে আমার পুরো অবদান ছিল। বাংলাদেশকে গোল এনে দেওয়ার খুব ভালো সুযোগ পেয়েছিলাম, ব্যবধান দ্বিগুণ করার সুযোগ পেয়েছিলাম, কিন্তু সেটা কাজে লাগাতে পারিনি। দল জেতায় আনন্দ আছে, কিন্তু খুবই খুশি হতাম, যদি স্কোরশিটে নিজের নাম তুলতে পারতাম। বিষয়টা তখন আরও আনন্দদায়ক হতো; কেননা, আমরা স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের হয়ে খেলা এবং অভিষেক ম্যাচে গোল করা। 

যখন জানতে পারলেন সিশেলস ম্যাচে অভিষেক হচ্ছে এবং বাংলাদেশের জার্সিটা পরলেন, তখনকার অনুভূতি কেমন ছিল? 

কিংসলে: সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। তবে কেমন অনুভব করেছিলাম, সেটা বলার আগে বাফুফেকে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই। বাংলাদেশের হয়ে আমার খেলতে চাওয়াটা তারা ভালোবাসা দিয়ে অনুভব করেছে। তারা সবসময় আমার পাশে থেকেছে এবং আমার বাংলাদেশের হয়ে খেলার জন্য সব চেষ্টাই করেছে। এজন্য বাফুফেকে শুরুতেই ধন্যবাদ জানাতে চাই। 

আমাকে চ্যালেঞ্জ জয়ের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য কোচকেও (হাভিয়ের কাবরেরা) ধন্যবাদ জানাতে চাই। আজ আমার খেলাটা তিনি নিশ্চিত করেছেন। শুরুতে আমাকে ২৩ জনের চূড়ান্ত দলে রেখেছিলেন এবং আজ সুযোগ দিয়েছেন বদলি হিসেবে খেলার। এগুলোই আমাকে মানসিকভাবে আরও শক্তি যুগিয়েছিল। 

একটু পেছনে ফেরা যাক। যখন বারবার চেষ্টা করেও বাংলাদেশের হয়ে খেলার সুযোগ পাচ্ছিলে না, তখনকার অনুভূতি কেমন ছিল? 

কিংসলে:  চেষ্টা করে যাওয়া, আরও ভালো খেলে যাওয়ার মনোভাবটা ছিল আমার অনুপ্রেরণা।  ন্যাচারালি আমি মনে করি, আমি যত বেশি লড়াই করব, মানুষ আমার চেষ্টা তত বেশি দেখবে। তো বাফুফে যখন আমাকে প্রথম দলে ডাকল, আমার মনে হলো যদি আমি ব্যর্থ হই, তাহলে সবকিছু এখানেই শেষ হয়ে যাবে। এ কারণে সব সুযোগ নিমিষেই শেষ হয়ে যেতে পারে-এমনটা ভেবে আমি নিজেকে আরও বেশি পুশ করতে থাকতাম। 

পরিবারের সবাই খুব পাশে ছিল এবং আমিও ভাবতাম, আমার স্বপ্ন জাতীয় দলে খেলা, দেখি চেষ্টা করে (সেটা পূরণ করতে পারি কিনা)। সেই চেষ্টা করে যাওয়ার প্রতিদান পেলাম আজ। 

৩৩ বছর বয়সে নতুন শুরু করলেন। নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে। কতদিন চালিয়ে যেতে চান? 

কিংসলে: মানুষের এটা জানা দরকার, আমার যে বয়স, সেটা ফুটবলের দিক থেকে দেখতে গেলে যে বিষয়টা গুরুত্ব দিতে হবে, সেটা হচ্ছে আমি কিভাবে নিজের শরীরটাকে যত্ন নেই, দেখভাল করি, সেদিকে। নিজের শরীরটাকে আমি সেভাবেই যত্ন করি। কেননা, আমি জানি আমি খেলতে চাই। দীর্ঘদিন ধরেই শরীরের এই যত্ন নিয়ে আসছি। সেটা যদি না করতাম, তাহলে নানা চোটে পড়ে এই বয়সে আমি ফুটবল খেলতে পারতাম না। আমি নিজের চ্যালেঞ্জটা জানি এবং খেলা চালিয়ে যেতে চাই। 

তাছাড়া দেখুন, এখানে কিছু জিনগত বিষয়ও আছে। এই যে আমার মেয়ে (পাশে বসে থাকা শাফিরার দিকে দেখিয়ে) ওর বয়স মাত্র ৯ বছর, কিন্তু দেখুন ও কতটা লম্বা হয়ে উঠেছে। ওর গড়ন দেখে কী বোঝা যায় ওর বয়স এত কম? তো যেটা হতে চাই, সেটা হতে আমার মতো মানুষের জন্য অতিরিক্ত একটু চেষ্টা করতে হয় আরকি। আমি সেই চেষ্টা চালিয়ে গেছি। 

নাইজেরিয়ান বলেই কি চ্যালেঞ্জ নেওয়ার, সাহসী হয়ে ওঠার বিষয়টি জিনগত? 

কিংসলে: আমি মনে করি, নাইজেরিয়ানদের ভয়ডর কম, তারা সাহসী, তবে জাতিগতভাবে বাংলাদেশিরা আরও বেশি সাহসী। কেননা, বাংলাদেশিরা তাদের স্বাধীনতার জন্য, নিজস্ব ভাষার জন্য লড়াই করেছে-এটাই সাহসিকতা। নিজেদের ভাষার জন্য নাইজেরিয়ানদেরকে কখনও লড়াই করতে হয়নি। যখন আপনি সাহসিকতার কথা বলবেন এবং সেটা জাতিগত দৃষ্টিকোণ থেকে, তখন আমি বলব বাংলাদেশিদের কথা। 

কোন বিষয়টি আপনাকে বাংলাদেশের জার্সি পরতে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল? 

কিংসলে: এই দুই জন (স্ত্রী ও সন্তান)। যখন আমার বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলো (স্ত্রী শুরু করল), তখন এরা জানত না এরা কি করছে? কোথায় যেতে হবে? কিন্তু আমার স্ত্রী বিভিন্ন অফিসে দিনের পর দিন ছোটাছুটি করেছে। এই মন্ত্রণালয় থেকে ওই মন্ত্রণালয় দৌড়াদৌড়ি করে বেড়িয়েছে। অবশেষে আমি যখন বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেলাম, তখন ওর (স্ত্রী) ইচ্ছা হলো যদি বাফুফে আমাকে বাংলাদেশের হয়ে খেলার সুযোগ দেয়, তাহলে আমি যেন খেলি। যে কারণে আজ আমি এখানে। তোমার সামনে বসে কথা বলছি।  

কতদিন এই লাল-সবুজের জার্সির ভার বইতে চান? 

কিংসলে: যতদিন শরীরটা চায়, ততদিন। আগেই বলেছি, আমি শরীরের প্রতি খুব যত্নবান। আশা করি, লম্বা সময় খেলতে পারব বাংলাদেশের হয়ে।