উইমেন’স সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ
শিরোপা জিতিয়ে সরে যাচ্ছেন আরও একজন কোচ, বাংলাদেশের বেলায় কেন এমন হয়?
Published : 31 Oct 2024, 12:19 PM
পেশাদার ফুটবলে কোচ আসা-যাওয়া নতুন কিছু নয়। কিন্তু উইমেন’স সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের এবারের আসরের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের সময়টুকু দেখলে যে কারো মনে প্রশ্ন জাগতে বাধ্য- বাংলাদেশের বেলায় কেন এমন হয়?
অথচ সময়টা হওয়ার কথা কেবলই আনন্দের। ভারতের পর প্রথম দল হিসেবে সাফের শিরোপা ধরে রাখার কীর্তি গড়েছে বাংলাদেশ। কাঠমাণ্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে নেপালকে হারিয়েছে ২-১ গোলে।
দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে যদি হিসাব করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের পুরুষ ফুটবলে সাফের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জয়ের গল্প লেখা হয়েছে একবার, ২০০৩ সালে। মেয়েরা পেয়েছে দুইবার, ২০২২ সালের পর এবার।
ভারতের আধিপত্য ভেঙে গতবার গোলাম রব্বানী ছোটনের হাত ধরে সর্বোচ্চ প্রাপ্তির আনন্দে ভেসেছিল মেয়েরা। স্থানীয় কোচদের ছোট করে দেখার একটা প্রবণতা এই দেশের ফুটবলে আছে, সেটাকে উপেক্ষা করেই মেয়েদের এগিয়ে নিয়েছিলেন ছোটন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, তাকে একসময় বলা হতো ‘মহিলা ফুটবল কোচ।’
চারপাশের অনেক কিছুর কথা ভেবে ছোটন এগুলো মেনে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চোখ রাঙানি এড়িয়ে মেয়েদেরকে ফুটবল খেলতে মাঠে পাঠাবেন, এটা একসময় ছিল অকল্পনীয়। ছোটনের নিশ্চয়তায় তারা আস্থা রেখেছিলেন।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশেনের (বাফুফে) কর্মকর্তারা ‘অবিচারই’ করেছিলেন ছোটনের সঙ্গে। যিনি স্নেহ-শাসনে এই মেয়েদের শৈশব-কৈশরে দেখভাল করেছিলেন, ক্লান্তি শ্রমে-ঘামে যাদেরকে প্রথম সাফ জয়ী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, তার প্রাপ্তির খাতাটা এমন না হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। সাফ জয়ের পর তিনি আর থাকতে পারেননি জাতীয় নারী দলের প্রধান কোচের পদে। কিছুটা অসম্মানজনকভাবে সরে যেতে হয় তাকে।
এরপর সাবিনাদের কোচ হয়ে এসেছেন বাটলার। পেশাদার ফুটবলে তিনি খেলেছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেডে। ইংলিশ এই কোচের কাছে স্নেহ, শাসনের চেয়ে পেশাদারিত্বই মূল কথা। এর মানেটাও পরিষ্কার, গোলাম রব্বানী ছোটন যেখানে ‘নমনীয় শিক্ষক’, সেখানে বাটলার ‘কড়া হেডমাস্টার।’ পারফরম্যান্সকে বেশি গুরুত্ব দেওয়াতেই কিছু দিন আগে চাইনিজ তাইপের বিপক্ষে ম্যাচের স্কোয়াডে রাখেননি সে সময় নিজেকে খুঁজে ফেরা মারিয়া মান্দাকে। ২০২২ সাফ জয়ী তারকার এই বাদ পড়া থেকেই সম্ভবত দ্বন্দ্বের শুরু।
পাকিস্তানের বিপক্ষে এবার নিজেদের প্রথম ম্যাচে মাঝমাঠে গতবারের ‘নিউক্লিয়াস’ মারিয়া মান্দা-মনিকা চাকমা জুটির বিচ্ছেদ ঘটান বাটলার। মনিকার সঙ্গে সুযোগ দেন স্বপ্না রানীকে। ১-১ ড্রয়ের পর মনিকা অভিযোগ করলেন, সিনিয়রদের পছন্দ করেন না কোচ। দলের অন্দরে চলা বিতর্কের স্রোত সামাল দিতে ভারতের বিপক্ষে ফিরল মনিকা-মারিয়া জুটি। বাংলাদেশ পেল ৩-১ গোলের জয়। ওই সময়ই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বাটলার বলেছিলেন, “আই হ্যাভ এ প্ল্যান।”
কোচের সেই প্ল্যান (পরিকল্পনা) দলের কারো জানা ছিল কি-না কে জানে? ভুটানের বিপক্ষে সেমি-ফাইনালের আগে বাটলার করলেন বিস্ফোরক এক মন্তব্য। বললেন, সাবেক কোচেরা দলকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে, মেয়েদের ‘মিথ্যা’ তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করছে। টালমাটাল তরি ভারত জয়ের পর একটু শান্ত হলেও ফের বেসামাল হয়ে গেল।
তবে মেয়েরা মাঠে মেলে ধরল সেরাটা। ভুটানকে ৭-১ গোলে উড়িয়ে উঠে এলো ফাইনালের মঞ্চে। কিন্তু দলের অন্দরে বইতে থাকল বিতর্কের চোরাস্রোত। সিনিয়র বনাম জুনিয়র, পুরোনো বনাম বাটলার দ্বন্দ্ব চলতে থাকল।
ফাইনালের আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সাবিনা বললেন, টুর্নামেন্ট শেষে সব কথা বলবেন। বাটলারও বললেন একই কথা, টুর্নামেন্টটা শেষ হোক, তারপর নিজের অবস্থান পরিষ্কার করবেন।
বাটলার সে অর্থে কথা রাখেননি! ফাইনাল শেষে, পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে নিজেকে ‘উপেক্ষিত’ থাকতে দেখে আর নিজের অনুভূতি আটকে রাখতে পারেননি। এক কথায় বলে দিয়েছেন, মেয়েদের সাথে এটিই তার শেষ ম্যাচ!
বাটলারের এই কথার প্রেক্ষাপট বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ফাইনালে ওঠার পর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) গুটিকয়েক কর্মকর্তা ছাড়া কেউ একটা ফোনও করেননি তাকে! সবাই ব্যস্ত ছিলেন বাফুফের ২৬ অক্টোবরের নির্বাচন নিয়ে, পদ আকঁড়ে থাকা নিয়ে ব্যস্ত। মেয়েদের ফাইনালে ওঠা নিয়ে তাদের খোঁজ নেওয়ার সময় কোথায়!
নির্বাচন শেষে যারা নেপালে পা রেখেছেন, তাদের মধ্যে আছেন টিপু সুলতান। তিনি সাফে ‘হেড অব ডেলিগেশন’ হলেও দলের সঙ্গী হননি বাফুফের নির্বাচনের কারণে। তার সঙ্গে সদস্য নির্বাচিত হওয়া গোলাম গাউস, ইকবাল হোসেন ফাইনালের আগের দিন নেপালে এসে শিরোপা জয়ের পর ছবি তোলায় ছিলেন ভীষণ ব্যস্ত, উৎসাহী। তারাও ফটোসেশনে খোঁজ নেননি বাটলারের। সে সময় ‘আই হ্যাভ এ প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করেছেন বাটলার!
বাংলাদেশকে মুকুট ধরে রাখার অভিযান সফল করার পর এই ইংলিশ কোচ বলে দিয়েছেন, মেয়েদের সাথে আর নয়! পার্থক্য এখানেই। কেউ সাফল্য এনে দিয়ে পথ ছেড়ে দেয়। কেউ কোনো অবদান না রেখেই বাংলাদেশে ‘মহীরূহ’ হয়ে যায়!
তবু থাক সে আলোচনা। প্রচারণাপ্রিয়রা তাদের মতো করে চলতে থাকুক। কিন্তু দেশের ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থা বাফুফে তো একটু পেশাদার হতে পারে। তাই নয় কি? ছোটনের পদ ছেড়ে চলে যাওয়া যেমন অনাকাঙ্ক্ষিত, বাটলারের বিদায় বলে দেওয়াও তো তেমনই অপ্রত্যাশিত! কেউ কারো চেয়ে তো কম নন। একজন দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েদের ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট এনে দিয়েছে, অন্যজন মুকুট ধরে রেখেছে- কে কার চেয়ে কম?
এখানে কম শুধু বাফুফের পেশাদারিত্ব। এসব সামাল দেওয়ার চ্যালেঞ্জও থাকবে নতুন সভাপতি তাবিথ আউয়ালের সামনে।