কোপা আমেরিকা
বদলি নেমে ব্যবধান গড়ে দিয়েছেন ছন্দে থাকা স্ট্রাইকার লাউতারো মার্তিনেস।
Published : 15 Jul 2024, 08:36 AM
চোটের জন্য দ্বিতীয়ার্ধে মাঠ ছাড়লেন লিওনেল মেসি, তবুও মনোবল হারাল না আর্জেন্টিনা। দেশের হয়ে বিদায়ী ম্যাচে নিজেকে উজাড় করে দিলেন আনহেল দি মারিয়া। তবুও তাদের সঙ্গে সমান তালেই লড়াই করছিল কলম্বিয়া। শেষ সময়ে তাদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিলেন লাউতারো মার্তিনেস। ছন্দে থাকা স্ট্রাইকারের নৈপুণ্যে হামেস রদ্রিগেসের দলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকার শিরোপা ধরে রাখল লিওনেল স্কালোনির দল।
ফ্লোরিডার হার্ড রক স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় সোমবার সকালে কলম্বিয়ার ২৮ ম্যাচের অজেয় যাত্রা থামিয়ে ১-০ গোলে জিতল বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। এ নিয়ে চার বছরের মধ্যে তিনটি বড় ট্রফি ঘরে তুলল তারা।
কোপা আমেরিকার ৪৮তম আসরে আর্জেন্টিনার ১৬তম শিরোপা এটি। টুর্নামেন্টের ইতিহাসে তাদের ওপরে নেই আর কোনো দেশ। এত দিন ১৫ শিরোপা নিয়ে সমতায় ছিল উরুগুয়ে।
২০২১ কোপা আমেরিকার পর ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপ। আর এবার ২০২৪ কোপা আমেরিকা- লাতিন আমেরিকার প্রথম দেশ হিসেবে টানা তিনটি বড় শিরোপা জিতল আর্জেন্টিনা। ইউরোপে এই অর্জন আছে শুধু স্পেনের। ২০০৮ ও ২০১২ সালে ইউরো জয়ের মাঝে তারা ২০১০ সালে জিতেছিল বিশ্বকাপ।
২০১৪ থেকে ২০১৬ সালে তিন বছরে বিশ্বকাপ ও দুটি কোপা আমেরিকার ফাইনালে হেরেছিল আর্জেন্টিনা। এবার তিন আসরের তিনটি ট্রফিই ঘরে তুলল তারা। মাঝে টানা ২৮ বছর কোনো শিরোপার স্বাদ না পাওয়া দলটি এবার চার বছরে পেল তিনটি সাফল্য। ১৯৯১ ও ১৯৯৩ সালের পর লাতিন আমেরিকার ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে জিতল টানা দুই শিরোপা।
আগেই অবসরের ঘোষণা দিয়ে রাখা আনহেল দি মারিয়া পেলেন স্বপ্নের মতো বিদায়। গেল ৪ বছরে আর্জেন্টিনার প্রতিটি সাফল্যেরই সাক্ষী তিনি। ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজতেই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে চোখ বেয়ে আনন্দাশ্রু নেমে আসে তার।
জয়সূচক গোলটি করে মাঠের উদযাপন শেষে ডাগআউটে লিওনেল মেসির কাছে ছুটে যান লাউতারো। অ্যাঙ্কেলের চোটে ৬৪ মিনিটে কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়ে যাওয়া মেসি পরম আলিঙ্গনে বুকে জড়িয়ে নেন আরেকটি সাফল্যের নায়ককে।
পুরো টুর্নামেন্টে দারুণ খেলা লাউতারোর এটি ছিল এবারের আসরের পঞ্চম গোল। আসরে আর্জেন্টিনার ৯ গোলের ৫টি একাই করে তিনি এবারের কোপা আমেরিকারও সর্বোচ্চ গোলদাতা।
টিকেটবিহীন দর্শকদের উপদ্রবে দুই দফা পিছিয়ে নির্ধারিত সময়ের ৮০ মিনিট পর শুরু হয় খেলা। ম্যাচের প্রথমার্ধে দাপট দেখায় কলম্বিয়া। দ্বিতীয়ার্ধে ঘুরে দাঁড়ায় আর্জেন্টিনা। বাকি সময় কলম্বিয়াকে চাপে রাখলেও মূল ম্যাচে গোলের দেখা পায়নি তারা।
খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়ালে ৯৭তম মিনিটে হুলিয়ান আলভারেসের জায়গায় লাউতারোকে নামান লিওনেল স্কালোনি। ১৫ মিনিটের মধ্যেই দুই দলের ব্যবধান গড়ে দেন ছন্দে থাকা ২৬ বছর বয়সী স্ট্রাইকার।
পুরো ম্যাচে বল দখলের লড়াইয়ে কিছুটা এগিয়েই ছিল কলম্বিয়া। গোলের জন্য আর্জেন্টিনার চেয়ে ৮টি বেশি শট করে তারা। কিন্তু প্রথমার্ধের ৪টির পর আর লক্ষ্যে রাখতে পারেনি বল। বিপরীতে ১১টি শটের মধ্যে ৬টি লক্ষ্যে শিরোপাজয়ী গোল খুঁজে নেয় আর্জেন্টিনা।
শুরুটা অবশ্য ভালো করেছিল আর্জেন্টিনাই। প্রথম মিনিটে গনসালো মন্টিয়েলের ক্রসে ডি-বক্সের মাঝে বল পেয়ে যান হুলিয়ান আলভারেস। কিন্তু তার ডান পায়ের শট বাম পাশ দিয়ে চলে যায় বাইরে।
এরপর প্রায় ১৫ মিনিট ধরে চলে কলম্বিয়ার দাপট। পঞ্চম মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে বাম পায়ের শট নেন লুইস দিয়াস। নিচু হয়ে গ্লাভসে নেন এমিলিয়ানো মার্তিনেস। এক মিনিট পর ডি-বক্সের ভেতর থেকে হন কর্দোবার শট দূরের পোস্টে লেগে বাইরে চলে যায়। এরপর আরও দুই দফা আর্জেন্টিনার রক্ষণে হানা দেয় কলম্বিয়া। পঞ্চদশ মিনিটে ফ্রি-কিক পেয়ে গোলরক্ষক বরাবর মারেন রদ্রিগেস।
২০তম মিনিটে বড় সুযোগ পায় আর্জেন্টিনা। জায়গা বদলে বাম পাশে চলে আসেন দি মারিয়া। তার ঠাণ্ডা মাথার ক্রস ডি-বক্সে পেয়ে বাম পায়ের শট করেন মেসি। কিন্তু আলভারেসের পায়ে লেগে গতি হারায় বল। ফলে সহজেই ঠেকিয়ে দেন কলম্বিয়া গোলরক্ষক কামিলো ভার্গাস।
৩৩তম মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে আচমকা দূরপাল্লার শট নেন লের্মা। ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়া এমিলিয়ানোর আঙুল ছুঁয়ে বল পোস্টে লেগে বাইরে চলে যায়।
দুই মিনিট পর ডি-বক্সের মুখে বল পেয়ে সান্তিয়াগো আরিয়াসের চ্যালেঞ্জের মুখে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাইলাইনের কাছে পড়ে যান মেসি। কলম্বিয়ার ফুটবলারের সঙ্গে সংঘর্ষে চোট পান ডান পায়ে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে মাঠেই শুশ্রূষা নিয়ে নিজ পায়ে দাঁড়ান আর্জেন্টিনা অধিনায়ক। বিরতির আগের বাকি সময়টায় তাকে খুড়াতে দেখা যায়।
বিরতির পর একই গতিতে চলতে থাকে খেলা। ৪৭তম মিনিটে কর্দোবার ফ্লিকে বল পেয়ে ডি-বক্সের ডান পাশ থেকে আরিয়াসের ডান পায়ের শট অল্পের জন্য দূরের পোস্ট দিয়ে বাইরে চলে যায়।
পরের মিনিটে ডি-বক্সের মধ্যে দারুণ জায়গায় পান আলেক্সিস মাক আলিস্তের। কিন্তু শট করতে পারেননি তিনি। তার আলতো টোকায় বল পেয়ে জোরাল শট করেন দি মারিয়া। খুব কাছ থেকে রুখে দেন কলম্বিয়া গোলরক্ষক।
৫৭তম মিনিটে দি মারিয়ার ক্রসে ডি-বক্সের মাঝ থেকে হেড করেন মাক আলিস্তের। কলম্বিয়ার এক ডিফেন্ডারের হাতে লেগে ফিরে আসে বল। তবে হাত স্বাভাবিক অবস্থানে থাকায় পেনাল্টি পায়নি আর্জেন্টিনা। পরের মিনিটে বাম পাশ থেকে দি মারিয়ার বাম পায়ের প্লেসিং শট বাম দিকে ঝাঁপিয়ে দারুণ ক্ষিপ্রতায় ঠেকান ভারগাস।
এক মিনিট পর চোট ফিরে এলে মাঠে পড়ে যান মেসি। ফিজিও মাঠে ঢুকেই ইঙ্গিত করেন তাকে উঠিয়ে নেওয়ার। তার বদলে মাঠে নামেন নিকোলাস গনসালেস। কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়েন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক। ডাগ আউটে বসেও কাঁদতে থাকেন মেসি। চোট পাওয়া মন্তিয়েলর জায়গায় ৭০তম মিনিটে মাঠে আসেন নাহুয়েল মোলিনা।
৭৫তম মিনিটে ডি-বক্সের ভেতর থেকে আলতো টোকায় বল জালে জড়ান গনসালেস। কিন্তু তাকে পাস দেওয়া তাগলিয়াফিকো অফসাইডে থাকায় মেলেনি গোল।
৮৮তম মিনিটে ডান পাশ থেকে লম্বা ক্রস দেন দি মারিয়া। বাম পাশে পোস্টের কাছাকাছি থেকে লাফিয়ে হেড করেন গনসালেস। অল্পের জন্য দূরের পোস্ট ঘেঁষে বাইরে চলে যায় বল। সময়মতো কাছাকাছি আসতে না পারায় পা ছোঁয়াতে পারেননি আলভারেস।
যোগ করা সময়ের প্রথম মিনিটে কলম্বিয়া ডিফেন্ডারের ভুলে ডি-বক্সের মধ্যে বল পেয়ে যান দি মারিয়া। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শট করতে পারেননি অভিজ্ঞ অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার।
তৃতীয় মিনিটে দি মারিয়ার কর্নার কিক থেকে ক্রিস্তিয়ান রোমেরোর হেডে ডি-বক্সের মাঝে বল পান গনসালেস। কিন্তু তার শট চলে যায় বারের ওপর দিয়ে। মূল ম্যাচের শেষ দিকে দুটি সুযোগ হারিয়ে অতিরিক্ত সময়ে যায় আর্জেন্টিনা।
৯৪তম মিনিটে ডান দিক থেকে ডি-বক্সের মাঝে ক্রস দেন রদ্রিগো ডি পল। গনসালেসের ডান পায়ের শট ডানে ঝাঁপিয়ে ঠেকান ভারগাস। ১০২তম মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে আরিয়াসের জোরাল শটে ডাইভ দিয়ে ব্লক করেন রোমেরো। ফিরতি বল ঠেকান এমিলিয়ানো।
১০৮তম মিনিটে ডান পাশ থেকে দারুণ ক্রস দেন দি মারিয়া। অল্পের জন্য পা ছোঁয়াতে ব্যর্থ হন লাউতারো মার্তিনেস। তবে ৩ মিনিট পর তিনিই হন আর্জেন্টিনার নায়ক।
জিওভানি লো সেলসোর থ্রু বল ধরে ডি-বক্সে ঢুকে গোলরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে বল জালে জড়ান লাউতারো। চলতি কোপা আমেরিকায় এটি তার পঞ্চম গোল।
ম্যাচের ৩ মিনিট বাকি থাকতে বিদায়ী দি মারিয়াকে তুলে নেন স্কালোনি। অশ্রু চোখে আর্জেন্টিনার জার্সিতে শেষবারের মতো মাঠ ছাড়েন তিনি। বদলি হিসেবে নামেন আরেক অভিজ্ঞ নিকোলাস ওতামেন্দি, তিনিও হয়তো শেষবারের মতো খেললেন সিনিয়র দলে।
যোগ করা সময়ের শেষ মিনিটে আর্জেন্টিনার ডি-বক্সে দেখা দেয় উত্তেজনা। তবে হ্যান্ডবল পরীক্ষা করেন ভিএআর রেফারি। সব কিছু ঠিকঠাক থাকায় ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজান রেফারি। আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে আর্জেন্টিনা।
অন্য দিকে 'চূড়ান্ত পরীক্ষায়' হেরে সব হারানোর বেদনায় যেন ভেঙে পড়ে কলম্বিয়া। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে সবশেষ হেরেছিল তারা। সেই দলের বিপক্ষে খেলতে নেমে থামল তাদের অজেয় যাত্রা।