মোহাম্মদ জুবায়েরের ব্লগ
অনেক কিছুর ঘাটতি থাকলেও ফুটবলের প্রাণই যে ভরা গ্যালারি, পাঁড় সমর্থক, তার কমতি নেই নেপাল ফুটবলের।
Published : 30 Oct 2024, 07:01 PM
নেই মানে সবকিছু নেই হয়ে যাওয়া নয়। নেই হয়ে যায়ও না। এই যেমন, এবারের উইমেন’স সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে কাঠমাণ্ডুর রাস্তায় কোনো বিলবোর্ডের দেখা নেই, দশরথ স্টেডিয়ামের গেটেও নেই কোনো ঢাউস ব্যানার। মাঠের ভেতরে গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য নেই প্রথাগত প্রেসবক্স, দর্শকদের মতোই গ্যালারিতে বসে লিখতে হয়! তারপরও যেন সবকিছু বা অনেক কিছু আছে নেপালের ফুটবলের।
যে কোনো আয়োজনে চারদিকে সাজ-সাজ রব, শ্লোগান মুখর পরিবেশ আমাদের বড় চেনা। কী সামাজিক, কী রাজনৈতিক-সব আয়োজনেই বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন দেখতে অভ্যস্ত আমরা। নামগুলো বোল্ড করা থাকে ব্যানারে, পদবী অনুযায়ী। সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েদের ফুটবলের আয়োজন এমন সাদামাটা! খটকা লাগে। ভাবি, কাঠমাণ্ডুতে কেন সবকিছু এমন?
কিছু প্রশ্নের উত্তর মেলে, কিছু মেলে না। ফাইনালে যেমন দশরথের আঙিনায় আসতে একটা প্রশ্নের উত্তর মিলে যায়। ততক্ষণে দুপুরের কড়া রোদের ঝাঁজ কমতে শুরু করেছে, স্টেডিয়াম অভিযোগে ফুটবলপ্রেমীদের স্রোত বাড়তে শুরু করেছে। ফাইনাল উপলক্ষ্যে কোনো বিশেষ প্রচারণার কথা শুনিনি। ঢাকার রাস্তার মতো কোথাও মাইকে ‘আজ বা আগামীকাল ফাইনাল’ এমন আওয়াজও কানে আসেনি, কিন্তু নেপালের ফুটবলপ্রেমীরা তো জানেন, আজ ফাইনাল। সাবিত্রা-আঞ্জিলারা ট্রফির জন্য নামবেন মাঠে। তাই আজ আর ঘরে বসে থাকা নয়।
পল্টনের বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ফুটপ্রেমীরা কেন দলের হয়ে গলা ফাটাতে আসেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে আমাদের ফুটবলের কর্তারা হরহামেশাই বলেন, ট্র্যাফিক জ্যাম। হয়তো, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সদ্য নির্বাচনে জয়ী অনেকেই এসেছেন নেপালে, কাঠমাণ্ডুর রাস্তার যানজট দেখেছেন তারাও। ‘ওয়ান-ওয়ে’ রাস্তা, কিন্তু স্টেডিয়ামের সামনের মোড়ে বাস সরছে না, ক্যাব ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে, মোটরসাইকেলের ঢাকার রাস্তার মতো ফাঁক গলে ফুটপাতে উঠে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও সেটা না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তারা। চুপচাপ বলা এজন্য যে, সবার গাড়িতেই হর্ন আছে, ভেপু আছে, কিন্তু সেটা অকারণে কেউ বাজাচ্ছে না।
বাস-ক্যাব থেকে নেমে ফুটবলপাগল মানুষগুলো হাঁটছে দশরথ অভিমুখে। পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটা কঠিন, কিন্তু তাদের পা-জোড়া ক্লান্তিহীন। মূল প্রবেশদ্বারে হাজারো সমর্থকদের লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো অনেকক্ষণ। ভারতের বিপক্ষে উত্তেজনাকর সেমি-ফাইনালে সমর্থকরা গ্যালারি থেকে পানির বোতল, বিয়ারের ক্যান ছুঁড়ে মেরেছিলেন মাঠে, রেফারির কিছু সিদ্ধান্ত তারা মেনে নিতে পারেননি কোনোভাবেই। বাংলাদেশের বিপক্ষে ফাইনালে তাই নিরাপত্তারক্ষীদের কড়াকড়ি ছিল অনেক বেশি।
পানির বোতল নিয়েও সমর্থকদের গ্যালারিতে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না তারা। এত ঝক্কিঝামেলা মধ্যেও হাসি মুখে তারা হেঁটে যখন পৌছুঁলেন গ্যালারিতে, তখন পথের ক্লান্তি ভুলে মেতে উঠলেন ‘নেপাল-নেপাল’ শ্লোগানে। ১৬ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন গ্যালারি প্রকম্পিত হতে লাগল সমর্থকদের কলরবে, হর্ষধ্বনিতে। বাংলাদেশ ও নেপাল দল যখন ওয়ার্ম-আপ করতে নামল, তখন দফায় দফায় আওয়াজ তুললেন সমর্থকরা।
তখন কেবল মনে হতে লাগল, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারির কথা। অদ্ভূত এক শূন্যতা, রিক্ততার হাহাকার সেখানে বাজতে থাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। সেখানে কাঠমাণ্ডুর দশরথ স্টেডিয়াম আনন্দে, কোলাহলে নাচছে। ‘অচেনা’ ট্র্যাফিক জ্যামের যন্ত্রণা ভুলে, নিরাপত্তারক্ষীদের শত ‘চেকপোস্ট’ পেরিয়ে মাঠে এসে তারা মহা আনন্দে লাফাচ্ছে। অথচ, ফাইনাল শুরু হওয়ার এখনও ঢের বাকি! বাংলাদেশ সময় পৌনে ৭টায় মুখোমুখি হবে দুই দল।
দশরথে প্রেস বক্স নেই, সংবাদ সম্মেলনের রুমটাও সাদামাটা, উইমেন’স সাফের আয়োজনেও নেই কোনো আড়ম্বর। কিন্তু তার পরও আছে অনেক কিছু। আছে অদ্ভূত উন্মাদনা, মাদকতা ছড়ানো গ্যালারি! ফুটবলের প্রাণই তো এই গ্যালারি, সমর্থক, যা নেপাল ফুটবলের আছে!