স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টুর চিরবিদায়ে শোকাহত তার সতীর্থরা মেলে ধরলেন স্মৃতির ডালি।
Published : 18 Nov 2024, 05:53 PM
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে অন্যলোকে পাড়ি জমিয়েছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু। কিন্তু সে নিয়ম যেন মন থেকে মানতে পারছেন না তার যুদ্ধ দিনের ফুটবল মাঠের সতীর্থরা। শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে ক্ষরণ হচ্ছে তাদের। প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, কাজী সালাউদ্দিনদের স্মৃতির অলিন্দে উঁকি দিচ্ছে ১৯৭১ সালের সেই কঠিন সময়ে কাঁধে কাঁধ রেখে লড়াই করার কত-শত ঘটনা।
৮১ বছর বয়সের ভার তো ছিলই, পিন্টুর কিডনি, লিভারে বাসা বেঁধেছিল নানা অসুখ। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ শরীর বেশি খারাপ হওয়ায় রোববার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু ফেরানো যায়নি তাকে। চিরপ্রস্থানের পথেই হেঁটেছেন প্রকৃতির নিয়মে।
ক্যান্সারে ভুগে গত অগাস্টে পৃথিবীর মায়া ছাড়েন সাইদুর রহমান প্যাটেল। এর আগে না ফেরার দেশে চলে গেছেন, আব্দুল হালিম, বিমল কর, নওশেরুজ্জামনরা। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের আকাশ থেকে ঝরে পড়া তারার তালিকায় এবার নাম উঠল পিন্টুর।
অধিনায়ককে হারানো নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাথে কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠল প্রতাপ শঙ্কর হাজরার। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের এই খেলোয়াড়েরও বয়স ৮০ পেরিয়েছে। সতীর্থ হারানোর বেদনায় মুহ্যমান প্রতাপের কণ্ঠে ফুটে উঠল নিয়তির কাছে মানুষের অসহায়ত্ব।
“একে একে সবাই চলে যাচ্ছে আর আমি তাদের নিয়ে আপনাদের সাথে কথা বলছি। কত স্মৃতি আওড়াচ্ছি। এবার পিন্টু ভাই চলে গেলেন। তাকে নিয়েও আমাকে কথা বলতে হচ্ছে। কিন্তু আমি যখন চলে যাব, তখন কথা বলবে কে? বলুন?”
এই প্রশ্নের উত্তর যে হয় না, দেওয়া যায় না, প্রতাপ জানেন, কিন্তু শোকস্তব্ধ হৃদয় যে জানা অনেক কিছুই মানতে পারে না। ৮১ বছর বয়সী এই বীর মুক্তিযোদ্ধাও পারছেন না মানতে। স্মৃতি আওড়াতে থাকেন নিজের মতো করে।
“সেসব দিনের কত কথা মনে পড়ছে। পিন্টু ভাইয়ের সাথে একসাথে খেলেছি। দেশের জন্য খেলেছি। যদিও ব্যক্তিগতভাবে অবশ্য মনে করি, যারা জীবন বাজি রেখে কোনো ট্রেনিং ছাড়াই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তারাই প্রকৃত বীর। তবে আমরাও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছি, এর বেশি আর কীই-বা চাইতে পারি। সর্বোচ্চ সম্মানই তো পেয়েছি আমরা।”
ইংল্যান্ড থেকে মেয়ে দেশে ফিরবেন বলে পিন্টুর মরদেহ ফ্রিজিং করে রাখা হবে সোমবার। আগামীকাল সকাল ১০টায় এই কিংবদন্তিকে শ্রদ্ধা জানাতে নিয়ে যাওয়া হবে তার প্রিয় ক্লাব মোহামেডানে, সংগঠক হিসেবে এই ক্লাবের সাথে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। সেখানে জানাজা করা হবে, দেওয়া হবে গার্ড অব অনার।
অধিনায়ককে নিয়ে কাজী সালাউদ্দিন কথা বেশিক্ষণ টেনে নিতে পারলেন না। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের এই যোদ্ধারও সম্প্রতি শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। অধিনায়ককে চিরতরে হারানোর শোক সালাউদ্দিনের কণ্ঠে স্পষ্ট শোনাল।
“প্রকৃতির নিয়মের কাছে আমরা অসহায়। আমরা সবাই একে একে চলে যাব। এবার পিন্টু ভাই চলে গেলেন। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক। একসাথে আমাদের কত স্মৃতি। কতকিছু তার কাছ থেকে শিখেছি সেসময়।”
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠন ও তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে একঝাঁক স্বাধীনতাকামী ও সাহসী ফুটবলার ও ফুটবল কর্মকর্তা দল গঠন করে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ম্যাচ খেলেছিল ১৬টি। সেই ম্যাচ থেকে প্রাপ্ত অর্থ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরেও জাতীয় দলের হাল ধরেন জাকারিয়া পিন্টু। তার অধীনে ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়া মারদেকা কাপে অংশ নেয় বাংলাদেশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে-পরে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করা পিন্টুকে কৃতজ্ঞতার বাঁধনে বাঁধলেন সালাউদ্দিন।
“স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক। স্বাধীন বাংলাদেশ ফুটবল দলের অধিনায়ক। গ্রেট লিডার, গ্রেট ক্যাপ্টেন।”