রংপুর-৩: নামের জোরেই এরশাদ, মাঠে সরব রিটা

প্রার্থী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভোটের মাঠে না থাকলেও তার নামের ওপরই চলছে রংপুর-৩ আসনে জাতীয় পার্টির নির্বাচনী কার্যক্রম।

মাসুম বিল্লাহও আফতাবুজ্জামান হীরু, রংপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Dec 2018, 06:28 AM
Updated : 25 Dec 2018, 07:50 AM

এর বিপরীতে রংপুর সদরের এই আসনের পুরো এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন এরশাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষের প্রার্থী রিটা রহমান।

পোস্টার আর ব্যানারে এরশাদ এগিয়ে থাকলেও আসনের প্রায় প্রতিটি এলাকায় ভোটারের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন নব গঠিত পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশের (পিপিবি) আহ্বায়ক রিটা।

আওয়ামী লীগ তাদের জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টিকে এবং বিএনপি তাদের শরিক রংপুর-৩ পিপিবিকে ছেড়ে দেওয়ায় দেশের প্রধান দুই দলের প্রার্থী এখানে নেই।

১৯৯১ সাল থেকে পাঁচটি সংসদ নির্বাচনের চারটিতে এইআসনের সংসদ সদস্য ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ। তার অবর্তমানে ২০০১ সালে এখান থেকে নির্বাচিত হন ভাই জিএম কাদের।

লাঙ্গলের শক্ত ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত রংপুর-৩ ধানের শীষের কব্জায় নিতে রিটা কাজে লাগাতে চাইছেন তার বাবা প্রয়াত মশিয়ুর রহমান যাদু মিয়ার নাম।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যাদু মিয়া সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সরকারে সিনিয়র মন্ত্রী ছিলেন। তার ছেলে সফিকুল গণি স্বপন ছিলেন জাতীয় পার্টির মন্ত্রী। স্বপনের ছেলে জেবেল রহমান গানি বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান।

বাংলাদেশ ন্যাপ এক সময় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে ছিল। কিন্তু বিএনপি কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিলে ‘ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের সঙ্গে সখ্য গড়ার’ অভিযোগ তুলে গত অক্টোবরে জোট ছাড়েন জেবেল গানি। এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ ন্যাপ এখন মহাজোটেরও শরিক।

জেবেল গানি ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার পরের মাসেই রিটা রহমানের নেতৃত্বে বাজারে আসে পিপিবি। দলের নিবন্ধন না থাকায় বিএনপির মনোনয়নে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হয়েছেন রিটা।  

রংপুর-৩ আসনে প্রার্থী যারা

জাতীয় পাটির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (লাঙ্গল), বিএনপির (পিপিবি) রিটা রহমান (ধানের শীষ), জাসদের সাখাওয়াত রাংগা (মশাল),বাসদের আনোয়ার হোসেন বাবলু (কোদাল), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমিরুজ্জামান পিয়াল (হাতপাখা), পিডিপির সাব্বির আহমেদ (বাঘ), জাকের পার্টির আলমগীর হোসেন (গোলাপ ফুল), খেলাফত মজলিসের তৌহিদুর রহমান মণ্ডল (দেয়াল ঘড়ি) এবং ন্যাশনাল পিপলস পার্টির সামসুল হক (আম)।

দুয়ারে দুয়ারে রিটা

ভোটের রাজনীতিতে নতুন হলেও রিটা রহমান এলাকায় বেশ গুছিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন বলে মত ভোটারদের। সোমবারের গণসংযোগে তাকে দেখা গেল রংপুর শহরের কেরানীপাড়া এলাকায়।

ভোটারের হাতে লিফলেট তুলে দিয়ে রিটা বলছিলেন, “আমি আপনাদের যাদু মিয়ার মেয়ে, ধানের শীষের প্রার্থী। আমাকে ভোট দিবেন।”

বাই লেন এলাকায় রিটাকে পেয়ে আবেগতাড়িত হতে দেখা যায় ৮৫ বছর বয়সী আবু হানিফকে। যাদু মিয়া মেয়ে শুনেই ’ভোট দেবেন’ বলে কথা দিয়ে দিলেন তিনি।

আবু হানিফ পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই পার্টি এখন থেকে করি না। যাদু মিয়ার সময় থেকে করি। এই ভোট নড়চড় হবে না আমার।”

প্রচারের পথে কয়েকজন তরুণ ভোটারকে পেয়ে তাদের হাতে লিফলেট তুলে দেন রিটা। তাদের বলেন, “তোমাদের এগিয়ে আসতে হবে। তোমরা এগিয়ে এলে দেশ ঠিক পথে চলবে।”

সিটি করপোরেশন এলাকার ৩৩টি ওয়ার্ডের ২৩টির সঙ্গে চারটি ইউনিয়ন নিয়ে রংপুর-৩ আসন। আগামী ৩০ ডিসেম্বর এ আসনে ভোট গ্রহণ করা হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)।

বিএনপি সাবেক এমপি শাহিদা রহমান জোসনা জানান, রিটা রহমান ইতোমধ্যে সব কটি ওয়ার্ডে নির্বাচনী গণসংযোগ ও পথসভা শেষ করেছেন।

তবে মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের কিছু কর্মীসমর্থক এখনও রিটার পক্ষে সক্রিয় হননি বলে স্থানীয় ভোটারদের ভাষ্য।

এ আসনে রংপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি মোজাফফর হোসেন এবং কাউছার জামান বাবলা দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু দল রিটা রহমানকে মনোনয়ন দেওয়ায় প্রথমে তাকে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করেছিল স্থানীয় বিএনপি।

শহর বিএনপির সম্পাদক পর্যায়ের এক নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শেষ পর্যন্ত রিটার সঙ্গে স্থানীয় নেতাদের সমঝোতা হলেও সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সেভাবে সক্রিয় করা যায়নি।

অবশ্য রিটা রহমানের দাবি, বাবার ‘সুনামের’ কারণে রংপুরের মানুষ তাকে গ্রহণ করেছে, তার পরিবর্তনের ডাকেও তারা সাড়া দেবে।

“আমি যত মানুষের কাছে যাচ্ছি, তারা আমাকে নিজেদের লোক বলে গ্রহণ করছে। রোববার আমি একটি পথসভায় গিয়েছিলাম রাত পৌনে ১০টায়। ওই সময়ও নারী-পুরুষ সবার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত।

“রংপুরের ভাষায় বলছি, আমি সেখানে উপস্থিত কারো মুখ ‘বেজার’ দেখিনি। আমি অবাক হয়ে গেলাম। যাদু মিয়ার মেয়েকে দেখার জন্য, তার কথা শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিল।”

এরশাদ দীর্ঘদিন এই এলাকা থেকে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করলেও এলাকার দিকে সেভাবে নজর দেননি বলে মন্তব্য করেন ধানের শীষের প্রার্থী।

রিটা বলেন, “এরশাদ নিজেকে রংপুরের মানুষ বললেও তার অরিজিন কিন্তু রংপুর না, কুচবিহারের। রংপুরের মানুষ ক্রমান্বয়ে সেটা বুঝতে পেরেছে। আমাদের এখানে কর্মসংস্থানের অভাব ছিল না এক সময়, কিন্তু সেদিন আর নেই।

“এরশাদ সাহেব ৩০ বছর এই এলাকার সংসদ সদস্য ছিলেন। এলাকাকে কী দিয়েছেন? রংপুরের এখন এমন অবস্থা, সারাদেশের মানুষ অবজ্ঞার চোখে দেখে। বাবার আদর্শ নিয়ে আমি এলাকার আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করব।”

তার সমর্থকদের নানা রকম হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে অভিযোগ করে রিটা বলেন, “মনে হতে পারে প্রতিপক্ষ লাঙ্গল বলে এখানকার অবস্থা বোধহয় ভালো। আসলে সারাদেশে যে রকম পুলিশি হয়রানি ও প্রতিপক্ষের হুমকি-ধমকি এখানেও সমান সমান।”

এরশাদ ‘না থেকেও আছেন’

এরশাদ চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে থাকায় রংপুর-৩ আসনে তার পক্ষে নেতাকর্মীরা প্রচার অব্যাহত রেখেছেন। রংপুরের সিটি মেয়র ও মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার নেতৃত্বে প্রচার চলছে দলটির।

পুরো নির্বাচনী এলাকার সড়কে সড়কে এরশাদের পোস্টার আর ব্যানার শোভা পাচ্ছে। তবে লাঙ্গলের পক্ষে গণসংযোগ সেভাবে হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কিছু এলাকার ভোটার।

চিলমন এলাকায় বেশ কয়েকজন ভোটার জানান, তাদের এলাকায় লাঙ্গলের পক্ষে ভোট চাইতে আসেননি কেউ। মাইকিংও নেই।

সেখানকার চা দোকানী ফারুক মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ধানের শীষ একবার আসছিল। এবার লাঙ্গলের খবর নাই। দেখা যাক কী করে।”

গত শনিবার বিকালে লাঙ্গলের পক্ষে রংপুর শহরে বড় আকারের মিছিল বের হয়। মিছিলে সমর্থকদেরকে কারুকাজ করা বেশ কিছু লাঙ্গল প্রদর্শন করতে দেখা যায়।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থী না থাকায় এরশাদকেই শক্ত প্রার্থী বলে মনে করছেন চিলমন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল কাদের, তবে তার ধারণা ভোটের ব্যবধান এবার আগের তুলনায় কমবে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এরশাদ সাহেবতো আর এলাকায় সময় দিতে পারেন না। মানুষের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সে কারণে আগে যে রকম বিপুল ভোটে জিততেন, এবার ভোটের ব্যবধান কমে আসবে বলে মনে হয়।”

অবশ্য সিটি মেয়র মোস্তফার দাবি, এরশাদের থাকা না থাকার কোনো প্রভাব ভোটের ফলে পড়বে না।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “স্যার নাই, তবুও রংপুরের মানুষ স্যারকে ভালোবাসে। এক সময় স্যার জেলে থেকেও ইলেকশন করেছেন, তারপরেও নির্বাচনে তিনি জিতেছেন। স্যারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ হচ্ছে। নির্বাচনের আগেই তিনি দেশে চলে আসবেন এবং রংপুরেও আসবেন।”

এবার নির্বাচনী প্রচারের শুরুতে টাকার অভাবে প্রচার চালাতে পারছেন বলে দাবি করেছিলেন এরশাদ।

টাকার ঘাটতি মিটেছে কি-না, এমন প্রশ্নে রংপুরের নেতা মোস্তফা বলেন, “টাকা স্যার যথেষ্ট দিয়েছেন। জাতীয় কমিটির নেতাদের অত টাকা দিতে হয় না, তাই দিতে হয়নি। এখানে টাকা-পয়সার বিষয় নাই।”