ওই কবিতা থেকে ধার করে অনেকেই এবার বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা বার্তা দিয়েছেন, বলেছেন, “আমাদের দেখা হোক মহামারী শেষে, আমাদের দেখা হোক জিতে ফিরে এসে।”
কেউ বলছেন, দুই স্তবকে ১২ পংক্তির ওই কবিতা লিখে গেছেন জীবনানন্দ দাশ; কেউ আবার বলছেন কবি শঙ্খ ঘোষ ওই কবিতা লিখেছেন তিন দশক আগে।
তবে তার মেয়ে শ্রাবন্তী ভৌমিক গত ২৯ মার্চ ফেইসবুকে এক পোস্টে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ওই কবিতা তার বাবার লেখা নয়, “হতে পারে না”।
বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে কলকাতার অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এই কবিতাটি তার ভক্তদের জন্য আবৃত্তি করেন; সেখানে তিনিও কবিতাটির রচয়িতা হিসেবে জীবনানন্দ দাশের কথা বলেন।
কোনো শিরোনাম ছাড়া এই কবিতাটি কেন জীবনানন্দ দাশের বলে ভাবা হচ্ছে তা নিয়ে ফেইসবুকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তামান্না সারোয়ার। তিনি দাবি করেন, কবিতাটি লিখেছেন পার্থ মুখার্জি নামে এক কবি।
“আমি আসল কবিতাটি কবির নাম সমেত দিলাম। কবিতাটি তিনি ২৬ মার্চ রচনা করেছেন করোনা পরিস্থিতিতে। তিনি পশ্চিমবঙ্গের কবি।”
ভারতের মঙ্গলকোট ডটকমে গত ২৬ মার্চ কবিতাটি প্রকাশ করা হয়। সেখানে এখন কোনো কবির নাম দেখা যাচ্ছে না। তবে পাঠকের মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, প্রকাশের সময় সেখানে কবি হিসেবে পার্থ মুখার্জির নাম বলা ছিল।
মঙ্গলকোটের ফেইসবুক পেইজে ২৬ মার্চ প্রকাশিত কবিতার লিংকটি শেয়ার করা হয়েছিল, যেখানেও কবির নাম পার্থ মুখার্জি বলা হয়েছিল।
গত ১৭ এপ্রিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সায়ন দাস ফেইসবুক লাইভে এসে জানালেন ‘আমাদের দেখা হোক মহামারী শেষে, আমাদের দেখা হোক জিতে ফিরে এসে’ কবিতাটি তারই লেখা।
এ নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাথেও কথা হয় হরিণঘাটার মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির শিক্ষার্থী সায়ন দাসের।
তিনি বলেন, “আমার একটা পজিটিভিটি বলতে পারেন, বা বিশ্বাসের জায়গা থেকে এটাই বলতে পারি, ২৩ মার্চ রাত ১১টা ৪মিনিটের আগে কবিতাটি কেউ কোথাও পাবেন না। কবর খুঁড়লেও বেরিয়ে আসবে না। ”
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী সায়ন চূড়ান্ত বর্ষে পড়ছেন এখন। কবিতার বই ছাপানো নিয়ে এখনো না ভাবলেও বন্ধুমহলে নিজের লেখা কবিতা ও গানের জন্য উৎসাহ পান।
সায়ন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি টুকটাক যা লিখি ফেইসবুকেই দেই। ছাত্রজীবনে সবাই লেখালেখি করে; আমিও সেভাবেই রয়েছি।
“… সত্যি কথা বলতে আমি দুটো বন্ধুর সাথে কথা বলছিলাম, কথা বলতে বলতে আমার এক বন্ধু বলে উঠল কি মহামারী লেগেছে বল! ফট করে এই শব্দটা আমার মাথায় চলে এল, আমিও লিখে ফেললাম।”
২৩ মার্চ রাতে ওই কবিতাটিই ফেইসবুকে প্রকাশ করেন তিনি। কিন্তু কিছুদিন পর হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধু-স্বজনদের পাঠানো বার্তায় ওই কবিতাই তার কাছে ফিরে আসে ভিন্ন কবির নামসহ।
সায়ন তখন খোঁজ নিয়ে দেখতে পান, দুই বাংলাতেই বিভিন্ন কবির নামে ইউটিউব ও ফেইসবুকে শেয়ার হচ্ছে তার কবিতা।
১৬ এপ্রিল দৈনিক প্রথম আলোর ফেইসবুক পাতায় রেদওয়ান রনি নির্মিত আবৃত্তির ভিডিও পোস্টও নজরে আসে তার, সেখানেও কবির নাম বলা হয়েছে পার্থ মুখার্জি।
প্রথম আলোর ফেইসবুক পাতায় প্রকাশ করা ওই ভিডিও পোস্টে কবিতাটি সায়ন দাসের জানিয়ে ১৭ এপ্রিল একটি মন্তব্য করেন ভারতের দীপাঞ্জন।
তিনি বলেন, “এই দুর্যোগের দিনে তার (সায়ন দাস) লেখা কবিতাটি শ্রদ্ধেয় জীবনানন্দ দাশ, শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষ ও শ্রদ্ধেয় পার্থ মুখার্জি নামে কোনো এক কবির নাম নিয়ে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে… আপনারা সত্যতা যাচাই করুন ও আসল কবিকে সঠিক মর্যাদা প্রদান করুন।”
সায়নের ভাষ্যে, “প্রথম আলো বলে ওপার বাংলায় (বাংলাদেশে) একটি পেইজ রয়েছে ফেইসবুকে। তাদের নজরে বোধ হয় আসেনি, তারা সেটাকে আর পরিবর্তন করেননি, আমি দেখলাম।”
সায়ান বললেন, “পশ্চিমবঙ্গে একজন পার্থ মুখার্জী আছেন, উনি পাঠ করেন, রিসাইট করেন। কিন্তু এই পার্থ মুখার্জী কিন্তু ওই পার্থ মুখার্জি নন, যার নামে কবিতাটি ছাড়া হয়েছে... এটি সম্পূর্ণ একটি বিভ্রান্তি। ওই পার্থ মুখার্জি অ্যাকচুয়ালি এক্সিস্ট করেন না। ইনার কোনো উপস্থিতি নেই।
“যারা প্রকৃত সত্যটা তুলে ধরতে আমার হয়ে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে লিখেছেন বা কমেন্ট করেছেন, তাদেরও একই মত যে, এই পার্থ মুখার্জি আদতে কেউ নন। ইনাকে খুঁজে পাওয়াই যাচ্ছে না।”
ভারতের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁয় সাহিত্যচর্চায় যুক্ত রয়েছেন অমিতকুমার বিশ্বাস ও তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাদের দুজনেই পার্থ মুখার্জি নামে কোনো ‘কবি’ সম্পর্কে অবগত নন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন।
কবিতাটি নিয়ে আলোচনা চললেও গত প্রায় এক মাসে ফেইসবুক ও ইউটিউবে সেই কবি হিসেবে পার্থ মুখার্জির ফেইসবুক বা ইউটিউব প্রোফাইল বা ইমেইল বা কোনো ওয়েবসাইটের লিংক দিতে দেখা যায়নি কাউকে।
ফেইসবুকে পার্থ মুখার্জি নামে কারো প্রোফাইলেও এই কবিতা প্রকাশ হতে দেখা যায়নি এখন পর্যন্ত।
পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ বাচিক শিল্পী পার্থ মুখার্জীর সঙ্গে সোমবার এ নিয়ে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
তিনি বলেন, “আমাকে জিজ্ঞেস করে অনেকে, আপনি কি লেখেন? আমি বলি, আমি কবিতা পড়ি।
“জীবনানন্দ দাশ আর এমন বেশ কয়েকজনের নাম দিয়ে কিছু কিছু কবিতা বাজারে চলছে। এবং আমার নামেও নাকি এরকম চলছে। …আমি তো কবিতা বলি। দুয়েকটা মাঝে মাঝে লিখি; যেমন পহেলা বৈশাখ লিখেছিলাম। কিন্তু আমি কবি নই। আমি আবৃত্তিকার এবং আবৃত্তি শেখাই।”
এই পার্থ মুখার্জীর ভাষ্য, মোটামুটি হাজার ছয়েক কবিতা তার মুখস্ত। জীবনানান্দ দাশ, শঙ্খ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সব কবিতাই তার জানা।
“যদি কেউ বলে যে এটা (সেই মহামারীর কবিতা) উনার লেখা, তাহলে আমার কাছে তো পারবে না। কারণ আমার কাছে সব বই আছে। আমার সব কবিতা জানাও আছে।”
এরমধ্যে ফেইসবুক ও ইউটিউব ব্যবহারকারীদের অনেকেই ওই কবিতার কবির নাম সংশোধন করে সায়ন দাস লিখছেন।
তাতে সন্তোষ প্রকাশ করে সায়ন দাস বলেন, “হয়ত আমি প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা নিতাম, কিন্তু এই লকডাউনের বাজারে আমি সেটি করতে পারছি না।”
ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনার আগরপাড়ার তরুণ সায়ন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেউ সদর্পে বুক চিতিয়ে প্রকৃত লেখক হিসেবে দাবি করেননি। আমি করেছি। যেহেতু সত্যিই আমি লিখেছি, তাই তো আমি করব।”