সেলফি-ভিডিওতে পশু কোরবানি, এই দেখানোর ফল কী?

ছয় বছর আগে কোরবানির ঈদের সময় ফেইসবুকে দুটি ছবি ভাইরাল হয়েছিল। এর একটিতে কোরবানি দেওয়া গরুকে রক্তাক্ত অবস্থায় উলটো করে শুইয়ে তার উপর এক তরুণ হেলান দিয়ে গরুর পেছনের দুটি পা ধরে বসে হাসছিলেন। তার পাশেই হাসিমুখে ছিলেন আরেক তরুণ।

নিজস্ব প্রতিবেদকমেহেরুন নাহার মেঘলাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 July 2022, 09:44 AM
Updated : 9 July 2022, 09:44 AM

সেই ঈদের আরেকটি ছবিতে দেখা গিয়েছিল, জবাই করা একটি গরুকে কাত করে শুইয়ে তার উপর পাঁচজন বসে আছেন। তাদের তিনজন তরুণী এবং দুজন শিশু।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে এই ছবি দুটো ফেইসবুকে পোস্ট করার পরপরই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, সেই সঙ্গে বড় আলোচনারও সূত্র তৈরি করে। 

কেউ কেউ এর পক্ষে নানা যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেও বেশিরভাগই উগড়ে দিয়েছিলেন ক্ষোভ। তারা বলছেন, আসছে ঈদগুলোতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চান না তারা।

তারপরও প্রতি বছরই কোরবানির ঈদের কয়েকদিন আগে থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পশুর ছবি সেই সঙ্গে পশুর সঙ্গে সেলফি দেওয়া শুরু হয়। আর এর শেষটা হয় ঈদের দিনে পশু জবাইয়ের পর তার সঙ্গেও ছবি দেওয়া। এখন আবার ভিডিও ধারণ, লাইভ করতেও দেখা যায় কাউকে কাউকে।

এক সময় কোরবানির পশুর গলায় মালা এবং দাম লিখে এলাকায় ঘোরাতে দেখা যেত। তথ্য প্রযুক্তির প্রসারে এখন ভার্চুয়ালি সেই কাজটি চলছে।

অথচ ইসলাম ধর্মীয় বিশ্বাস বলে, কোরবানির ঈদ আত্মত্যাগের শিক্ষা দেয়। সেখানে কোনো ধরনের প্রদর্শনবাদিতা কিংবা বীভৎসতা প্রদর্শন কোনোভাবে ইসলাম শিক্ষা দেয় না বলে ধর্মীয় নেতাদের ভাষ্য।

বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব হাফেজ মাওলানা রুহুল আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যদি প্রয়োজন থাকে, তাহলেই কেবল কোরবানির পশুর ছবি বা ভিডিও দেওয়া যেতে পারে। অনেকে ব্যবসায়িক কাজে স্বাভাবিক ছবি বা ভিডিও ব্যবহার করেন, সেটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া যখন সেটি শুধু লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে করা হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে সেটি বর্জনীয়। ইসলাম এটার অনুমোদন কখনও দেয় না।”

”কোরবানি মানে হলো ত্যাগ, এটা দেখানোর বিষয় নয়। এটা ইবাদত। শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কোরবানি দিতে হয়,” বলেন তিনি।

শোলাকিয়া ঈদ্গাহের ইমাম ও জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের সভাপতি মাওলানা ফরীদ উদদীন মাসঊদও বলেন, কোরবানি দেখানোর জন্য নয়।

“এমনকি কেউ যদি গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েও কোরবানি দেয়, তবে সেটা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না,” বলেন তিনি।

কোরবানির পশু নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় এই ধরনের প্রচারকে ‘প্রদর্শনবাদিতার উৎকট প্রকাশ’ মনে করছেন মনোবিজ্ঞানীরা।

ব্যক্তিবিশেষের এই লোকদেখানো কর্মকাণ্ড অন্য অনেককেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে বলে মন্তব্য করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিগত বেশ কিছু ঈদে দেখেছি, গরু কোরবানি লাইভ করা হচ্ছে ফেইসবুকে। জবাই করা পশু এবং মাংসের ছবি দেওয়া হচ্ছে। কেউ যদি কোরবানি করতে চান, কোরবানি দেখতে চান, সেটা একান্তই তার ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় এনে সর্বসাধারণকে দেখতে বাধ্য করা, আমার মতে ধর্মীয় ও সামাজিক কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই অনুমোদন পায় না।

“সামাজিক এই পরিসরে তো অনেক অমুসলিমও রয়েছেন। অনেক প্রাণীপ্রেমী রয়েছেন, যাদের কাছে এটা হিংস্রতা মনে হয়। এর ফলে অনেকেই সাইকোলজিক্যাল ট্রমার মধ্যে চলে যেতে পারেন।”

আবার কোরবানির পশুর দামের প্রচার অন্যদের মধ্যে যে হীনমন্যতার জন্ম দিতে পারে, তাও বলেন মোহিত কামাল।

“আজকাল দেখছি, আমাদের এখানে কে কত বড় এবং কত দামি গরু কিনতে পেরেছেন, তা দেখানোর বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তারা ভাবেন না যে এটা তার নিকটাত্মীয় এবং প্রতিবেশীদেরও মধ্যে হীনমন্যতার জন্ম দিতে পারে।”

প্রযুক্তিবিদরা মনে করেন, দেশের অনেকের মধ্যে সোশাল মিডিয়া ব্যবহারের ‘মানসিক পরিপক্কতা’ এখনও তৈরি হয়নি, যে কারণে এই ধরনের ছবি-ভিডিও দেখা যাচ্ছে।

ফাইবার অ্যাট হোমের চিফ স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড টেকনোলজি অফিসার সুমন আহমেদ সাবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, সেই ব্যাপারে পরিপক্কতা এখনও অনেকেরই আসেনি, সেজন্য অন্যরা ভুক্তভোগী হচ্ছে। এগুলো নিয়ে আসলে কথা বলা দরকার। প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নেতিবাচকতাকে এড়িয়ে ইতিবাচক বিষয়গুলোকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ।”

তিনি বলেন, “আমরা যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করি, যে কোনো কনটেন্ট আপলোড করার সময় আমাদের মাথায় রাখা উচিৎ, সেটি বিভিন্ন বয়সের লোক দেখছে। কাজেই এমন কিছু পোস্ট করা উচিৎ না, যেটি আরেকজনের জন্য ক্ষতিকর কিংবা অস্বস্তির কারণ হয়। কোরবানি করার দৃশ্য সবার জন্য সুখকর নয়।”

কোরবানির গরু কিনে তা নিয়ে মাতামাতি একটা ‘অসুস্থ সংস্কৃতিতে’ পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন সাবির।

“এখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কোনো প্রযুক্তিগত সমাধান নেই। এর সমাধানের জন্য আমাদের সচেতনতার জায়গাটাকে উন্নত করতে হবে।”

এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে- জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ফেইসবুকের বিষয়গুলো মনিটরিং করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমরা তাদের সাথে কথা বলেছি। যে কোনো ধরনের বীভৎস ছবি বা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সরিয়ে ফেলার প্রতিশ্রুতি তারা আমাদের দিয়েছেন।”

সোশাল মিডিয়ায় বেশ সক্রিয় এই মন্ত্রী বলেন, “আমি মনে করি, কোনো ধরনের বীভৎস দৃশ্যই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপস্থাপন করা উচিৎ নয়। আমাদের কাছে এ নিয়ে অনেক অভিযোগ আসে।”

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ‍ পলকও এসব নিয়ন্ত্রণের মূল বিষয়টি সোশাল মিডিয়া কর্তৃপক্ষের উপরই দিচ্ছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটা নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড আছে, যাকে আমরা কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড বলি, তার প্রথম নির্দেশনা হচ্ছে সেলফ রেগুলেটরি এপ্লাই করা।”

তবে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়ার কথা তিনিও বলেন।

“তথ্য মন্ত্রণালয় এবং বিটিআরসি যেসব ব্যবস্থা নিতে পারে, সেগুলো হতে পারে সচেতনতামূলক। আমাদের আইসিটি বিভাগের ডিজিটাল লিটারেসি সেক্টরসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানোর পরিকল্পনা আছে। সেখানে কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলার জন্য মানুষকে সচেতন করার জন্য চেষ্টা করতে পারি আমরা।”

এ ক্ষেত্রে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে কি না- প্রশ্ন করলে পলক বলেন, “আমাদের বিভাগ থেকে এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আসলে নেই। এটা সম্পূর্ণ সচেতনতার বিষয়।”