সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে প্রকৃতি এবার যেন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। ফসলের বাম্পার ফলনে তৃপ্তির হাসিতে ভরে উঠেছে কৃষকের মুখ। প্রত্যাশার বেশি ফসল ওঠায় অনেক কৃষককে নতুন উগার বা গোলা তৈরি করতে হয়েছে।
আবহাওয়া অনুকূলে ছিল বলে ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে মাড়াই ও শুকানোর কাজ। খড়ও সহজেই শুকিয়ে সংরক্ষণ করা গেছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবার হাওর ও হাওরের বাইরে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৩০০ হেক্টর। আবাদ হয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর। এর মধ্যে হাওরেই আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর। এবার প্রত্যাশার চেয়ে ১০ হাজার টনেরও বেশি ধান পেয়েছেন কৃষক, যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
দিরাই-শাল্লা এবং সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার দেখার হাওর, ছায়ার হাওর, ভরাম হাওর ও ভাণ্ডাবিল হাওর ঘুরে দেখা গেল ধান কাটা শেষ। মাঠে পড়ে আছে কাটা ধানের নাড়া। প্রতিটি অস্থায়ী খলায় শেষ মুহূর্তে ধান ও খড় শুকানোর কাজে ব্যস্ত কৃষক। রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়ায় সহজেই শুকিয়ে যাচ্ছে ধান। এরপর তা বস্তায় ভরে গোলাজাত করা হচ্ছে।
খড় শুকিয়ে আপাতত স্তূপ বা লাছি করে হাওরের কান্দায় রেখে দিচ্ছেন কৃষক। খলা থেকে সব ধান বাড়ির গোলায় চলে গেলে ঐতিহ্য অনুযায়ী উৎসব করে লাছি করবেন তারা। এতে একে অন্যকে সহযোগিতা করবেন কৃষকরা। এ উপলক্ষে আয়োজন করা হবে বিশেষ খানাপিনার।
কথা হয় শাল্লা উপজেলার আঙ্গাউড়া নোওয়াগাও গ্রামের কৃষক পিসি দাসের সঙ্গে। ছায়া, ভরাম ও ভাণ্ডাবিল হাওরে তার বোরো ধানের জমি রয়েছে। এক সপ্তাহ আগেই তার ধান কাটা শেষ।
এই কৃষক বলেন, “এবার ৪২ কেয়ার জমিন রইছলাম। মা বাবা আশা করছিলা ৫-৬শ মন ধান পাইমু। কিন্তু এমন ফলন পাইছি আরেকটা গোলা বানাইতে অইছে ধান তওয়ার জন্য। ১০০ মন ধান বেশি পাইছি ইবার। সব মিলাইয়া ৭০০ মন ধান পাইছি। পুরু-বড় [ছোট-বড়] সব কৃষক ইবার খুশি।”
৫১ বছরের জীবনে এমন নির্বিঘ্ন বৈশাখ পাননি বলে জানান পিসি দাস।
ছায়ার হাওরের আনন্দপুর গ্রামের কৃষক অজয় কুমার রায় বললেন, এবার তার এত পরিমাণ ধান হয়েছে তা নিজের গোলায় আঁটছে না। অন্যান্য স্থানেও রাখতে হচ্ছে।
শরিফপুর গ্রামের কৃষক জামির হোসেন মাথায় লাল গামছা বেঁধে শেষ মাড়াইয়ের ধান খলায় শুকাচ্ছিলেন। রোদ ভালো থাকায় এক রোদেই শুকিয়ে ফেলছেন।
তিনি বলেন, “ইবার বাম্পার ফলন অইছে, বালা ফসল পাইছি। শ্রমিক, মেশিন, রইদ সবতা পুরা পাইছি। কোন বান তুফান নাই। তাই শান্তিমতো বৈশাখী তুলছি।”
প্রায় ৩০ শতক জমিতে বোরো চাষ করে ২৫ মণ ধান ঘরে তুলেছেন শশারকান্দা গ্রামের কিষানি আঁখি আক্তার।
এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহেই সব ধান কাটা শেষ করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “ইবার বৈশাখী উঠছে বালা। দোয়া করি এমন বৈশাখী যাতে বারবার আয়। বালা ধান পাইয়া আমরা হখলে খুশি।”
মামুদনগর গ্রামের কৃষক মোশাহিদ মিয়া বলেন, “ইবার ৫ কিয়ার জমিন করছিলাম। ১২৫ মন ধান পাইছি। ইলা ফসল ও বালা দিন বাক্কা দিন পাইছি না। গতবার ফসল মাইর গেছে। এর আগেরবার আউগ্না (জ্বলে গেছে) বাতাসে ধান জ্বলি গেছে। ইবার ইতা কুন্তা অইছে না, সবাই বালা ফসিল পাইছে।”
এভাবেই কিষান-কিষানিরা হাওরে বাম্পার ফলন পেয়ে এবং প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ধান পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলেন। অনেকেই জানালেন, প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ধান বেশি পেয়ে তা রাখতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। নতুন করে গোলাও তৈরি করতে হয়েছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলন, “এবার হাওরে আবাদ ও চাষের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ফলন আরো বেশি হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন ধান বেশি পেয়েছেন কৃষকরা।”
আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধান বা খড়ের গুণাগুণ নষ্ট হয়নি জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, এবারের রোদ ছিল কৃষদের ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো ও খড় সংগ্রহের জন্য উপযুক্ত। সে সুযোগ কাজে লাগিয়েই গোলা ভরেছেন স্থানীয় কৃষকরা।