গদখালির ‘ফুলরাজ্য’: চাষ বেড়েছে ১০ শতাংশ, দ্বিগুণ বিক্রির আশা

পহেলা ফাল্গুন, ভালবাসা দিবস, বসন্তবরণ ও ভাষাদিবসকে বরণ করতে যে ফুলের দরকার, তার ৭৫ শতাংশ ফুল গদখালি থেকে সারা দেশে যায়।

বেনাপোল প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Feb 2023, 10:45 AM
Updated : 6 Feb 2023, 10:45 AM

ফেব্রুয়ারির উৎসব ঘিরে চাঙা হয়ে উঠেছে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালির ফুলের বাজার। পহেলা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও ২১ ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে প্রস্তুত ফুলচাষিরা।

চাষিরা বলছেন, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফুল উৎপাদন ‘ভালো’ হয়েছে। দামও ভালো থাকায় চাঙ্গা হয়ে উঠছে কেনাবেচা। এ মৌসুমে ৫০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন।

প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই চাষি, পাইকার আর মজুরের হাঁকডাকে মুখর হয়ে ওঠে যশোর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের পাশে ‘ফুলের স্বর্গরাজ্য’ হিসেবে পরিচিত গদখালি বাজার।

রোববার বাজার ঘুরে দেখা যায়, ফুল কিনতে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন। সকাল সকালই বিভিন্ন রুটের বাসের ছাদে, ট্রাক ও পিকআপ ব্যানে স্তূপ করা হয়েছে ফুল; যেগুলো পাঠানো হবে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়।

গদখালির ফুল ব্যবসায়ী নাজমুল হোসেন বলেন,ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের পর ফুলের চাহিদা ব্যাপক বেড়ে যায়। তখন ফুলের দর আরও বাড়বে। গত বছর বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে একশ গোলাপ দুই হাজার টাকায়ও বিক্রি হয়েছিল।

পহেলা ফাল্গুন, ভালবাসা দিবস, বসন্তবরণ ও ভাষাদিবসকে বরণ করতে যে ফুলের দরকার এখান থেকে তার ৭৫ শতাংশ ফুল সারা দেশে যায় বলে জানায় ফুল ব্যবসায়ী সমিতি।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, করোনাভাইরাস ও আম্পান ফুল সেক্টর একেবারেই ধ্বংস করে দিয়েছিল। মহামারীর ভয় কাটিয়ে চাষিরা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে; নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।

গত বছর পহেলা ফাল্গুন আর ভালবাসা দিবসে প্রায় ১৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছিল। আর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আরও প্রায় ১০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়।

“এর আগের দুই বছর করোনার কারণে ফুল বিক্রিই করতে পারেনি চাষিরা।”

তিনি বলেন, এবার দাম ও বেচাকেনা দুটোই ‘ভালো’ হওয়ায় তারা দারুণ খুশি। ফুলের উৎপাদন, চাহিদা ও দাম-সবই বেশ ভালো। এ অঞ্চলের ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি ফুটেছে।

“এবার ৫০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

গদখালির বিভিন্ন মাঠে এখন টিউলিপ, লিলিয়াম, গোলাপ, রজনীগন্ধা, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জিপসি, রডস্টিক, কেলেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল শোভা পাচ্ছে।

চাষিরা জানান, ভালবাসা দিবসকে ঘিরে নেদারল্যান্ডসের জাতীয় ফুল 'টিউলিপ' ও সুগন্ধি ফুল 'লিলিয়ামের' প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি থাকে। তাছাড়া রঙিন গ্লাডিওলাস, জারবেরা, রজনীগন্ধা আর নানা রঙের গোলাপ তো রয়েছেই।

গাঁদা ফুল বেশি বিক্রি হয় একুশে ফেব্রুয়ারি আর বসন্ত উৎসবে।

পানিসারা গ্রামের লিলিয়াম ফুলচাষি সোনিয়া পারভীন বলেন, একটি লিলিয়াম ও টিউলিপ ফুলের গাছ বিক্রি করছি ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। ভিনদেশি এই ফুল বাংলাদেশে প্রথম চাষ হওয়ায় বেশ আগ্রহ ফুলপ্রেমিদের। প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ ফুলক্ষেত দেখতেও আসছেন।

হাঁড়িয়া নিমতলা গ্রামের ফুলচাষি আশরাফ হোসেন বলেন, "বসন্তের আগে কয়েকদিনে ১৭ কাঠা জমির গাঁদা ফুল বিক্রি করিছি ৭০ হাজার টাকায়। গত বছর এই সময় মাত্র দুশ টাকার ফুল বিক্রি করতে পেরেছিলাম।"

গদখালির ফুলচাষি আব্দুস সোবহান বলেন, " এবার ফুলের দাম ভালো পাওয়ায় এলাকার ফুলচাষিদের মুখে অন্তত হাসি ফুটেছে।”

এ বছর ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত পাঁচটি উৎসবে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে মনে করেন পানিসারার পটুয়াপাড়া গ্রামের ফুল চাষি লোকমান শেখ। তিনি ১৫ কাঠা জমিতে জারবেরা আর দেড় বিঘা জমিতে গাঁদা ফুলের চাষ করেছেন।

লোকমান বলেন, "গেল বছর এই সময়ে ৫০ হাজার টাকার ফুলও বিক্রি করতি পারিনি। তবে এবার লাখ টাকার ফুল বিক্রি করিছি।"

নীমতলা গ্রামের গোলাপ ফুল চাষি সাকিল হোসেন বলেন, “গত বছর এ সময় ফুল বিক্রিই করতি পারিনি। এ বছর তিন উৎসবকে সামনে রেখে ৩ দিনে প্রায় ৫০ হাজার টাকার গোলাপ বিক্রি করেছি। আমরা দারুণ খুশি।”

এ বছর ফুল খুব ভালো হয়েছে বলে জানালেন পটুয়াপাড়া গ্রামের ফুলচাষি নজরুল ইসলাম। প্রায় ৮২ শতক জমিতে রজনীগন্ধা, গোলাপ ও কামিনী চাষ করা এ চাষির আশা, এবার আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবেন।

গদখালি ফুলচাষি কল্যাণ সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক রনি আহম্মদ বলেন, মহামারী কিছু দিন আগেও ফুল চাষিদের গলার ফাঁস হয়ে তাদের সব স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছিল। এই ফেব্রুয়ারির তিনটি দিবস উপলক্ষে ফুলের ব্যাপক চাহিদা ও ভালো দাম থাকায় সেই ফাঁস এখন চাষিদের গলার মালা হয়ে ধরা দিয়েছে।

ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ বলেন, এ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের প্রায় ৬৩০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হচ্ছে। ফুল চাষের সঙ্গে এখানকার প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কৃষক এবং প্রায় এক লাখ শ্রমিক সম্পৃক্ত রয়েছেন।

এ বছর ২৭২ হেক্টর জমিতে গ্লাডিওলাস, ১৬৫ হেক্টর জমিতে রজনীগন্ধা, ১০৫ হেক্টর জমিতে গোলাপ, ৫৫ হেক্টর জমিতে গাঁদা, ২২ হেক্টর জমিতে জারবেরা এবং অন্যান্য ফুল চাষ করা হচ্ছে প্রায় ৬ হেক্টর জমিতে।

‘ফুলের বাজার ডটকম' নামক অনলাইনের তরুণ ফুল উদ্যোক্তা মো. আলামিন বলেন, গদখালি ফুল বাজারে লিলিয়াম ফুল প্রতি পিস দেড়শ থেকে দুইশ টাকা, গোলাপ ফুল প্রতি পিস ৮-১০ টাকা, চায়না গোলাপ লংস্টিক রোজ ২৫-৩০ টাকা, রজনীগন্ধা স্টিক ৮-১০ টাকা, গ্লাডিওলাস ফুল রঙ ভেদে ৮-১৫ টাকা, জারবেরা প্রতিটি ১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

তাছাড়া চন্দ্রমল্লিকা ৩ থেকে ৪ টাকায়, গাঁদা প্রতি হাজার সাড়ে তিনশ থেকে ৫০০ টাকা, রডস্টিক প্রতি বান্ডিল ১৫০ টাকা, জিপসি ফুল প্রতি আঁটি ৪০ টাকা ও কামিনী পাতা প্রতি আঁটি ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মনজুরুল হক বলেন, জেলায় এ বছর ৭০০ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হয়েছে। গত বছর ৬৪০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছিল। এ বছর ৬ হাজার চাষি ফুলচাষ করেছেন।

জেলার ৯৫ শতাংশ ফুল চাষ হয় ঝিকরগাছা উপজেলায়। সেখানে এ বছর ৬৩০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি পানসারি ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি ফুল চাষ হয়।