‘রাজাকার কী? আমার বাবা ছিলেন শান্তি কমিটির সদস্য’

নাঙ্গলকোট উপজেলা চেয়ারম্যান সামছুদ্দিনের বাবা হাজী আলী আকবর শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন।

আবদুর রহমান, কুমিল্লা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Nov 2022, 05:21 PM
Updated : 9 Nov 2022, 05:21 PM

১৯৮৩ সালে উপজেলা হওয়ার আগে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট ছিল জেলার লাকসাম ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলার অংশ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নাঙ্গলকোটে যে কয়েকজন পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের অন্যতম বলা হয়ে থাকে হাজী আলী আকবরকে। 

আলী আকবর বেশ কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। তবে নাঙ্গলকোটে এখনও আকবর পরিবারের দাপট কমেনি। 

মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, একাত্তরে ‘রাজত্ব’ করছেন আলী আকবর আর বর্তমানে নাঙ্গলকোটে ‘রাজত্ব’ করে যাচ্ছেন তার সন্তান। 

কুমিল্লার নাঙ্গলকোট পৌরসভার নাঙ্গলকোট গ্রামের সেই আলোচিত আলী আকবরের সন্তান সামছুদ্দিন কালু গত দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। সবশেষ বিনাভোটে নির্বাচিত বর্তমানে উপজেলা চেয়াম্যানের পদে থাকা কালু এর আগে দলটির সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র। কালু বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য; আগে একবার হয়েছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। 

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাবার মুক্তিযুদ্ধকালীন অবস্থান নিয়ে কালুর দেওয়া একটি বক্তব্যের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। 

এতে দেখা যায় কালু বলছেন, “আমার প্রশ্ন হলো রাজাকারটা কী? এ কথা আমি আগেও অনেকবার বলেছি আমার বাবা রাজাকার না। আমার বাবা শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন, আমি রাজাকারের ছেলে নই।” 

এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি চলতি বছরের ৮ এপ্রিলের। কালুর বাবাকে নিয়ে এ বছরের স্বাধীনতা দিবসের সময় কানাঘুষা হয়। এর মধ্যে ৮ এপ্রিল উপজেলা সদরে নিজ কার্যালয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন কালু। 

সেখানে কালু বলেন, “আমার বাবা কখনও রাজাকার ছিলেন না। তিনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি পাকবাহিনীর হাত থেকে এলাকার লোকজন এবং তাদের বাড়িঘর রক্ষা করছেন। ওই সময়ে আওয়ামী লীগের পলিসি ছিল শান্তি কমিটির সদস্য হয়ে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কাজ করা। আমার বাবা একটা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ক্ষতি করেননি। আমি অনেকবার বলেছি আমার বাবা শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন, আমি রাজাকারের ছেলে নই, আর আমি ছাত্রলীগ করেছি।” 

তবে বিষয়টি মানতে নারাজ যুদ্ধকালীন চৌদ্দগ্রামের (বর্তমান নাঙ্গলকোটের ৭টি ইউনিয়ন) জোনাল কমান্ডারের দায়িত্বে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধ মহসিন ভূঁইয়া। 

নাঙ্গলকোট উপজেলার মোকরা ইউনিয়নের আলিয়ারা গ্রামের বাসিন্দা মহসিন ভূঁইয়া বলেন, যুদ্ধকালীন নাঙ্গলকোট অঞ্চলে মাদার অর্গানাইজেশন ছিল শান্তি কমিটি। শান্তি কমিটির সদস্যরাই ওই সময়ে রাজাকার, আলবদর, আলশামস তৈরি করেছিল এবং তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিল। 

“১৯৭১ আলী আকবরের ভূমিকা আমরা সবাই জানি। তিনি (কালু) যেই দাবি করেছেন সেটা মোটেও সঠিক না। স্বাধীনতার পর আলী আকবরের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে। তিনি দীর্ঘদিন ওই মামলায় কারাগারে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর জিয়াউর রহমানের আমলে এই মামলা থেকে অন্যদের মতো আলী আকবরও রেহাই পান।” 

বৃহত্তর কুমিল্লার যুদ্ধাপরাধের দলিলপত্র নিয়ে লেখা কুমিল্লার আবুল কাশেম হৃদয়ের ‘অপারেশন কিল এন বার্ন’ নামের বইয়েও কালুর বাবা আলী আকবরের কথা উল্লেখ রয়েছে। 

ওই বইয়ে দেওয়া তথ্যে উল্লেখ করা হয়, ১৯৭২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্র বাদী হয়ে দ্যা বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) বা দালাল আইনে লাকসাম থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারভুক্ত চার নম্বর আসামি ছিলেন নাঙ্গলকোট গ্রামের হাজী আলী আকবর। মামলায় তার বিরুদ্ধে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, দখল-লুটপাট, গুমসহ বিভিন্ন অভিযোগ করা হয়। 

মুক্তিযোদ্ধাদের সময় নাঙ্গলকোটের সবচেয়ে আলোচিত ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা পল্লি চিকিৎসক কলিম উল্লাহ হত্যাকাণ্ড। শহীদ কলিম উল্লাহর বাড়ি উপজেলার হেসাখাল গ্রামে। 

তার ছেলে সৈয়দ আহমেদ আলম বলেন, “উপজেলা চেয়ারম্যানের বাবাসহ কয়েকজন হানাদার বাহিনীদের নিয়ে এসে আমার বাবাকে প্রথমে পিটিয়ে বেহুশ করে এবং পরে গুলি করে হত্যা করে। আমার বাবা ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে দেশকে স্বাধীন করতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, এটাই ছিল তার অপরাধ।” 

লাকসাম পৌরসভার ভোজপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু ইউসুফ মজুমদার বলেন, “যুদ্ধের সময় নাঙ্গলকোটের বেশিরভাগ অংশ লাকসামের ছিল। পল্লি চিকিৎসক কলিম উল্লাহ আমার আপন বোন আনোয়ারা বেগমের স্বামী। যেদিন তাকে হত্যা করা হয়, সেদিন আমিও তাদের বাড়ির পাশেই ছিলাম। যুদ্ধাপরাধী আলী আকবরের নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ডা. কলিম উল্লাহর বাড়ি গিয়ে তাকে পিটিয়ে হাত-পায়ে গুলি করে চলে যাচ্ছিল। 

“কিছুদূর যাওয়ার পর আলী আকবর তাকিয়ে দেখেন আমার ভগ্নিপতি নড়াচড়া করছেন। এরপর তিনি হানাদারদের ঘুরিয়ে এনে আমার ভগ্নিপতির বুকের মধ্যে এলোপাতাড়ি গুলি করান। সঙ্গে সঙ্গে তিনি শহীদ হন। 

“ভাবতে অবাক ও দুঃখ লাগে আজকে সেই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী হাজী আলী আকবরের সন্তানই নাঙ্গলকোটের রাজত্ব করছে।” 

এদিকে, আগামী ডিসেম্বরের শুরুতে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে হবে নাঙ্গলকোট উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মলন। তাতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও হতে পারেন সামছুদ্দিন কালু। 

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কালুর রাজনৈতিক জীবনের যাত্রা শুরু হয় জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। কালু সে সময় যুব কমপ্লেক্সের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এরপর এরশাদ সরকারের আমলে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে ১৯৮৭ সালে জাতীয় পার্টির উপজেলা সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ কালু আওয়ামী লীগে যোগ দেন।   

নাঙ্গলকোট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য শাহজাহান মজুমদার বলেন, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তার (কালুর) বাবা হাজী আলী আকবরের নামে ৭২ সালে মামলা হওয়ার ঘটনা এরই মধ্যে সবাই জানে। এসব নিয়ে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই চাপা ক্ষোভ রয়েছে। 

নাঙ্গলকোট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু ইউসুফ বলেন, “দলের নীতি নির্ধারকরা সবই জানেন। তারা যেটা ভালো মনে করেন সেটাই করছেন।” 

এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সামছুদ্দিন কালু বলেন, “বিভিন্ন মাধ্যমে এই ধরনের আলোচনা হলে চলতি বছরের ৮ এপ্রিল স্থানীয় সাংবাদিকরা আমার কাছে বিষয়টি জানতে আসেন। পরে আমি তাদের কাছে বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়েছি। 

“আমার বাবা কখনও রাজাকার বা যুদ্ধাপরাধী ছিলেন না। তিনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি পাকবাহিনীর হাত থেকে এলাকার লোকজন এবং তাদের বাড়িঘর রক্ষা করছেন।” 

ওই সময়ে আওয়ামী লীগের পলিসি ছিল শান্তি কমিটির সদস্য হয়ে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কাজ করা, বলেন তিনি। 

“আমার বাবা একটা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ক্ষতি করেননি। ২-৪ জন নেতা আমার সাথে পেরে উঠতে পেরে হিংসাত্মক মনোভাব নিয়ে আমাকে অপমান এবং ছোট করার জন্য এসব অপপ্রচার শুরু করছে।” 

কালু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার বাবা অন্যায় করলে সেটা তার ব্যাপার। এখানে আমার অপরাধটা কী? আমি রাজনীতি করি, এটা কি আমার অপরাধ? আমাদের দলের কিছু মানুষ এখন এগুলো সামনে আনছেন। কার বাপ-দাদা কী করেছেন, সেটা তাদের বিষয়। আমার বাবা শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন, তাই বলে কি আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে রাজনীতি করতে পারব না?”