চার দিনেও অধরা কুমিল্লার যুবলীগ নেতা জামালের খুনিরা

মৃত্যুর আগে জামাল দুই খুনির নাম বলে গেছেন- এজাহারে দাবি করছেন পরিবারের সদস্যরা।

কুমিল্লা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 May 2023, 06:09 AM
Updated : 5 May 2023, 06:09 AM

কুমিল্লার দাউদকান্দিতে বোরকা পরা দুর্বৃত্তদের গুলিতে যুবলীগ নেতা জামাল হোসেন খুন হওয়ার চারদিন পার হলেও এখনও কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহতের পরিবারের সদস্যরা।

তবে পুলিশের ভাষ্য- খুনিদের ধরতে মাঠে কাজ করছে আইনশৃংখলা বাহিনীর বেশ কয়েকটি ইউনিট। 

তিতাস উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জামাল হোসেনকে খুনের ঘটনায় মঙ্গলবার মধ্যরাতে ১৭ জনকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করেন নিহতের স্ত্রী পপি আক্তার।

মামলায় নয়জনকে এজাহারনামীয় ও আটজনকে অজ্ঞাতনামা হিসেবে আসামি করা হয়েছে।

এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন- তিতাস উপজেলার জিয়ারকান্দি গ্রামের মো. সুজন, আরিফ হোসেন, ইসমাইল হোসেন, মনাইরকান্দি গ্রামের শাহিনুল ইসলাম ওরফে সোহেল শিকদার, জিয়ারকান্দি গ্রামের বাদল, শাকিল, দাউদকান্দির গোপচর গ্রামের শাহ আলম, তিতাসের জিয়ারকান্দি গ্রামের অলি হাসান ও কালা মনির।  

নিহতের পরিবারের সদস্যদের দাবি- খুনের পরিকল্পনাকারী বা মাস্টারমাইন্ড হচ্ছেন তিতাস উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহিনুল ইসলাম ওরফে সোহেল শিকদার। আর মামলার আসামিরা সকলেই ‘শিকদার বাহিনী’র সদস্য। 

মৃত্যুর আগে জামাল দুই খুনির নাম বলে গেছেন জানিয়ে পরিবারের সদস্যরা বলছেন, মামলার ২ নম্বর আসামি আরিফ বোরকা পরা তিন দুর্বৃত্তের মধ্যে একজন। হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলে যাওয়ার সময় তাঁর বোরকার নেকাব খুলে যায়। আরেক আসামি ইসমাইল হোসেন হত্যাকাণ্ডের আগে জামাল হোসেনের পাশে ছিলেন।

গত ৩০ এপ্রিল রাত ৮টার দিকে দাউদকান্দির গৌরীপুর পশ্চিম বাজার ঈদগাহ এলাকার মসজিদ গলিতে জামাল হোসেনকে (৪০) গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

জামাল তিতাস উপজেলার জিয়ারকান্দি নোয়াগাঁও গ্রামের ফজলুল হকের ছেলে। তিনি গৌরীপুর পশ্চিম বাজার এলাকার ভাড়া বাসায় থাকতেন এবং ওই বাজারের ব্যবসায়ী ছিলেন।

ওই যুবলীগ নেতাকে গুলি করে হত্যার ঘটনার সময়ের কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ফুটেজে দেখা যায়- হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া তিন দুর্বৃত্তের সকলেই ছিলেন বোরকা পরা। দশ সেকেন্ডের মধ্যে তারা পরপর তিনটি গুলি চালিয়ে জামালের মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়।

এই মামলার বেশির ভাগ আসামি গৌরীপুর বাজারে খুন হওয়া জিয়ারকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মনির হোসাইন হত্যা মামলার আসামি।

স্থানীয় এলাকাবাসী ও নিহতের পরিবারের লোকজন জানায়- গৌরীপুর বাজারসহ তিতাস উপজেলা সদরের আধিপত্য নিয়ে ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর গৌরীপুর বাস স্ট্যান্ডে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ও কুপিয়ে খুন করা হয় মনির  ও তার সহযোগী মহিউদ্দিনকে।

সাড়ে ৬ বছর পর অনেকটা একই রকমভাবে খুন করা হয়েছে মনিরের অনুসারী যুবলীগ নেতা জামালকে। এ ছাড়া জামাল মনিরের হত্যা মামলার তদারকি ও তদবির করতেন।

পরিবারের দাবি: দু জনের নাম বলে গেছেন জামাল

এদিকে মৃত্যুর আগে জামাল দুই খুনির নাম বলে গেছেন- এজাহারে দাবি করছেন পরিবারের সদস্যরা।

এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার জামালের শ্যালিকা সুপা বেগম বলেন, “যেখানে জামাল ভাই খুন হয়েছে- তার সামনের ভবনের দোতলায় আমাদের বাসা। গুলির শব্দ শুনে আমি দোতলা বাসা থেকে নেমে ভাইকে কোলে তুলি। তখনো তাঁর জ্ঞান ছিল।

“মৃত্যুর আগে তিনি খুনিদের মধ্যে সুজন ও আরিফের নাম পর্যন্ত বলে যেতে পারেন। এরপর ঘাড় ফেলে দেন। আমরা খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তার চাই।”

তিতাসের জিয়ারকান্দি গ্রামের মো. জাহিদ হোসেনকে এ মামলার সাক্ষী করা হয়েছে। তিনি বলেন, “খুনিরা জামালের বুকের মাঝে ও পেটের বাঁ পাশে করার পর ফাঁকা গুলি ছুড়ে পালিয়ে যান। তখন আমরা বোরকা পরা একজন আরিফকে শনাক্ত করি।”

নিহতের স্ত্রী পপি আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের বলেছেন, “পুলিশ চাইলেই এ ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে পারে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের চার দিনেও একজনকে ধরা হয়নি। এটা দুঃখজনক ঘটনা।”

নিহত জামালের বোন রিপা বেগম বলেন, “আমার ভাইকে খুনের ঘটনায় মামলার আসামিরা ছাড়াও নেপথ্যে আরও লোকজন জড়িত থাকতে পারে। আমরা খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তার এবং নেপথ্যে যারা জড়িত- তাদেরকে সামনে আনার দাবি জানাই।”

পরিকল্পনাকারী হিসেবে সোহেল শিকদারের নাম এজাহারে

জামাল হত্যা মামলার আসামিরা সকলেই ‘শিকদার বাহিনী’র সদস্য বলে দাবি করে এই হত্যার ‘পরিকল্পনাকারী’ হিসেবে তিতাস উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সোহেল শিকদারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এজাহারে।

মনির হত্যা মামলা তুলে না নেওয়ার জের ধরে তাকে সোহেল শিকদারসহ অন্যরা হত্যা করেছে দাবি করে জামালের স্ত্রী মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন- জামালকে হত্যার আগে তার উপর সোহেল শিকদারের নেতৃত্বে একাধিকবার হামলা এবং প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে।

সোহেল শিকদার মনির খুনেরও পরিকল্পনাকারী ছিলেন বলে দাবি করে পরিবারের সদস্যরা জানান, মনির হত্যা মামলাটি আপস করার জন্য আসামিরা মনিরের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার ও জামালকে বিভিন্নভাবে চাপ দিতেন।

হত্যাকাণ্ডের কিছু সময় আগে জামাল হোসেন যখন বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তখন মামলার ৩ নম্বর আসামি ইসমাইল সেখানে অবস্থান করে জামাল হোসেনকে ঠাণ্ডা পানি খাওয়ানোর কথা বলে সময় ক্ষেপণ করেন। এর কিছুক্ষণ পরই বোরকা পরা ৩ সন্ত্রাসী এসে গুলি চালায়।

এজাহারে হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে ‘সন্ত্রাসী সোহেল শিকদার বাহিনী’র সঙ্গে বিরোধ চলছিল তিতাসের বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার। ‘শিকদার বাহিনীর এসব কর্মকাণ্ডে যারাই পথের কাটা হয়েছে’- তাদের অনেককেই এ বাহিনীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে।

মনির নিহত হওয়ার পর জামাল হোসেন তার গ্রুপের নেতৃত্ব এবং হত্যা মামলার তদারকি করতেন জানিয়ে এজাহারে বলা হয়, মনির হত্যা মামলায় ডিবি পুলিশের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন সোহেল শিকদার। পরবর্তীতে জামিনে বেরিয়ে এসে জামাল এবং মনির হত্যার মামলার বাদী নিহতের স্ত্রীকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দিতে থাকে।

মনিরের ঢাকার বাসায় গিয়ে তার স্ত্রী এবং জামালকে এলাকায় প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। পরে মনিরের স্ত্রী ঢাকার কদমতলী থানায় এ বিষয়ে সোহেল শিকদারের নামে সাধারণ ডায়েরিও করেন।

এ ছাড়া ২০২২ সালের ২ নভেম্বর মনির হত্যা মামলায় স্বাক্ষীদের নিয়ে আদালতে আসেন জামাল হোসেন। ওই সময় আদালতের অভ্যন্তরে জামালসহ মামলার স্বাক্ষীদের উপর হামলা করেন সোহেল শিকদারসহ অন্যরা।

অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট: সোহেল শিকদার

এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার মোবাইলে আওয়ামী লীগ নেতা শাহিনুল ইসলাম ওরফে সোহেল শিকদার সাংবাদিকদের বলেন, “আমি তিতাসের বাসিন্দা। আর ঘটনা ঘটেছে দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর বাজারে। এর সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমি সেখানে ছিলামও না।

“মূলত একটি মহল আমাকে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করার জন্য একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে।”

তিনি আরও বলেন, “এ ছাড়া গৌরীপুর বাজারে তারাই আধিপত্য বিস্তার করে। আমি তো সেখানে যাইও না। এটা আমার এলাকাও না। আমার বিরুদ্ধে করা এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।”

আসামিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে: পুলিশ

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দাউদকান্দি মডেল থানার ওসি আলমগীর হোসেন ভূঁইয়া বলেন, “এখন পর্যন্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। আসামিরা এলাকা থেকে গা-ঢাকা দিয়েছে।

“তবে আসামিদের ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। এজন্য পুলিশের সঙ্গে অন্যান্য সংস্থাও আন্তরিকভাবে কাজ করছে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।”

কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার মো. আব্দুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, “সবকিছু দেখে বোঝা যাচ্ছে- পরিকল্পনা করেই জামালকে হত্যা করা হয়েছে। যাকে বলা হয় ‘টার্গেট কিলিং’।”

এর আগে তিতাস, জিয়ারকান্দি, গৌরীপুর এলাকায় আধিপত্য নিয়ে অনেকগুলো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন,  “আমরা অতীতের সব বিষয়-ঘটনা আমলে নিয়ে তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। ঘটনার সাথে জড়িতরা রেহাই পাবে না। তাদের গ্রেপ্তার করতে মাঠে অভিযান চলছে।”