একটি ভোটকেন্দ্রে হামলা ও ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের কারণে এই আসনের ফলাফল স্থগিত করার কথা জানায় নির্বাচন কমিশন।
Published : 08 Jan 2024, 06:25 PM
ময়মনসিংহ জেলায় ১১টি আসনের মধ্যে ১০টির ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। গৌরীপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-৩ আসনের ফলাফল স্থগিত করা হয়েছে। একটি ভোটকেন্দ্রে হামলা ও ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের কারণে এই আসনের ফলাফল স্থগিত করার কথা জানায় নির্বাচন কমিশন।
এখানে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান ৯৮৫। উপজেলার ৯২টি কেন্দ্রের মধ্যে ৯১টি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। সহনাটি ইউনিয়নের ভালুকাপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের ফলাফল বাতিল করা হয়েছে।
৯১টি কেন্দ্রের ফলাফলে নৌকার প্রার্থী ও উপজেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট নিলুফার আনজুম পপি পেয়েছেন ৫৩ হাজার ১৯৬ ভোট। অপরদিকে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোমনাথ সাহা ট্রাক প্রতীকে পেয়েছেন ৫২ হাজার ২১১ ভোট।
ভালুকাপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ভোটার ৩ হাজার ৩১ ভোট। যেহেতু দুই প্রার্থী ভোটের ব্যবধানের চেয়ে কেন্দ্রের ভোট সংখ্যা বেশি তাই এই আসনের ফলাফল ঘোষণা করা যায়নি বলে জানিয়েছেন জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ কামাল চৌধুরী।
নিলুফার আনজুম পপি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা প্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিলের স্ত্রী। তিনি ২০২২ সালের শেষ দিকে আওয়ামী লীগের গৌরীপুর উপজেলার সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। তার শ্বশুর অ্যাডভোকেট জহিরুল হক ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।
সোমনাথ সাহা উপজেলা ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও পরিবহন মালিক সমিতির নেতা। দলের মনোনয়ন না পেয়ে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। এই আসন থেকে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফ হাসান অনু কেটলি প্রতীকে ৯ হাজার ২২৬ ভোট পেয়েছেন। আরেক আওয়ামী লীগ নেতা নাজনীন আলম পেয়েছেন ২ হাজার ২৫০ ভোট।
ভালুকাপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নরোত্তম চন্দ্র রায় রোববার বিকালে বলেছিলেন, ওই কেন্দ্রে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে ভোটগ্রহণ চলছিল। দুপুর আড়াইটার দিকে এক দুর্বৃত্ত এসে একটি কক্ষ থেকে একটি ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নিয়ে যায়। তারপরও ভোটগ্রহণ চলছিল।
এরপর বিকাল সোয়া ৪টার দিকে আরও লোকজন এসে কেন্দ্রে হামলা ও ভাঙচুর করে পাঁচটি ব্যালট বাক্সসহ ছিনতাই করে নিয়ে যায়। কেন্দ্র থেকে বিষয়টি সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানো হয়। পরে কেন্দ্রটির ভোট বাতিল করা হয়।
কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে এ বিষয়ে কোনো কিছু বলেননি প্রিজাইডিং কর্মকর্তা।
সোমবার নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়েছে, ওই কেন্দ্রে ১৩ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ হবে।
ওই কেন্দ্রের ভোট নিয়ে আলোচনার মধ্যে সোমবার দুপুরে ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে অনিয়ম হওয়া কয়েকটি কেন্দ্রে পুন:ভোটের দাবি জানান।
এ সময় লিখত বক্তব্যে সোমনাথ সাহা অভিযোগ করে বলেন, “বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টদের জিম্মি করে সিলমারার পাশাপাশি একটি ভোটকেন্দ্রের ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নৌকার কর্মী-সমর্থকরা। তার ভিডিও স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে রয়েছে।
“অনিয়ম হওয়ায় কোনাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শাহগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ, ভুটিয়ারকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাওহা নয়ানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রউজ বিদ্যা নিকেতন, গোবিন্দনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শহীদ মধূসুদন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে পুনরায় ভোট গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।”
তবে এসব অনিয়মের বিষয়ে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী নিলুফার আনজুম পপির মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি তা রিসিভ করেননি।
গৌরীপুর উপজেলার কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে কেন্দ্রটির ভোট বাতিল করা হয়েছে সেটি মূলত নৌকা প্রতীকের। দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান কম, আবার ভোটের পরিমাণও এখানে কম। ফলে দুই প্রার্থীই চেষ্টা করবেন জয় পেতে। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী যেহেতু একটি পিছিয়ে আছেন তার জন্য একটু কঠিন।
তারা বলেন, সারাদেশে নৌকার প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। ফলে উন্নয়নের স্বার্থে সাধারণ ভোটারদের শেষ মুহূর্তে নৌকাকে পাশ করানোর মত একটা ঝোঁক তৈরি হতে পারে।
সহনাটি ইউনিয়ন পরিষদের দুইবারের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, “এই ইউনিয়নটি মূলত আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। স্বাধীনতার পর থেকে নৌকা ছাড়া অন্য কোনো প্রতীকে কেউ নির্বাচন করে সুবিধা করতে পারেননি।
“তবে এবার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নিলুফার আনজুম পপি এবং সাধারণ সম্পাদক সোমনাথ সাহা নির্বাচন করায় ভোটের চিত্রটা ভিন্ন হয়েছে।
ভালুকাপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে পুনরায় ভোট হলে কী ফলাফল হতে পারে- জানতে চাইলে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দুইবারের সাবেক সভাপতি বলেন, “নৌকা অনায়াসেই জয়ী হবে। যেহেতু এমনিতেই নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এগিয়ে রয়েছেন। এ ছাড়া ভোটের ক্ষেত্রে পপির পক্ষে মানুষের একটা আবেগ কাজ করবে।”
ওই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি রুহিদাস আচার্য্য বলছিলেন, “আগে এই কেন্দ্রটি নৌকার ছিল, এখানে নৌকাই সবসময় পাশ করেছে। তবে নানা কারণে এখানে নৌকার ভোট কমেছে।
“এখানে তিন হাজারের কিছু বেশি ভোট আছে। যদি ধরে নেই, দুই হাজারের বেশি ভোটও পড়ে তাহলে কিন্তু সোমনাথের পাশ করা কঠিন। ফলে অংকের হিসাবে নৌকা বের হয়ে যেতে পারে”, বলেন রুহিদাস।
তবে সহনাটি ইউনিয়নের একজন ভোটার বলছিলেন, “কঠিন হলেও সোমনাথ সাহা চেষ্টা করবেন বেরিয়ে আসার। এ ছাড়া এখানে আরও দুজন আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তাদেরও ভোট আছে। তারাও পরবর্তী ভোটে কী ভূমিকা নেন, তারা নিজেরা যেহেতু পাশ করবেন না ফলে তাদের সমর্থকরা কোন দিকে ঝুঁকবেন সেটাও দেখতে হবে।”
কেন এই কেন্দ্রটিতে হামলা হল- এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই ভোটার বলছিলেন, “গৌরীপুরে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে এটা আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। আর এই কেন্দ্রটিতে নৌকা বেশি ভোট পাবে এটা ধারণা করা হয়। কিন্তু ট্রাক প্রতীকের প্রচুর সমর্থক এখানে আছে। হয়তো নানা সমীকরণ করেই এটা করা হয়েছে।”
তবে কারা এটা করেছে এ বিষয়ে ওই ভোটার কিছু বলতে রাজি হননি।
জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ কামাল চৌধুরী বলেন, “ব্যবধানের চেয়ে স্থগিত কেন্দ্রের ভোট বেশি হওয়ায় কোনো প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়নি। ওই কেন্দ্রে পুনরায় ভোট গ্রহণ হবে।
“তবে অন্যকোনো কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে কি-না আমরা অভিযোগ পায়নি। অভিযোগ পেলে সেগুলোও খতিয়ে দেখা হবে।”