জেলার ছয় উপজেলার প্রায় প্রত্যেকটি সড়ক-মহাসড়ক কৃষকের ধান, খড় আর বিচালি দখলে।
Published : 11 Jun 2024, 10:09 AM
সড়ক-মহাসড়ক দখল করে মেশিন বসিয়ে ধান মাড়াইসহ খড় শুকানোর কাজ করছেন নীলফামারীর কৃষকরা। ফলে ধান-খড় শুকানোর চাতালে পরিণত হয়েছে জেলার সড়কগুলো।
ছয় উপজেলার প্রায় প্রত্যেকটি সড়ক-মহাসড়ক এখন কৃষকের ধান, খড় আর বিচালির দখলে। এ অবস্থায় প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটছে প্রাণহানি।
তবে খালি জমি বা বাড়ির আশপাশে জায়গা না থাকায় কষ্টের ফসল ঘরে তুলতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সড়কেই মাড়াই ও শুকাতে বাধ্য হচ্ছেন বলে দাবি কৃষকদের।
এদিকে, প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা দ্রুত উদ্যোগী না হলে এসব সড়কে দুর্ঘটনাসহ প্রাণহানি বাড়বে বলে দাবি করেন যানবাহন চালকরা।
সড়ক-মহাসড়কে যানচলাচল স্বাভাবিক রাখতে বিশেষ উদ্যোগের কথা জানিয়েছে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সড়কগুলো দখল করে খলান কিংবা চাতালে পরিণত করে মাড়াই থেকে শুরু করে ধান ও খড় শুকাতে ব্যস্ত কৃষকেরা। শুধু বোরো আর আমন মৌসুমেই নয়; এসব সড়ক কৃষকদের দখলে থাকে ভুট্টা, গম ও পাট মৌসুমেও।
আইন অনুযায়ী সড়কে ফসল, খড় বা বিচালিসহ যেকোনো পণ্য শুকানো নিষেধ থাকলেও তা মানছেন না কৃষকরা।
সোমবার সকালে দেখা যায়, নীলফামারী-সৈয়দপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক, নীলফামারী-ডোমার আঞ্চলিক মহাসড়ক, ডোমার-চিলাহাটি সড়ক, ডোমার-ডিমলা সড়ক, নীলফামারী-ডিমলা, জলঢাকা-কিশোরগঞ্জ সড়কে চলাচল করছে ছোট-বড়, ভারী, মাঝারি ও হালকা যানবাহন।
২৩ কিলোমিটারের নীলফামারী-ডোমার আঞ্চলিক মহাসড়ক দখল করে সড়কের উপর কৃষক-কৃষাণীরা ধান মাড়াই করছেন, কেউবা ধান ও খড় শুকাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার সড়কের দুধারে বিচালি স্তুপের কাজ করছেন।
শুকাতে দেওয়া ধানের উপর দিয়ে যেন যানবাহন যেতে না পারে সেজন্য ইট, বাঁশ বা কাঠের টুকরো দিয়ে বন্ধ রাখা হয়েছে সড়ক। দুই পাশে ধান ও খড় শুকানোয় সংকুচিত হয়ে পড়েছে সড়কটি।
এতে ওই সড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে যানবাহনগুলোকে চলাচল করতে হচ্ছে।
সকাল থেকে ডোমার বামুনিয়া এলাকায় ডোমার-ডিমলা সড়কের উপর মেশিন বসিয়ে ধান মাড়াই করছিলেন কৃষক আফসার আলী (৫২)।
তিনি বলছিলেন, “প্রায় ৭০ বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছি। এরই মধ্যে সব ধান কাটা হয়েছে। এতোগুলো ধান শুকাবো কোথায়? ক্ষেতসহ বসতবাড়ির আশপাশে কোথাও ধান শুকানোর খলান নাই। ধান মাড়াই করে শুকাতে না পারলে সব নষ্ট হয়ে যাবে। খলান না থাকায় সড়কের উপর ধান মাড়াইসহ শুকাতে হচ্ছে। যদি খলান থাকতো তাহলে কি আর সড়কে শুকাতাম!”
ওই সড়কের কিছু দূর গিয়ে দেখা যায়, ধান শুকাচ্ছেন কয়েকজন কৃষক-কৃষাণী। শুকনো ধানের ওপর দিয়ে যেন যানবাহন যেতে না পারে এজন্য অর্ধেক রাস্তা ইট দিয়ে বন্ধ করে রেখেছেন তারা।
এ সময় সেখানে ধান উল্টে দিচ্ছিলেন স্মৃতি বেগম (৩৫) নামে এক কৃষাণী। কৃষক আফসার আলীর মত একই কথা বললেন তিনি।
তিনি বলেন, “আমাদের কারণে হয়ত মানুষসহ যানবাহনের চলাচলে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু আমরাও নিরূপায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যদি এই ধানগুলো শুকিয়ে ঘরে তুলতে না পারি তাহলে আমরা খাব কী?”
৪৮ বছর বয়সি কৃষক সফিকুল ইসলাম বলেন, “এক সময় প্রতিটি গ্রামের খলান ছিল। কৃষকরা নিজেদের খলানে ধান মাড়াই থেকে শুরু করে ধান ও খড় শুকাত। এখন সেই খলান আর নেই! পারিবারিক কারণে বাবা-ছেলে-ভাই-বোনের মধ্যে জমির ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে এতে যে যতটুকু ফসলি জমি পাচ্ছে তাতে শুধু ফসল আবাদ করছে। কিন্তু সেই ফসল কোথায় মাড়াই করে শুকাবে তা কেউ চিন্তা করছে না। কারণ প্রত্যেকটি গ্রামে পাকা-কাঁচা সড়ক রয়েছে। আমরা কৃষকরা সেই সড়কেই ধান থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি ফসল মাড়াই ও শুকাতে পারছি।”
ওই সড়ক দিয়ে অটোরিকশায় যাত্রী নিয়ে ডোমার যাচ্ছিলেন চালক মশিউর রহমান (৪০)।
তিনি বলেন, “সড়কে ধান, ভুট্টা, গম এবং খড় শুকানো হচ্ছে। এতে সড়কে চরম ঝুঁকি নিয়ে আমাদের চলাচল করতে হচ্ছে। চলন্ত গাড়ি থামতে ব্রেক চাপলে ধান আর খড়ে স্লিপ করে দুর্ঘটনায় পড়তে হচ্ছে।”
আবু সুফিয়ান (৩৬) নামে এক ট্রাকচালক বলেন, “পঞ্চগড় থেকে পাথর বোঝাই করে ট্রাক নিয়ে গাইবান্ধা যাব। পঞ্চগড় থেকে নীলফামারী সড়কের দুই ধারে চলছে ধান মাড়াই থেকে ধান-খড় শুকানোর কাজ। এতে সড়কে দুই ধার সংকুচিত হয়ে গেছে। গাড়িটা যে একটু দ্রুত গতিতে নিয়ে যাব তার কোনো উপায় নেই।
“পুরো সড়কে ৩০ কিলোমিটার গতির উপরে গাড়ি টানাই মুশকিল। সড়ক দখল করে ধান-খড় যারা শুকাচ্ছে তারা কোনোদিকে নজর রাখছে না। যে যার মত চলাচল করছে, আসার পথে চারবার দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গেছি।”
নীলফামারী সদরের রামনগর গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ারুল ইসলাম (৩২) বলেন, “সড়কে ধান-খড় শুকানোর কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটছে।
“গত ৬ মে নীলফামারী-জলঢাকা সড়কের সিংদই বটতলী নামক স্থানে সড়কে শুকাতে দেওয়া খড়ে মোটরসাইকেল স্লিপ করে পড়ে গিয়ে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যান দুহুলী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা আমার নানি সুফিয়া বেগম। এ সময় আহত হন মোটরসাইকেল চালক মাদ্রাসা শিক্ষক আমার নানা আব্দুল হাই।”
তিনি বলেন, “সড়কে যাতে কেউ ধান, খড় শুকাতে না পারে এজন্য দ্রুত প্রশাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। তা না হলে আরও দুর্ঘটনা বাড়বে সড়কে।”
পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় কৃষকরা সড়কের মধ্যে ধান ও খড়সহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য শুকানোর কাজ করেন বলে মনে করেন পুলিশ সুপার মো. গোলাম সবুর।
“তবে এর ফলে যেন মানুষের চলাচলের বিঘ্ন না ঘটে বা ঝুঁকি তৈরি না হয় সে বিষয়টি আমরা তদারকি করছি।”
এদিকে, সড়কে ধান-খড় শুকানোর কারণে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে এবং ছোট-খাটো দুর্ঘটনা ঘটার কথা স্বীকার করেন জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ।
তিনি বলেন, “কৃষি বিভাগকে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে কৃষকদের সচেতন করতে অনুরোধ করা হচ্ছে যেন সড়কে ধান-খড় বা এসব কৃষিপণ্য শুকাতে না দেয়।”
তবে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এস এম আবু বকর সাইফুল ইসলাম বলেন, “সড়কে ধান ও খড় শুকানোর কারণে প্রায়েই দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটছে। বিষয়টি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় বড় বড় কৃষক বা সামর্থ্যবান কৃষকরাও এলাকাভিত্তিক খলান বা চাতাল তৈরি করতে পারেন। তাহলে আর ঝুঁকি নিয়ে সড়কে কৃষিপণ্য শুকাতে হবে না।”