সম্প্রীতির জনপদে প্রতিমার গায়ে ক্ষত

সবারই ধারণা, ‘দীর্ঘ পরিকল্পনা’ নিয়ে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই’ এই ঘটনা ঘটিয়েছে সংঘবদ্ধ কোনো চক্র।

মো. শাকিল আহমেদঠাকুরগাঁও প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Feb 2023, 07:04 PM
Updated : 5 Feb 2023, 07:04 PM

যুগ যুগ ধরে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বসবাস করে আসা ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গি উপজেলায় এক রাতে তিনটি ইউনিয়নের কয়েকটি মন্দিরে লাগাতার প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে।

এভাবে রাতের আঁধারে মন্দিরের পর মন্দিরে ভাঙচুর চালানোয় পুলিশ, প্রশাসন, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, গ্রামবাসী সবাই ‘হতভম্ব ও মর্মাহত’; কারা, কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কেউ কিছু বলছেন না।

তবে সবারই ধারণা, ‘দীর্ঘ পরিকল্পনা’ নিয়ে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই’ এ ঘটনা ঘটিয়েছে সংঘবদ্ধ কোনো চক্র। এর সুষ্ঠু তদন্ত ও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করেছেন তারা। 

শনিবার রাত থেকে রোববার ভোর রাত পর্যন্ত সময়ে উপজেলার ধনতলা, চাড়োল ও পাড়িয়া ইউনিয়নে বিভিন্ন গ্রামে ওই হামলা হয়।

এর মধ্যে ধনতলা ইউনিয়নে নয়টি, চাড়োল ইউনিয়নে একটি এবং পাড়িয়া ইউনিয়নে চারটি মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে।

ধনতলা ইউনিয়নের সিন্দুরপিণ্ডি থেকে টাকাহারা পর্যন্ত একটি হরিবাসর মন্দির, একটি কৃষ্ণ ঠাকুর মন্দির, পাঁচটি মনসা মন্দির, একটি লক্ষ্মী মন্দির ও একটি কালী মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে।

এছাড়া চাড়োল ইউনিয়নে একটি কালীমন্দির, পাড়িয়া ইউনিয়নে একটি বুড়া-বুড়ি মন্দির, একটি লক্ষ্মী মন্দির, একটি আমাতি মন্দির এবং একটি মাসানমাঠ মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে। 

প্রতিমাগুলোর হাত-পা, মাথা ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলেছে হামলাকারীরা। আবার কিছু প্রতিমা ভেঙে পুকুরের পানিতে ফেলে রেখেছে তারা।

বুধবার ভোর রাত থেকে যখন একের পর এক প্রতিমা ভাঙচুরের খবর আসতে থাকে, তখন নারী-পুরুষ ছুটে আসেন বাড়ির পাশের মন্দিরের কাছে। মন্দিরে এসে জানতে পারেন, পাশের মন্দিরেও প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে। তাদের চোখে-মুখে ছিল ভয় ও আতঙ্কের চিহ্ন; অনেকের চোখে জল।

সিন্দুরপিণ্ডি, টাকাহারা, কামারপাড়া, জাওনিয়া, গোয়ালগাড়ি গ্রামগুলো হিন্দু অধ্যুষিত এবং পাশাপাশি। মাঝে মাঝে মুসলমান পরিবারের বাস। এসব গ্রামের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত; যাদের পেশা কৃষিকাজ। এলাকাটি ভারতীয় সীমান্তবর্তী। এখান থেকে সীমান্ত দুই কিলোমিটারের মত।

ধনতলা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জীতেন্দ্র নাথ বণিক তার বাড়ির কাছের একটি মন্দিরে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “এখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন অনেক বেশি। মুসলমান মানুষের সংখ্যা কম। ১৪ হাজার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে বসবাস করে। মুসলমানের সংখ্যা চার হাজার।

“তবে কেউ কোনোদিন এখানে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বড় ধরনের কোনো ধর্মীয় বিভেদ দেখেননি। বরং একে অপরের উৎসবে অংশ নিয়ে থাকেন; আনন্দ করেন।”

‘হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ’ থেকে কেউ এটা করেছে- এমনটা মনে করেন না জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখানে সবাই মিলেমিশে আছে। দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্ক নিয়ে এটা হয়েছে এমনটা আমার কাছে মনে হয় না। তবে যারা এই কাজটা করেছে তারা এখানকার সুন্দর একটা পরিবেশকে ভণ্ডুল করার জন্যই করেছে বলে প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে।”

জেলা পুলিশের এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা সুনির্দিষ্টভাবে এখনও কোনো কিছু পাচ্ছি না। এ নিয়ে তদন্ত হচ্ছে, কাজ চলছে। আমরা আশা করি, এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের হয়তো অচিরেই আইনের আওতায় আমরা আনতে পারব।”

ধনতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সমর কুমার চ্যাটার্জি বলেন, “আমরা জীবনে কোনোদিন এখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে শুনিনি, দেখিনি।”

কে হামলা করতে পারে- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটা আমার আন্দাজের বাইরে। আমি ধারণা করতে পারি না। তবে আমি চাই, এ ধরনের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হোক।”

কাশীনাথ সিংহ স্থানীয় সিন্দুরপিণ্ডির একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। হরিবাসর মন্দিরের পাশেই তার বাড়ি। মন্দিরের প্রতিমা ভাঙার খবর পেয়ে তিনি ছুটে আসেন। প্রায় সারাদিন সেখানেই ছিলেন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এখানে ৫০ বছর ধরে পূজা হচ্ছে। কেউ তাহলে চাচ্ছে না এখানে পূজা হোক। মনে হয়, কেউ চাচ্ছে না। তাই এখানে কোনো ঘটনা ঘটাতে চাইছে।”

এর আগে কেউ বাধা দিয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “কেউ বাধা দেয়নি। এখানে অনেক লোক হয় পূজায়। কেউ হয়তো দমাতে চায়।”

এ ঘটনায় রোববার বিকালে উপজেলার ধনতলা ইউনিয়নের সিন্দুরপিণ্ডির হরিবাসর মন্দির কমিটির সভাপতি যতীন্দ্রনাথ সিংহ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি মামলা করেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, রাতের আঁধারে অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীরা হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাঙচুর করেছে।

বালিয়াডাঙ্গি থানার ওসি খায়রুল আনাম বলেন, “এখানে যে মামলা হয়েছে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে। মামলাতে সেটাই বলা হয়েছে। আমি এই মুহূর্তে এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।”

তদন্ত কর পুলিশ কী জানতে পেরেছে- এ প্রশ্নের উত্তরে ওসি বলেন, “ঘটনাটি জেলা পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসক মহোদয় তদন্ত করছেন। তারা হয়তো এ ব্যাপারে বলতে পারবেন। আমার কোনো মতামত নেই।”

ঠাকুরগাঁও-২ আসনটি ১৯৯৬ সাল থেকেই টানা আওয়ামী লীগের দখলে। এখান থেকে টানা পাঁচবার দবিরুল ইসলাম জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। জামায়াতে ইসলামীরও শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে এখানে। ২০০১ সালে ও ২০০৮ সালে জামায়াত দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল।  

স্থানীয় সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম বলেন, “বালিয়াডাঙ্গির এই তিনটি এলাকা একেবারে ভারতঘেঁষা। এই কারণে আমার সবসময় মনে হত, এখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ সুরক্ষিত, নিরাপদ। কিন্তু এমন একটা ঘটনায় আমি নিজেও খুব মর্মাহত, হতভম্ব।

“আমার মনে হয়, কোনো একটা বিশেষ গোষ্ঠী হয়তো নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে।”

সংসদ সদস্য বলেন, “তবে যারাই এটা ঘটিয়ে থাকুক না কেন- আমি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেছি, তারা যেন দ্রুত এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়। এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনে।”

বালিয়াডাঙ্গি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, “এর আগে একসঙ্গে ৬৩ জেলায় একসঙ্গে বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। সেটা আমরা দেখেছি। এখানে একসঙ্গে সবগুলো মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটনা ঘটেছে। সেই গোষ্ঠীটির মত কেউ এটা ঘটাতে পারে।”

“সামনে বিএনপির ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা আছে। তার আগে এই ঘটনা ঘটল। তারাও মাঠ গরম করতে চাইতে পারে। এ ছাড়া সামনে জাতীয় নির্বাচন। এটাও একটা কারণ হতে পারে যে, হিন্দুদের বার্তা দেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তারা নিরাপদ নয়।”     

ঘটনার পর পরই আওয়ামী লীগের নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জানিয়ে মোহাম্মদ আলী বলেন, “আমরা তাদের পাশে থাকার সহস দিয়েছি। আমরা সবসময় তাদের পাশে থাকি। এখানে কোনো ভেদাভেদ আমরা করি না।”

বালিয়াডাঙ্গি উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ আলম বলেন, “এখানে সবাই অসাম্প্রদায়িকভাবে থাকে। এখানে একটা সম্প্রীতির পরিবেশ আছে। এখানে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তারপরও এই ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছে, সেটা খুবই ন্যক্কারজনক। বিএনপি কখনও এই ধরনের ঘটনা সমর্থন করে না।”

উপজেলা বিএনপির সভাপতি এ ধরনের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন। এ সময় তিনি আওয়ামী লীগের উপজেলা সভাপতির বক্তব্যেরও প্রতিবাদ জানান।