গাড়িতে শিক্ষক দম্পতির লাশ: কিডনি-ফুসফুসে ‘জমাট রক্ত’

চিকিৎসকের মতে, খাবারে বিষক্রিয়া কিংবা অন্য কোনো কারণে কিডনি ও ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে।

গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 August 2022, 06:44 PM
Updated : 18 August 2022, 06:44 PM

গাজীপুরে প্রাইভেটকারে মৃত অবস্থায় পাওয়া শিক্ষক দম্পতির ফুসফুস ও কিডনিতে জমাট রক্ত পাওয়া গেছে বলে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জানিয়েছেন।

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান মো. শাফি মোহাইমেন জানান, তাদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হতে নমুনার রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য ঢাকায় সিআইডি ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।

টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক একেএম জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী মোসাম্মৎ মাহমুদা আক্তার জলির লাশ গাজীপুর মহানগরের গাছার দক্ষিণ খাইলকুরের বগারটেক এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা তাদের প্রাইভেটকারের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় বৃহস্পতিবার ভোর রাতে।

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান মো. শাফি মোহাইমেন জানান, বৃহস্পতিবার বিকালে লাশ দুইটির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। দুই জনের ফুসফুস ও কিডনিতে প্রায় একই রকম লক্ষণ পাওয়া গেছে। তাদের প্রত্যেকের ফুসফুস ও কিডনিতে জমাট রক্ত পাওয়া।

“এটা সাধারণত খাবারে বিষক্রিয়া কিংবা অন্য কোনো কারণেও হতে পারে। তাই তাদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হতে নমুনার রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য ঢাকায় সিআইডি ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।”

নিহত শিক্ষক দম্পত্তির ছেলে মো. মিরাজ সাংবাদিকদের বলেন, গাছা থানার কামারজুরি এলাকার নিজ বাড়ি থেকে বুধবার সকালে একই প্রাইভেটকারে শিক্ষক দম্পতি তাদের স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হন। স্কুল শেষে সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। কিন্তু এরপর থেকে তাদের কোনো খোঁজ খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। স্বজনরা রাতভর খোঁজাখুঁজি করেও সন্ধান পাননি।

ভোর রাতের দিকে গাজীপুর মহানগরের গাছা থানার দক্ষিণ খাইলকুর বগার টেক এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা তাদের গাড়ির ভেতর চালকের আসনে প্রধান শিক্ষক ও পাশের আসনেই স্ত্রীর নিথর দেহ দেখতে পেয়ে এলাকাবাসী পুলিশে খবর দেয়।

তাদের প্রথমে বোর্ডবাজার এলাকার তায়রুন্নেছা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে উত্তরার অপর একটি হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।

পরে তাদের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।

মৃত একেএম জিয়াউর রহমানের ভগ্নিপতি মাওলানা আব্দুর রশিদ বলেন, ইতিপূর্বে তিনি গাজীপুরের কালীগঞ্জের পুনসই হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন জিয়াউর রহমান। সেখান থেকে ২০২০ সালের ১লা সেপ্টেম্বর টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার স্ত্রী মোসাম্মৎ মাহমুদা আক্তার জলিও টঙ্গী বাজার এলাকার আমজাদ আলী সরকার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তারা সপরিবারে থাকতেন গাছা থানার কামারজুরি এলাকার নিজ বাড়িতে।

তিনি বলেন, ব্যক্তিগত গাড়িতে করে তারা দুজনেই স্কুলে যাওয়া আসা করতেন।

সহকর্মী ও সম্পর্কিত মামাতো ভাই গণিতের শিক্ষক মো. কামরুজ্জামান বলেছেন, বুধবার তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে জিয়াউর পরে স্ত্রী জলির স্কুলে যান এবং স্ত্রীকে তুলে বাসার উদ্দেশে রওনা হন। পথে তাকে নামিয়ে দেন।

জিয়ার ছেলে মিরাজ বলেন, বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে পৌনে ৭টার দিকে বাবার মোবাইলে ফোন দেন। কিন্তু বাবার ফোন রিসিভ না হওয়ায় মায়ের ফোনে কল করেন। পরে মা ফোন ধরে বাসায় আসছেন বলে জানান।

“কিন্তু মা কথা বলার সময় ক্লান্তির স্বর ভেসে আসছিল।”

এরপর থেকে ফোনে তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেননি উল্লেখ করে মিরাজ বলেন, পরে তারা গাছা থানা, টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানায় যোগাযোগ করেন। রাতভর তারা বিভিন্ন জায়গায় তাদের খোঁজ করেন।

টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক মো. নুরুজ্জামান রানা বলেন, প্রধান শিক্ষক একেএম জিয়াউর রহমান ও কামরুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। জিয়াউর স্যার গাছা থানার কামারজুরি এলাকায় এবং কামরুজ্জামান টঙ্গীর শিলমুনে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। কামরুজ্জামান একই স্কুলের গণিতের সহকারী শিক্ষক। জিয়াউর স্যারও গণিতের শিক্ষক ছিলেন। কামরুজ্জামান হেডস্যারকে মামাতো ভাই বলে সম্বোধন করতেন।

“স্কুলের সকল শিক্ষকের সঙ্গেই জিয়া স্যারের ভালো সম্পর্ক ছিল। কারো সঙ্গে কখনও বিরোধ ও খারাপ সম্পর্কের কথা শুনিনি।”

মৃত জিয়াউরের বড় ভাই মো. রিপন সাংবাদিকদের বলেন, “এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তাদের সঙ্গে থাকা স্বর্ণালংকার, নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন কিছুই খোয়া যায়নি। ঘটনাটি যদি পরিকল্পিত না-ই হতো তাহলে টাকা, স্বর্ণ, মোবাইল ও গাড়ি নিয়ে যেত। তার কিছুই তারা নেয়নি।”

গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ) মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ বলেন, ঘটনাটি তদন্তে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে। কী কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়।

মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (মিডিয়া) আবু সায়েম নয়ন বলেন, তাদের লাশে সুরত হাল প্রতিবেদন করা হয়েছে। তবে তাদের লাশে মৃত্যুর কোনো আলামত বাহ্যত পাওয়া যায়নি। পাশে একটি খালি বাটি পাওয়া গেছে। তবে তাতে কী ছিল তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। ময়নাতদন্তের পর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।

গাছা থানার ওসি নন্দলাল চৌধুরী জানান, লাশ উদ্ধার সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়মনতদন্তের জন্য গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছাড়া কিছু বলা ঠিক হবে না।

আরও পড়ুন:

গাজীপুরে প্রাইভেটকারে শিক্ষক দম্পতির লাশ: স্বজনরা বলছে, হত্যা