সন্তান আর স্নেহের তিন দেবরকে হারানোর বেদনা নিয়ে বেঁচে আছেন গোপালগঞ্জের এই ‘শহীদ জননী’। বয়স ৮৫ পেরিয়ে গেলেও স্মৃতিতে সেই দিনগুলো এখনও গুমরে কাঁদে।
সম্প্রতি গোপালগঞ্জ শহর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে পৌরসভার ঘোষেরচর দক্ষিণপাড়ার বাসায় গিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম শুনেছে সেই মায়ের ছেলে-হারানো, স্বজন-হারানোর যুদ্ধদিনের স্মৃতিমালা।
রুস্তম আলী শেখ ও রোকেয়া বেগমের বড় ছেলে মণি মিয়া শেখ। ১৯৭১ সালে মণি মিয়া গোপালগঞ্জ এস এম মডেল হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। আওয়ামী পরিবার হিসেবে শহরে পরিচিতি ছিল তাদের।
মণি মিয়ার চাচা আব্দুল লতিফ শেখ ছিলেন গোপালগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সংগ্রাম পরিষদের সদস্য। যুদ্ধ শুরুর পর মণি মিয়া রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদারদের নানা খবরাখবর মুক্তিযোদ্ধাদের দিতেন। তিনি ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী। আর এই পরিবারে অন্য ছেলেসন্তান না থাকায় তিনি ছিলেন সবার আদরের।
“আমার ছেলে মণিও বাপ-চাচার মতো রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গেল। যুদ্ধ শুরু হলে আমার ছেলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার ও ওষুধ সংগ্রহ করা ইত্যাদি কাজে লেগে যায়। তার চাচা আব্দুল লতিফ শেখ যখন যুদ্ধের জন্য বাড়ি ছেড়ে যায় তখন মণিকে দেখে রাখতে বলেছিল।
শহীদ জননী বলেন, “জুন মাসের মাঝামাঝি সকালের দিকে বাড়ির পাশ থেকে মণি মিয়াকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে তুলে দেয়। আমরা তাকে ছাড়ানোর জন্য দৌড়াদৌড়ি করছি।
“মণি মিয়ার চাচা আব্দুল হাই শেখ ওরফে কুটি মিয়ার শহরের চৌরঙ্গীতে ওষুধের দোকান ছিল। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে ওষুধ দিতেন। তাকে গিয়ে রাজাকাররা বলল, আপনি যদি ক্যাম্পে গিয়ে বলেন, তাহলে হয়তো আপনার ভাতিজাকে পাকিস্তানি সেনারা ছেড়ে দেবে। কুটি মিয়া তখন ভাতিজাকে ছাড়াতে ক্যাম্পে যান। কিন্তু দুজনের কেউ আর ফিরে আসেনি।”
রোকেয়া বেগম বলেন, “ছেলে ও দেবরের শোকে আমি আর মানসিকভাবে ঠিক থাকতে পারিনি। প্রায় ২০ দিন সংজ্ঞাহীন ছিলাম। আসলে আমি তখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। আমাকে তখন আমার বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
“এর মধ্যে আরেকটা ঘটনা ঘটে, আমার আরেক দেবর আব্দুল আসাদ শেখ শহরে মুদি ব্যবসা করতেন। তিনিও দোকান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিনা পয়সায় সামগ্রী দিয়ে সহায়তা করতেন। আগস্ট মাসের দিকে আসাদ শেখকেও রাজাকাররা ধরে নিয়ে যায়। তারপর তারও আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।”
এইটুকু বলার পর শহীদ জননী আর অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি। শুষ্ক গলায় কাঁপা কণ্ঠে বললেন, “চারটা লাশ, একটাও ফিরে পাইনি। আমার ছেলেকে দাফন করতে পারিনি। এর চেয়ে কষ্ট আর নেই। কত কষ্ট… সারাটা জীবন।”
“ছয় মাস পর আমি যখন ঘোষেরচর গ্রামে ফিরে আসি; এ বাড়ি তখন শুধুই বিরাণভূমি। আমি বাড়ির উঠানে গড়াগড়ি করে কেঁদেছি। আজও আমার আত্মা শান্ত হয়নি।”
রাজাকাররা বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল। ধান, চাল, পাট যা কিছু ছিল সব লুট করে নিয়ে গেছে। শহরের ওষুধ আর মুদি দোকান লুট হয়েছে। পরিবারের এই অবস্থার মধ্যেই রোকেয়ার স্বামী রুস্তম আলী শেখ ও তার আরেক ভাই আব্দুল জলিল শেখ মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করেছেন। তাদের কেউ নিবৃত্ত করতে পারেনি।
রোকেয়া বেগম বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের পর আমার তিনটি ছেলে হয়েছে। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে বড় ছেলের শোক ভুলে থাকার চেষ্টা করি। আমার এক মেয়ে আর সাত ছেলে। মণি শেখ ছিল সবার বড়।
“আমি এখন বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত। ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারি না। এখন জীবন সায়াহ্নে এসে পৌঁছেছি। জীবিত থাকতেই সরকার আমাদের পরিবারকে স্বীকৃতি দিক, সঠিক মূল্যায়ন করলেই আমি খুশি হব,” যোগ করেন শহীদের মা।
শহীদ মণি মিয়ার শেখের ভাই এস এম মাহফুজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে আমরা ভাই ও তিন চাচাকে হারিয়েছি। আমাদের পরিবার চরম অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছে। কিন্তু গণমাধ্যমে সেভাবে আমাদের পরিবারের কাহিনি আসেনি। আমরা প্রচারবিমুখ বিধায় এটি হয়েছে।
গোপালগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কামান্ডার বদরুদ্দোজা বদর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে এই পরিবারটি অসীম সাহসের সঙ্গে লড়েছে, আত্মত্যাগ করেছে। এই পরিবার থেকে চারজন শহীদ হয়েছেন। হারিয়েছে সহায়-সম্পদ। তাদেরকে সঠিক মূল্যায়নের দাবি অমূলক নয়, যথার্থ।”