স্বাধীনতার অর্ধশতকেও অবহেলায় কিশোরগঞ্জের বধ্যভূমিগুলো

মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশত বছরেও কিশোরগঞ্জ জেলার সব বধ্যভূমি সংরক্ষণ কাজ সম্পন্ন হয়নি। বধ্যভূমিতে শহীদদের নামের তালিকা স্থাপন এবং তা সংরক্ষণের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি।

মারুফ আহমেদ কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 March 2022, 03:19 AM
Updated : 17 March 2022, 08:02 AM

কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, জেলায় মোট ২৭টি বধ্যভূমি রয়েছে। তার মধ্যে কিশোরগঞ্জ সদরের বড়ইতলা ও ভৈরবের পানা উল্লাহর চর – এ দুটি মাত্র বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি বধ্যভূমিতে ফলক স্থাপন করা হয়। বাকিগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণে এখনও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

জেলার বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা এই অবহেলায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে বধ্যভূমি সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। 

সদর উপজেলার কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের বড়ইতলা গ্রামে অবস্থিত জেলার বৃহত্তম বধ্যভূমি।

১৯৭১ সনের ১৩ অক্টোবর বড়ইতলা গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা চালায়। এখানে একই সঙ্গে হত্যা করে ৩৬৫ জন নিরীহ মানুষকে। ওইদিন আহত হয় আরও দেড় শতাধিক।

এই শহীদদের নামের পূর্ণাঙ্গ তালিকা স্থাপন, তা সংরক্ষণ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থান সরকারিভাবে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন।

জয়নাল আবেদীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই বধ্যভূমিতে আমার পরিবারের পাঁচজন শহীদ হয়েছিলেন। কিন্তু বধ্যভূমিতে শহীদদের তালিকা সঠিকভাবে প্রণয়ন না হওয়া এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থান সরকারিভাবে সংরক্ষণের কার্যক্রম শুরু না করা খুবই কষ্টদায়ক।”

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জেলার কটিয়াদী উপজেলার সহস্রাম ধুলদিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত ধুলদিয়া বধ্যভূমিতে শত শত নিরীহ মানুষকে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। কিশোরগঞ্জ-ভৈরব রেলপথে সিঙ্গুয়া নদীর উপর রেল সেতুর কাছে এই বধ্যভূমিতে প্রায় প্রতিদিনই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নিরীহ মানুষকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করা হতো।

ধুলদিয়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী মহিদুল ইসলাম বলেন, “এই বধ্যভূমিতে শহীদদের নামের তালিকা প্রণয়ন, সংরক্ষণ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থান সরকারিভাবে সংরক্ষণ কার্যক্রম শুরু না করা খুব দুঃখজনক। এটা মুক্তিযোদ্ধা ও মহান শহীদদের প্রতি অবমাননা। অবিলম্বে প্রত্যেকটা বধ্যভূমিতে শহীদদের তালিকা প্রণয়ন করে তা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।”

গাজী মহিদুল ইসলাম আরও জানান, জেলা শহরের সিদ্বেশ্বরী বাড়ি এলাকায় বধ্যভূমিতে শত শত নিরীহ মানুষকে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। দিনের বেলায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের খুঁজে খুঁজে ধরে এনে রেল স্টেশন সংলগ্ন ডাক বাংলোতে আটকে রাখা হতো এবং রাতে সিদ্বেশ্বরী বাড়ি এলাকায় নরসুন্দা নদীর পাড়ে গুলি করে হত্যা করত। শহীদদের লাশ নদীতে ভেসে যেত। এসব লাশ মাছে ঠুকরে ঠুকরে খেত।

“এই বধ্যভূমিতেও শহীদদের নামের তালিকা প্রণয়ন, সংরক্ষণ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থান সরকারিভাবে সংরক্ষণ কার্যক্রম শুরু করা হয়নি। এটি খুব দুঃখজনক।”

আরেকটি বধ্যভূমি হলো হোসেনপুর উপজেলা সদরের হোসেনপুর কুড়িঘাট। এখানে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়। কিন্তু এই বধ্যভূমি সংরক্ষণে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণের কাজ দশ বছর আগে শুরু হলেও তা শেষ হয়নি। অর্ধ সমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে বছরের পর বছর ধরে। এ নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষের মনে।

হোসেনপুর কুড়িঘাট গণহত্যায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট ভাইসহ অন্যান্য স্বজন হারানো সাবেক শিক্ষক সন্তোষ মোদক এখনও বেঁচে আছেন।

তিনি বলেন, “দীর্ঘ দিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অনেক বিলম্বে এখানে স্মৃতি সৌধ নির্মাণের কাজ শুরু হলেও দশ বছরেও তা শেষ হয়নি। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।” 

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সহকারী কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান বলেন, কিশোরগঞ্জের বধ্যভূমিগুলি সংরক্ষণ, সেইসাথে বধ্যভূমিতে শহীদদের নামের তালিকা প্রণয়ন এবং তা সংরক্ষণসহ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থান সরকারিভাবে সংরক্ষণের জন্য আমরা জেলা প্রশাসনকে বারবার দাবি জানালেও তা বাস্তবায়নে আশানুরুপ অগ্রগতি হচ্ছে না।”

নির্মাণাধীন কুড়িঘাট বধ্যভূমি

সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ভুপাল নন্দী বলেন, “মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক বাহিনীর দোসর হিসেবে কিশোরগঞ্জের গণহত্যায় যেসব স্থানীয় বাসিন্দা জড়িত ছিলেন তারা এখনও বেঁচে আছে এবং প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে; তাদেরকে গণহত্যার অপরাধে বিচারের আওতায় আনার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।”

কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, “বধ্যভূমিগুলি সংরক্ষণ, সেই সাথে বধ্যভূমিতে শহীদদের নামের তালিকা প্রণয়ন এবং তা সংরক্ষণসহ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থান সরকারিভাবে সংরক্ষণের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে।”