মগড়া নদীর পাড়ের এ গ্রামটির মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে বেজখালী খাল, পাশেই রয়েছে বিশাল দুটি বিল- ওয়াইল ও আইলি। গ্রামটিতে রয়েছে ২০২টি পুকুর। প্রশিক্ষণ আর সরকারি সহায়তায় আট মাসের মধ্যে গ্রামের চাষিরা মাছের উৎপাদন তিন গুণ বাড়িয়েছেন; যাকে অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত বলছে মৎস্য অধিদপ্তর।
নেত্রকোণা সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দেবাশীষ ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১ দশমিক ৬২ বর্গকিলোমিটারের দক্ষিণ বিশিউড়া গ্রামটিতে দুই হাজার ২৫৩ জন বসবাস করেন। গ্রামটিতে ৫৪ দশমিক ৬ হেক্টর জলাভূমি রয়েছে।
দেবাশীষ ঘোষ বলেন, “২০২১ সালের জুনে মুজিব বর্ষ উপলক্ষে সরকার সারা দেশের দুটি গ্রামকে মৎস্য গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করেছে। একটি নেত্রকোণায় আরেকটি শরীয়তপুরে।
দক্ষিণ বিশিউড়া গ্রামে মৎস্যচাষী, মৎস্যজীবী ও বাসিন্দাদের নিয়ে ধারাবাহিকভাবে মতবিনিময় সভা, উঠোন বৈঠক করেছে মৎস্য অধিদপ্তর। নিরাপদ মাছ চাষের পাশাপাশি দেশীয় মাছের প্রতি আলাদা নজর দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে শিং, মাগুর, টেংরা, গুলসা, পাবদা, কার্প, তেলাপিয়া, পাঙ্গাস চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
১৩০ জন চাষি ও ৪০ জন মৎস্যজীবীকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা উল্লেখ করে মৎস্য কর্মকর্তা দেবাশীষ বলেন, প্রথমেই প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে ২৫ হাজার মাছের পোনা বিতরণ করা হয়। দেওয়া হয় দুই হাজার কেজি দানাদার খাবার, ১২০ কেজি চুন, ১৫০ কেজি সার ও ২৫০ কেজি খৈল। খামার যান্ত্রিকীকরণের আওতায় চারটি এরেটর দেওয়া হয়। এরেটর পুকুরের অক্সিজেনের ঘাটতিপূরণ, একই পুকুরে অধিক মাছ চাষ ও মাছের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। আইলি বিলে সাড়ে তিন হাজার কুচিয়া মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়।
জেলা সদর থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরের দক্ষিণ বিশিউড়া গ্রামটিতে মার্চের প্রথম সপ্তাহে এক সকালে গিয়ে মৎস্যজীবীদের কর্মতৎপরতা চোখে পড়ে। সকালেই কেউ জাল নিয়ে বেরিয়েছেন, কেউবা মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছেন মাছের খাবার, পুকুর থেকে তোলা হচ্ছে মাছ, পাড়ে পাড়ে মানুষের ভিড়। হাঁকডাকে মুখরিত চারপাশ। গ্রামের কাঁচা-পাকা রাস্তা ধরে ড্রামের পর ড্রাম ভরে মাছ যাচ্ছে আড়তের দিকে।
দক্ষিণ বিশিউড়া গ্রামেরই বাসিন্দা আতাউর রহমান। তার ৫০ শতকের দুটি পুকুর রয়েছে।
লেখাপড়া শেষ করে চাকরির পেছনে ছুটেননি গ্রামের যুবক সাব্বির আহমেদ। পারিবারিকভাবে আগে থেকেই কয়েকটি পুকুর ছিল। তিনি নিজে এসে সেগুলো আরও বাড়িয়েছেন।
সাব্বির বলছিলেন, “আগে সব পুকুরে মাছ করতাম না। এখন সবগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছি। এতে অনেক লাভ হচ্ছে। অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।
বেজখালি খাল খনন করায় মুক্ত জলাশয়ের মাছ বেড়েছে, ফসলি জমিতে সেচ দেওয়াসহ জীব-বৈচিত্র্য রক্ষা পাচ্ছে বলে গ্রামটির বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন জানান।
তিনি বলেন, “খালডা খোদায়া দেয়নে জমিতে সেচ সুবিধা বাড়ছে। খালে আগে মাছ পাইতাম না। অহন মাছ পাইতাছি। খালের মধ্যে অনেক জীব থাকে। এইগুলাও অহন বাঁচতাছে।”
এত মাছ উৎপাদন হলেও গ্রামটিতে কোনো আড়ৎ নেই। তাই মাছ বিক্রি করতে গ্রামের মানুষদের আশপাশের আড়তে যেতে হয়। চাষিদের দাবি, সেখানে একটি স্থায়ী আড়ৎ তৈরি করে দেওয়া হোক।
গ্রামের মৎস্যচাষি হায়দার আলী টিপু বলছিলেন, তার দেড় একরের তিনটি পুকুর আছে। একটা পুকুরেই মাগুর, পাবদা আর দেশি মাছ চাষ করে এবার দুই লাখ টাকা লাভ পেয়েছেন।
দক্ষিণ বিশিউড়া গ্রামের মডেলটিকে সারা জেলায় ছড়িয়ে দিতে চান বলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহাজান কবীর জানান।
মাছ-সবজি-গবাদিপশু পালনের পাশাপাশি গ্রামটিকে আদর্শ গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মৎস্য অধিদপ্তর কাজ করছে।
গ্রামে চাষিদের আড়তের দাবির ব্যাপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, “দক্ষিণ বিশিউড়া গ্রামের বাজারে মাছের আড়ৎ করার চেষ্টা করতেছি। দ্রুতই তা করা সম্ভব হবে।”