রূপগঞ্জ অগ্নিকাণ্ডে পোড়া লাশের ভিড়ে খুঁজে পেয়েই ‘স্বস্তি’

মহামারীর কারণে টানা স্কুল বন্ধে পরিবারের বাড়তি আয়ের আশায় দুই মাস আগে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস কারখানায় কাজ নেয় নাজমুল ইসলাম।

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধিমারুফ  আহমেদ, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 July 2021, 07:11 PM
Updated : 10 July 2021, 09:17 PM

তবে বৃহস্পতিবার লাগা ভয়াবহ সেই আগুনে দ্বগ্ধ হয়ে মারা গেছে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার দানাপাটুলি ইউনিয়নের পুর্বকালিয়াকান্দা গ্রামের এক দিনমজুরের দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া এই ছেলে বলছেন তার বাবা।

এ স্কুল ছাত্রের বাবা চাঁন মিয়া জানান, নাজমুলের ইচ্ছা ছিল করোনাকালে কিছু টাকা আয় করতে পারলে তার পরিবার ভালোভাবে খেয়ে-পরে চলতে পারবে এবং কিছু টাকা তার পড়ালেখার কাজেও লাগবে।

তিনি বলেন, “কিন্তু নিয়তি তাকে সে সুযোগ দেয়নি। কারখানার আগুনে সে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে।”

নাজমুলের লাশ এখনও খুঁজে ফিরছেন চাঁন মিয়া।

তবে মিনা আক্তারের লাশ নিয়ে করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের উত্তর কান্দাইল গ্রামে ওই দিনই গভীর রাতে বাড়ি ফেরেন নিহতের স্বামী হারুন মিয়া।

হারুন মিয়া বলেন, “ঘটনা মর্মান্তিক হলেও অন্তত লাশটি বুঝে পেয়েছি কিন্তু মৃতদেহ পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়ায় অনেকের সে সুযোগটিও নেই।”

একই উপজেলার মথুরাপাড়ার নিখোঁজ শ্রমিক পাখিমা আক্তারের দুই শিশু ছেলে দশম শ্রেণির ছাত্রী আছমা এবং ছোট ছেলে জুয়েল তাদের মায়ের জন্য কেঁদেই চলেছে।

তাদের স্বজনরা জানান, চার বছর ধরে ওই কারখানায় কাজ করতেন পাখিমা এবং তার বড় ছেলে মোস্তাকিম। তবে রাতের পালায় ডিউটি থাকায় ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যায় ছেলে মোস্তাকিম।

ঘটনাস্থল এবং হাসপাতালে ছোটাছুটি করেও স্ত্রীর ‘লাশ পাননি’ তার স্বামী আব্দুল কাইয়ুম।

একই গ্রামের খোকন মিয়ার স্ত্রী জাহানারা এবং তাহের উদ্দিনের একমাত্র ছেলে নাঈম পাখিমার সাথে ওইখানে কাজ করতেন।

জাহানারার স্বামী খোকন মিয়া এবং নাঈমের পিতা তাহের উদ্দিন জানান, তাদের ‘দুজনের লাশ অনেক খুঁজেও পাওয়া যায়নি’।

একই চিত্র জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের মথুরাপাড়া, সদরের দানাপাটুলী ইউনিয়নের কালিয়ারকান্দা, যশোদল ইউনিয়নের ব্রাহ্মণকান্দি এবং বৌলাই ইউনিয়নের রঘুনন্দনপুর গ্রামে নিহতের স্বজনদের বাড়িতে।

এ প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্যের কারখানায় অঙ্গার হয়ে যাওয়া লাশগুলোর শোকে-আর্তনাদে গুমট হয়ে উঠেছে এ জেলার চারটি উপজেলার ১৫টি গ্রামের বাতাস।

তবে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম জানান, জেলার কতজন শ্রমিক এ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তার এখনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে জেলার করিমগঞ্জ, সদর, কটিয়াদী ও মিঠামইন উপজেলার অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন।

“যারা নিখোঁজ তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে।”

এদিকে, প্রশাসনিকভাবে নিশ্চিত না হলেও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র কয়েকজনের নাম জানিয়ে দাবি করছেন তারা নিহত হয়েছেন।

এ নিখোঁজরা হলেন, সদর উপজেলার বৌলাই দক্ষিণ রাজকুন্তি গ্রামের আব্দুল কাদিরের মেয়ে আমেনা (৪০), শেওড়া গ্রামের কাইয়ুমের মেয়ে খাদিজা, জালিয়া গ্রামের মাহতাব উদ্দিনের স্ত্রী শাহানা বেগম, কালিয়ারকান্দা গ্রামের চাঁন মিয়ার ছেলে নাজমুল ইসলাম, বড়খালের পাড়ের আজিজুল হকের মেয়ে মোছা. রহিমা আক্তার (৪০), রঘুনন্দনপুরের মালেকের মেয়ে মাহমুদা বেগম, ব্রাহ্মণকান্দি গ্রামের নিজাম উদ্দিনের মেয়ে শাহানা বেগম (১৬), করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের উত্তর কান্দাইল গ্রামের মিনা আক্তার (৩৩), মথুরাপাড়া গ্রামের খোকন মিয়ার স্ত্রী জাহানারা (৩৫), আব্দুল কাইয়ুমের স্ত্রী পাখিমা (৩৪), তাহের উদ্দিনের ছেলে নাঈম (১৮), দক্ষিণ নানশ্রীর মাসুদের ছেলে সোহাগ (১৩), মুলামখারচরের সুজনের মেয়ে ফাতেমা আক্তার, চাতল গ্রামের সুরুজ আলীর মেয়ে ফারজানা আক্তার, সাঁইটুটা গ্রামের মো. স্বপন মিয়ার মেয়ে শায়লা আক্তার, কটিয়াদী উপজেলার সহশ্রাম ধূলদিয়া ইউনিয়নের গৌরিপুর গ্রামের বাচ্চু মিয়ার মেয়ে তাছলিমা বেগম, চান্দু মিয়ার মেয়ে রাবেয়া বেগম এবং মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘী গ্রামের মো. সেলিমের মেয়ে সেলিনা বেগম।

তাদের স্বজনদের অনেকেরই অভিযোগ, কারখানার গেইট তালাবদ্ধ না থাকলে হয়তো তারা বেঁচে যেতেন।

কিশোরগঞ্জ সদরের দানাপাটুলি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এবিএম জালাল উদ্দিন বলেন, কারখানা মালিকের গাফিলতি ও গেইট বন্ধ থাকার কারণে শ্রমিকদের করুণ মৃত্যু হয়েছে।

এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের কঠোর বিচার ও নিহতের পরিবারদেরকে উপযুক্ত ক্ষতিপুরণের জোর দাবি জানান তিনি।

নামজাদা ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত খাবার প্রস্তুতকারক এই কারখানায় এই অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জনের মৃত্যু নিশ্চত করেছে প্রশাসন। তবে লাশগুলো পুড়ে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া তাদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব নয়।

হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে অর্ধ শতাধিকের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা হয়েছে। সেই মামলায় এর মালিক মো. আবুল হাসেম ও তার চার ছেলেসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।