মাদারীপুরে কৃষকদের আপত্তির মুখে খাল ভরাট করে হচ্ছে আশ্রয়ণ প্রকল্প

বিনামূল্যে গৃহহীনদের ঘর দেওয়ার প্রকল্পে মাদারীপুরের এক খাল ভরাট করে বাড়ি নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে।

রিপনচন্দ্র মল্লিক মাদারীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 June 2021, 03:15 PM
Updated : 15 June 2021, 03:23 PM

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম ইউনিয়নের ‘সেনখাল’ নামে পরিচিত খালের প্রায় এক কিলোমিটার ভরাট করে চলছে এই ঘর নির্মাণের কাজ।

অথচ ভূমি ব্যবহারের নীতিমালা অনুযায়ী জলাশয় ভরাট করে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারি বিধিনিষেধ রয়েছে।

খালটি ভরাট করলে বন্যা, জলাবদ্ধতা, ফসলি জমিতে সেচ দানসহ ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা করছেন স্থানীয় কৃষকরা। এসব শঙ্কার কথা জানিয়ে গত ৮ জুন স্থানীয়রা স্মারকলিপি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।

এ স্মারকলিপিতে স্থানীয়রা বলেছেন, ৭২ নম্বর সিরাজকাঁঠি পাবনীয়া মৌজায় আরএস এবং বিআরএস দাগ নম্বর ৬৬৫ এবং ৮২৯ নকশায় অঙ্কিত খালের জমি। এ খাল বিগত দিনগুলোয় জনসাধারণের কৃষি কাজের সেচ, দেশীয় মাছের উৎস, পাট প্রক্রিয়াজাতকরণ, বর্ষার পানি নিষ্কাশন এবং কৃষি পণ্য পরিবহনসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হয়।

খালটির পাশ দিয়ে ৩০০ বিঘা জমির চাষাবাদ খরা মৌসুমে খালের পানির ওপর নির্ভরশীল। খাল ভরাটের ফলে স্থানীয় কৃষি কাজের বিরূপ প্রভাব পড়বে। ফলে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে প্রায় তিন হাজার কৃষক।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় আড়াই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর সেনখালের উভয় পাড় দিয়ে চলাচলের জন্য একটি কাঁচা রাস্তা রয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের নির্ধারিত জায়গায় চলছে মাটি ভরাটের কাজ। এজন্য খালের মধ্যে দেওয়া হয়েছে একাধিক বাঁধ। বর্ষার মৌসুম হলেও খালটির বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দেওয়ায় খালে পানি প্রবাহ নেই। খালের দুপাড়ের কয়েকশ ছোট বড় গাছ কাটা হয়েছে।

এছাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের জন্য ইট-বালু ইতিমধ্যে খালের পাড়ে আনা হয়েছে। খুবই তড়িঘড়ি করে চলছে প্রকল্পের ঘর নির্মাণ কাজ।

স্থানীয় কৃষক শচীন বৈরাগী বলেন, “আমরা গরিব মানুষ। চাষ কইরা যা পাই তাই খাই। খাল ভরাট হয়ে গেলে আমরা না খেয়ে মারা যামু। কারণ আমাগো সেচ দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। আমাগো রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে।”

আরেক কৃষক পরিমল বাড়ৈই জানান, এক সময় এ খাল দিয়ে লঞ্চ, ট্রলার ও নৌকা চলত। দীর্ঘদিন খালটি না কাটায় পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে।

“তারপরও পানি প্রবাহ কম-বেশি ছিল। যেই পানি খালে ছিল তা দিয়েই এলাকার সবাই কৃষি জমিতে সেচ কাজে লাগাত। এখন আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ কাজ করায় খালের পানি প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।”

তার প্রশ্ন কৃষকরা এখন পানি কোথায় পাবে?

ওই এলাকায় তিন একর জমিতে প্রতি বছর চাষ করেন শরৎ মন্ডল। প্রতি বছর ধান, পাট, গম চাষ করেন তিনি।

তিনি বলেন, “চাষাবাস করে সুখেই ছিলাম কিন্তু সেই সুখ আর নাই আমাগো। খালের পানি প্রবাহ বন্ধ হইয়া গেছে।ভালো ফসল এখন কীভাবে ফলাব?”

স্থানীয়রা জানান, আমগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম পাড়ায় প্রায় ৮ হাজার মানুষের বাস। যাদের বেশিরভাগই কৃষি কাজে যুক্ত। এ এলাকার মানুষের কৃষি হচ্ছে প্রধান জীবিকা। শত বছরের পুরানো এ খালের পানি জমির সেচ কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

এদিকে, উপজেলা প্রশাসন থেকে জানা যায়, গৃহহীন পরিবারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ অধীনে রাজৈর উপজেলায় চারটি স্থানে ১২০টি ঘর নির্মাণের কাজ চলছে। তার একটি হচ্ছে আমগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম পাড়া এলাকায়। এখানে সেনখালের দুই একর ৫ শতাংশ জমি ভরাট করে ৩৫টি ঘর নির্মাণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ঘরের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৯০ হাজার টাকা।

স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে খালটি গত বুধবার পরিদর্শনে আসেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।

এ কমিশনের ফিল্ড অফিসার শাহ ছলিমুল্লাহ লাবলু বলেন, “আমরা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। এখানে আমরা নাকশা ও ম্যাপে খাল দেখতে পেয়েছি।

“কর্তৃপক্ষকে আমরা জানিয়েছি, খাল ভরাট করে কোনো কাজ করা যাবে না। আমরা চাই, খাল রক্ষা করেই কাজ করা হোক।”

তবে রাজৈর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মাহবুব হোসেন বলেন, “খাল না খাস জমি এ বিষয় আমরা নয়, ভূমি অফিস জমি নির্ধারণ করে। তারা আমাদের খালের স্থানে নাল জমি উল্লেখ করেছিলেন। আমরা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করতে শুধু মাটি ভরাটের কাজ করেছি।”

তিনি আরও বলেন, “খালটি কিছু অংশ ভরাট করার পরে স্থানীয়রা আমাদের কাছে অভিযোগ করেছেন। তাই ওটা এখন ইউএনওসহ অনেকেই দেখছেন।”

তবে খাল ভরাট করে প্রকল্পের কাজ করছেন বলে দাবি করলেন রাজৈর ইউএনও মো. আনিসুজ্জামান।

তিনি বলেন, “সেনখালটি এখন মৃত প্রায়। বহু আগে এখানে পানি প্রবাহ থাকতে পারে বা ছিল। এটি বর্তমানে রেকর্ডে খাল নয়, নালা বা নিচু শ্রেণির জায়গা। আরএস নকশায় এটি খাল থাকতে পারে।”

স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ পাওয়া কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, তাদের যেন ক্ষতি না হয় সেই বিষয়টিও আমরা দেখব।

এ বিষয়ে মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, খাল ভরাট করে কোনো স্থাপনা বা প্রকল্প নেওয়া যাবে না। আমি খাল ভরাট করার বিষয়ে একটি অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।