বদলগাছীতে মুক্তিযোদ্ধা যাচাইয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগ

নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বাছাই কমিটির দুজন সদস্যের বিরুদ্ধে।

সাদেকুল ইসলাম নওগাঁ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 April 2021, 05:23 AM
Updated : 15 April 2021, 05:23 AM

এই ঘটনায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি নওগাঁ জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন সাবেক সেনা সদস্য ‘বীর মুক্তযোদ্ধা’ আহসানুল কবির, সাবেক সেনা সদস্য ‘বীর মুক্তযোদ্ধা’ কাজী ইশারত আলীসহ ১১ জন।

অভিযোগের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসক স্থানীয় সরকার নওগাঁর উপ-পরিচালককে বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ দেন। তদন্তকারী এই কর্মকর্তা গত ১ মার্চ ঘটনার তদন্ত করেন।

তদন্তে যাচাই-বাছাই কমিটির দুই সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে বলে তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

তবে যাচাই-বাছাই কমিটির এই দুই সদস্য অভিযোগ বিষয়ে কোনো কথা না বলে এড়িয়ে যান। 

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, গত ৬ ও ৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় উপজেলা পরিষদ হলরুমে বদলগাছী উপজেলার ৪৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ১০৮ জনের যাচাই বাছাইয়ের দিন ধার্য করা হয়।

এজন্য বীর মুক্তিযেদ্ধা গোলাম মোস্তফা তোফাকে সভাপতি, বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু তাহিরকে সদস্য সচিব এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ডি এম এনামুল হক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা জবির উদ্দিন মন্ডলকে সদস্য করে চার সদস্য বিশিষ্ট্য জামুকার যাচাই-বাছাই কমিটি করা হয়।

জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগে বলা হয়, জামুকার যাচাই-বাছাই কমিটির অন্যান্য সদস্যের যোগসাজসে ডি এম এনামুল হক প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে এক লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা না দিলে তার নাম বাদ দেওয়া হবে বলে তিনি জানিয়ে দেন।

“অনেকই বাধ্য হয়ে এক লাখ টাকা করে, আর অতি দরিদ্র অসহায় মুক্তিযোদ্ধা বা তার পরিবারের সদস্যরা প্রতিজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য ৫০ হাজার টাকা করে দেন।”

অভিযোগে বলা হয়, টাকা দিতে না চাওয়ায় বদলগাছী উপজেলার ভগবানপুর গ্রামের আতাউর রহমানের ছেলে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ ও সাবেক সেনা সদস্য আহসানুল কবির (গেজেট নং-৩১৭০), ভরট্ট গ্রামের এলাহী বক্সের ছেলে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ ও সাবেক সেনা সদস্য কাজী ইশারত আলী (গেজেট নং৩১৬০), মিঠাপুর গ্রামের প্রয়াত ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ আবদুর রহমানসহ (গেজেট নং-১৫২৩) শহীদ আরও দুই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার’ নাম চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

এই বিষয়ে আহসানুল কবির বলেন, “আমি নওগাঁর বীর মুক্তিযোদ্ধা জালালউদ্দিনের বাহিনীতে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। যাচাইবাছাইয়ের সময় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং সাক্ষীদের নিয়ে এলেও কমিটির সদস্যরা কোনো কিছু না নিয়ে আমার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে অস্বীকার করায় আমাকে চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন বলে শুনছি।”

তিনি এদের ‘সমাজবিরোধী’ ও ‘দুর্নীতিবাজ’ আখ্যায়িত করে কঠোর শাস্তি দাবি করেন।

উপজেলার মিঠাপুর গ্রামের প্রয়াত ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ মকফুর রহমানের মেয়ে মরিয়ম আক্তার মফেলা বলেন, “টাকা না দিলে তালিকা থেকে আমার আব্বার নাম বাদ দেওয়া হবে- এই হুমকির কারণে আমি ভয় পেয়ে সুদের ওপর টাকা নিয়ে যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য এনামুল হককে ৩০ হাজার টাকা ও সাক্ষীর জন্য ১০ হাজার টাকা দিয়েছি। কারণ আব্বার ভাতার টাকায় আমাদের সংসার চলে। বাদ দিলে আমাদের অনাহারে থাকতে হবে।”

মিঠাপুর গ্রামের ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ আব্দুর রহমানের ছেলে স্বপন হোসেন মাস্টার বলেন, “আমাদের মিঠাপুর ইউনিয়নের মতলেবুর রহমানের মাধ্যমে এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য নানা হুমকি চাপ দেন যাচাই বাছাই কমিটির সভাপতি গোলাম মোস্তফা তোফা ও সদস্য ডি এম এনামুল হক।”

হুমকির মুখে ভীত হয়ে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে তার এক ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু বক্কর সিদ্দিকের জন্য ৫০ হাজার, চাচা বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জ্বল হোসেনের জন্য ৫০ হাজার এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মকফুর রহমানের জন্য তার মেয়ের দেওয়া ৩০ হাজার মিলিয়ে মোট এক লাখ ৩০ হাজার টাকা কমিটির সদস্য ডিএম এনামুল হককে তার নিজ বাসার দোকানে দেন বলে জানান।

তিনি বলেন, “এর ভিডিও রেকর্ডও করা আছে। এছাড়া কমিটির সভাপতি গোলাম মোস্তফা তোফাকে আমার বাবাসহ চার মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষীর জন্য ৪০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।”

উপজেলার পার আধাইপুর গ্রামের ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ সাবেক থানা সদস্য কমান্ডার আব্বাস আলী খোকা বলেন, “আমার কাছে যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি গোলাম মোস্তফা তোফা টাকা দাবি করেন। কিন্তু টাকা দেব না জানিয়ে দিয়েছি; শুনছি তালিকা থেকে আমার নাম বাদ দিয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমি টাকার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি; তাই টাকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হতে চাই না। আমি এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ সুষ্ঠুভাবে পুনরায় যাচাই-বাছাইয়ের দাবি করছি।”

উপজেলার ভরট্ট গ্রামের সাবেক সেনা সদস্য ও ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ কাজী ইশারত আলী বলেন, “আমি টাকা দিতে পারলাম না বলে আমার নাম তালিকায় থাকবে না- এটা কেমন কথা? আমি সুষ্ঠু তদন্ত সিাপেক্ষে টাকা নিয়ে তালিকাকারী কমিটির সদস্যদের বিচার চাই।”

মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে অর্থ গ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে বাছাই কমিটির সভাপতি গোলাম মোস্তফা তোফা ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে বলেন, তার সঙ্গে কথা বলতে হলে সাত দিন পর যোগাযোগ করতে হবে।

সদস্য ডিএম এনামুল হকের বদলগাছী উপজেলা সদরের বাসায় গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে ফোনে যোগাযোগ করা হলে অর্থ গ্রহণের বিষয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলতে তিনি রাজি হননি।

তবে এই বিষয়ে তিনি জেলা প্রশাসক সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।

কমিটির আরেক সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা জবির উদ্দিন বলেন, যাচাই-বাছাইয়ে ‘অনিয়ম’ ও ‘অর্থ লেনদেন’ নিয়ে তিনি প্রতিবাদ করেছেন। একারণে কমিটির অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে তার মতবিরোধ হয়।

“আর এই অনিয়ম দুর্নীতির কারণে যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত তালিকায় আমি স্বাক্ষর করিনি।”

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা কমান্ডার হারুন অর রশিদ বলেন, “যাচাই-বাছাইয়ে কিছুটা অনিয়ম হয়েছে। বিষয়টি জানার পর আমি জেলা প্রশাসককে বিষয়টি অবহিত করি। তিনি বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন।”

অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে আশা করে তিনি বলেন, বদলগাছীর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা পুনঃযাচাই বাছাইয়ে তালিকাভুক্ত হতে পারবেন।

অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা স্থানীয় সরকার নওগাঁর উপ-পরিচালক গোলাম মো. শাহনেওয়াজ বলেন, “তদন্তে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তদন্ত প্রতিবেদন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে পাঠানো হয়েছে।”