রেংমিটচা: যে ভাষা বেঁচে আছে শুধু ‘ছয়টি’ প্রাণে

নিজ নিজ স্বকীয়তা ধারণ করেই বাংলাদেশে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করে চলেছে পাহাড়ের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী। তাদের জীবনাচরণ, সামাজিকতায় রয়েছে বৈচিত্র্য; রয়েছে আলাদা ভাষা-সংস্কৃতি। তবে সময়ের পথচলায় কিছু ভাষা হারিয়ে যেতে বসেছে, তেমনই একটি ভাষা ‘রেংমিটচা’। 

উসিথোয়াই মারমা বান্দরবান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Feb 2021, 05:16 AM
Updated : 21 Feb 2021, 05:16 AM

এ ভাষায় এখন কথা বলতে পারেন মাত্র ছয়জন, তাদের অধিকাংশের বয়স ষাটের বেশি। অর্থাৎ, তাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাবে আরেকটি ভাষা।

এ শতকের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাবিজ্ঞানী ডেভিড পিটারসন কুকি-চিন ভাষাগুলোর ওপর গবেষণা করতে বাংলাদেশে আসেন। ২০০৯ সালে তিনি বান্দরবানে এসে জানতে পারেন, আলীকদম উপজেলার কিছু দুর্গম এলাকায় ম্রো জনগোষ্ঠীর এক গোত্র রয়েছে, যাদের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা।

পরে তিনিই রেংমিটচা ভাষাভাষীদের খুঁজে বের করেন। সে কাজে তার সঙ্গে ছিলেন ম্রো ভাষার লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি ও সংস্কৃত বিভাগে লেখপড়া করা ইয়াংঙান ম্রো থাকেন বান্দরবান শহরে। ম্রো ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন তিনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “২০১৩ সালেও কয়েকটি পাড়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ২২ জন রেংমিটচা ভাষাভাষীর লোক পাওয়া গিয়েছিল। আট বছরের ব্যবধানে ২০২১ সালে এসে সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছয় জনে। বাকিরা মারা গেছেন।”

বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার সদর ইউনিয়নে তৈন খাল। এই খাল পার হয়ে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছাতে হয় ক্রাংসি পাড়ায়, যেখানে রয়েছেন রেংমিটচাভাষী কয়েকজন।

এখনও যে ছয়জন জীবিত আছেন, তারা সবাই এক পাড়ায় থাকে না। দুই উপজেলার চারটি পাড়ায় ছড়িয়ে রয়েছেন তারা।

“আগে রেংমিটচা নামে একটি গোত্র থাকলেও তাদের ভাষা যে টিকে আছে, তা আমাদের জানা ছিল না। রেংমিটচা ভাষাভাষীর লোকজন ম্রোদের সঙ্গে মূল স্রোতে মিশে যাওয়ায় তাদের সবাই এখন ম্রো ভাষায় কথা বলেন। ছয়জন ছাড়া এ ভাষা আর কেউ জানে না। ছেলেমেয়ে কেউ হয়ত বুঝতে পারবে, কিন্তু ওই ভাষায় জবাব দিতে পারে না।”

আলীকদম উপজেলায় একটি রেংমিটচা পাড়ার প্রধান কারবারী তিনওয়াই ম্রোর সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয়। উপজেলার সদর ইউনিয়নে একটি দুর্গম এলাকায় ওই পাড়ার নাম ক্রাংসি পাড়া। উপজেলা সদর থেকে তৈন খাল হয়ে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে হয় সেখানে।

দুর্গম তৈন মৌজার ক্রাংসি পাড়া। এই পাড়ার মাত্র তিনজন বাসিন্দা এখনও রেংমিটচা ভাষায় কথা বলেন।

তিনওয়াই ম্রোর ভাষ্য, এ পাড়ার বয়স আনুমানিক ৩০০ বছর। একসময় পাড়ার সবাই ছিলেন রেংমিটচা পরিবারের। পরে অনেকে মিয়ানমার ও ভারতে চলে যান। কেউ আলীকদমের অন্য জায়গায় চলে যান। অনেকে মারা গেছেন। এসব কারণে রেংমিটচা ভাষা বলতে পারে, এমন মানুষ নেই বললেই চলে।

“এখন এ পাড়ায় যে ২২টি পরিবার আছে, তার মধ্যে সাতটি রেংমিটচা পরিবার। তবে তিনজন ছাড়া কেউ এ ভাষা জানে না।”

এ পাড়ার বাসিন্দা সিংরা ম্রো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি রেংমিটচা পরিবারে সদস্য হলেও এ ভাষায় কথা বলতে পারেন না। সহজ কিছু কথা বুঝতে পারেন। তবে তার বাবা ৬৭ বছর বয়সী মাংপুং ম্রো রেংমিটচা ভাষা এখনও ভালো বলতে পারেন।

সিংরা জানান, তার বাবা ছাড়া বাকি যে পাঁচজন এখন রেংমিটচা ভাষায় কথা বলতে পারেন, তারা হলেন ক্রাংসি পাড়ার কোনরাও ম্রো (৭০) একই পাড়ার কোনরাও ম্রো (৬০), নোয়াপাড়া ইউনিয়নে মেনসিং পাড়ার থোয়াই লক ম্রো (৫৫), নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ওয়াইবট পাড়ার রেংপুং ম্রো (৬৫) এবং সাংপ্ল পাড়ার বাসিন্দা মাংওয়াই ম্রো (৬৩)। তাদের মধ্যে কোনরাও নামের দুজন নারী, বাকিরা পুরুষ।

দুর্গম তৈন মৌজার ক্রাংসি পাড়া। এই পাড়ার মাত্র তিনজন বাসিন্দা এখনও রেংমিটচা ভাষায় কথা বলেন।

ক্রাংসি পাড়ার মাংপুং ম্রো জানান, তার বয়স যখন ১০-১২ বছর, তখন পাঁচটি রেংমিটচা পাড়া ছিল। একেকটি পাড়ায় ৫০-৬০টি পরিবার ছিল। বাইরে থেকে কেউ পাড়ায় গেলেও তখন রেংমিটচা ভাষায় কথা বলতে হত।

“এরপরে আমদের কেউ কেউ বার্মায়, কেউ ভারতে চলে গেল। বাকিরা ম্রো জনগোষ্ঠীর মূল স্রোতে মিশে গেল। এভাবে দিন দিন আমাদের সংখ্যা কমতে থাকে।”

নিজের মাতৃভাষা ভুলে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মাংপুং ম্রো বলেন, “রেংমিটচা ভাষায় কথা বললে তখন ম্রোদের অনেকেই হাসাহাসি করত। আমাদের ছেলেমেয়েরাও সঙ্কোচ বোধ করত। রেংমিটচা ভাষায় আর কথা বলতে চাইত না। চর্চার অভাবেই সবাই নিজের ভাষা ভুলে যেতে শুরু করে।”

এ ভাষায় কোনো গান বা সংগীত আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনও এ ভাষায় কোনো গান তিনি শোনেননি। তবে ছন্দ মিলিয়ে কয়েকটি খেলার কথা শুনেছেন।

এ পাড়ার বাসিন্দা আরেক রেংমিটচা ভাষী কোনরাও ম্রো বলেন, তার দুই মেয়ে, এক ছেলের কেউ এ ভাষা বলতে পারে না।

“এখন ঘরেও নিজের ভাষায় কথা বলার কেউ নেই। বাইরে ম্রো ভাষা বলতে বলতে রেংমিটচা ভাষা বলার অভ্যাস চলে গেছে। আমি নিজের ভাষায় কিছু বলতে চাইলেও জবাব দেওয়ার মত কেউ নেই। সেজন্য দুঃখ হয় মাঝে মাঝে।

রেংমিটচাভাষী মাংপুং ম্রোর ছেলে সিংরা ম্রোর সন্তানরা জানে না এই ভাষা।

“কিন্তু নিজেদের ভাষায় কথা বলে বেঁচে থাকতে চাই আমরা। নতুনরা এ ভাষায় আর কথা বলতে পারে না, জানেই না। এই ভাষা কীভাবে টিকে থাকবে আমাদের জানা নেই।”

বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য লেখক সিংইয়ং ম্রোর মতে, রেংমিটচা ভাষাভাষীরা হয়ত আসলে আলাদা জনগোষ্ঠী ছিল।

“ভাষা ছাড়া সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রায় সবকিছু ম্রোদের সাথে মিল রয়েছে। সে কারণে ম্রোদের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তারা মিশে গেছে। বলতে গেলে তারা এখন ম্রো হয়ে গেছে। তারা এখন রেংমিটচা ভাষা বলে না, ম্রো ভাষায় কথা বলে। অনেক সময় নিজের ভাষা যেটুকু পারে, সেটাও বলতে চায় না সঙ্কোচের কারণে।”

সিংইয়ং জানান, হারিয়ে যেতে বসা এ ভাষা সংরক্ষণের পথ খুঁজতে আগে কয়েকবার বৈঠক করেছেন তারা। রেংমিটচা ভাষাভাষী যারা আছেন, তাদেরও ডেকেছেন।

“কিন্তু মুশকিল হল, তারা নিজেরাও এ ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী না। নিজের ভাষায় কথা বলতে উৎসাহ দিয়ে এবং তাদের রেংমিটচা পরিবার সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করলে হয়ত ভাষাটা ধরে রাখার একটা উপায় হয়।”

রেংমিটচা ভাষা নিয়ে গবেষণার বিষয়ে জানতে যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ কলেজের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ডেভিড এ পিটারসনের সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করেছিলেন এই প্রতিবেদক।

তিনি জানান, গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জার্মান নৃবিজ্ঞানী লরেন্স লফলার পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছিলেন ম্রো সম্প্রদায়ের ওপর গবেষণার কাজে। পরে তার কাজের অংশ নিয়ে হার্ভার্ড থেকে প্রকাশিত হয় এথনোগ্রাফিক নোটস অন ম্রো অ্যান্ড খুমি অব দি চিটাগাং অ্যান্ড আরাকান হিল-ট্র্যাকটস।

লফলার লিখেছিলেন, আলীকদমের তৈন মৌজা এলাকায় রেংমিটচা নামে একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের ভাষা আলাদা ও স্বতন্ত্র। তবে তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ম্রো মূল জনগোষ্ঠির সঙ্গে মিলে যায়।

এরপর জার্মানির লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাক্সপাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর অ্যানথ্রোপোলজির ফেলোশিপ নিয়ে ১৯৯৯ সাল থেকে বান্দরবানে কাজ শুরু করেন পিটারসন।

তিনি বলেন, “অনেকে মনে করেছিল রেংমিটচা ম্রোদের একটি উপভাষা। কিন্তু গবেষণা করে দেখেছি, এটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও আলাদা একটি ভাষা। দীর্ঘদিন তাদের সঙ্গে কাজ করে দেখেছি, জীবন-জীবিকা ও সামাজিক বিশ্বাস ম্রোদের কাছাকাছি। কিন্তু ভাষাগত দিক দিয়ে একেবারেই ভিন্ন।”

রেংমিটচা ভাষা খুমী, ম্রো, লুসাই, বম, খিয়াং ও পাংখোয়া ভাষার মত তিব্বতি-কুকি-চিন ভাষা পরিবারে অন্তর্ভুক্ত জানিয়ে তিনি বলেন, “মিয়ানমারের আরাকান ও চিন রাজ্যে এ ভাষা থাকতে পারে। কিন্তু গবেষণা করে আমি খুঁজে পাইনি। রেংমিটচা বাস্তবে বাংলাদেশেই পাওয়া গেছে।”

এ ভাষা সংরক্ষণের জন্য জীবিতদের কথা ধারণ করে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন ডেভিড পিটারসন। আর নতুন প্রজন্ম এবং তাদের ছেলেমেয়েদের এ ভাষায় কথা বলতে উৎসাহ দেওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন।