নাপিত-চিকিৎসক বিয়ে: গণমাধ্যমে এনে পুলিশের মানবাধিকার ‘লঙ্ঘন’

রংপুরে নারী চিকিৎসক ও সেলুন কর্মচারীর বিয়ের পর তাদের আটক করে গণমাধ্যমে এনে স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন বলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন মনে করছে।

রংপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2020, 06:06 PM
Updated : 29 Dec 2020, 06:10 PM

রংপুরের এক নারী চিকিৎসক এক সেলুন কর্মচারীকে বিয়ে করা নিয়ে সম্প্রতি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়।

২১ মাস আগে এই দুজন বিয়ে করেন। তখন চিকিৎসক নারীর বাবা অপহরণ মামলা করেন। গত ২১ ডিসেম্বর পুলিশ তাদের আটক করে গণমাধ্যমে হাজির করে। পরে নারী চিকিৎসককে ছেড়ে দিলেও তার স্বামীকে ওই মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়।

আইনি প্রক্রিয়ায় আগের স্বামীকে তালাক দিয়ে বর্তমান স্বামীর (সেলুন কর্মচারী) সংসারে ‘সুখে ছিলেন’ বলে জানিয়েছেন এই চিকিৎসক।

রংপুর নগরীর সেনপাড়ার বাসিন্দা ওই নারী একজন গাইনি চিকিৎসক। এই সেলুন কর্মচারীকে বিয়ে করার পর ২১ মাস ধরে ঢাকার মোহাম্মদপুরে চাঁন মিয়া হাউজিংয়ে স্বামী ও এক শিশু সন্তান নিয়ে বসবাস করছিলেন।

ওই নারীর বাবার করা অপহরণ মামলায় গত ২১ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে তাকে ‘উদ্ধার’ এবং তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করে রংপুর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

পরদিন (২২ ডিসেম্বর) রংপুর নগরীর কেরানীপাড়ায় সিআইডি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তাদের হাজির করা হয়। রংপুর সিআইডির পুলিশ সুপার মিলু মিয়া বিশ্বাস ওই সংবাদ সম্মেলন করেন।

এই নারী চিকিৎসক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি তো আমার সংসারে সুখে ছিলাম, বাবা তো আমার মানসম্মান কিছুই রাখলেন না। বাবার তো আমি কোনো ক্ষতি করি নাই। তিনি কেন এমনটি করলেন আমার জানা নেই।”

স্বামীর বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “আমি জানি না কোর্ট কেন তাকে আটক করে দিল। আমি তো কোর্টে সাক্ষ্য দিয়েছি, সব বলেছি; তারপরও ওকে কেন আটক করল, আমি জানি না।”

এই নারীর আগের স্বামীর ঘরে একটি সন্তান রয়েছে, পরের স্বামীর ঘরে আরেকটি সন্তান হয়।

আটক সেলুন কর্মচারীর ছোট ভাই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার ভাইকে তো উনি ভালোবেসে বিয়ে করেছেন, আমার ভাই কী অপরাধ করেছে, যার জন্য আজ তাকে জেল খাটতে হচ্ছে?”

এই দম্পতিকে সংবাদ সম্মেলনে হাজির করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। পুলিশ তাদের গণমাধ্যমে আনতে পারে কিনা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট ‘আমরাই পারি’ রংপুর জেলা সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সংবিধানে বলা আছে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং নারী যে কাউকে পছন্দ মতো বিয়ে করতে পারে। আইন তাদের আটকে রাখতে পারে না। তারা দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক; পছন্দ মতো বিয়ে করেছে। এখানে ধর্ম, গোত্র, বর্ণ কোনো ধরনের বাধা থাকবার কথা নয়।

“এক্ষেত্রে রংপুর সিআইডির এসপি মহোদয় যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা মানবাধিকারবিরোধী। সংবিধানে যে মানবাধিকারের কথা বা মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে, তা তিনি লঙ্ঘন করেছেন।”

তবে এই দম্পতিকে গণমাধ্যমে হাজির করায় কোনো ভুল দেখছেন না রংপুর সিআইডির পুলিশ সুপার মিলু মিয়া বিশ্বাস।  

তিনি যুক্তি দেখিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুলিশ যা করছে ঠিক করেছে। উনি ভালো চিকিৎসক। যাকে তিনি বিয়ে করেছেন তিনি লেখাপড়া জানেন না। চিকিৎসকের বাবার ফুটফরমাশ খাটতেন। চিকিৎসকেরও কাজে সাহায্য করতেন। স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছা তা করা নয়। চিকিৎসকের বাবার কথা ভাবতে হবে। তিনি এত কষ্ট করে মেয়েকে বড় করেছেন।”

মিলু বিশ্বাস জানান, গত বছরের মার্চে রংপুর নগরীর ওই ব্যবসায়ী তার গাইনি চিকিৎসক মেয়ে (৩৪) অপহৃত হয়েছেন উল্লেখ করে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। এই ঘটনায় দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও থানা পুলিশ চিকিৎসককে উদ্ধার করতে পারেনি। পরে মামলাটি তদন্তের জন্য সিআইডির কাছে আসে।

এই বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনরে উপ-পরিচালক সুস্মিতা পাইক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা আপনাদের মিডিয়ার মাধ্যমে জানার পর আমাদের চেয়ারম্যান স্যারের নির্দেশে তাৎক্ষণিকভাবে কমিশন থেকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে অভিযোগ গ্রহণ করেছি।”

তিনি বলেন, “একজন নারী কাকে বিয়ে করবেন, এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। আমাদের সংবিধান, মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র, সমস্ত জায়গাতেই নারীকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কাকে নিয়ে বাঁচবে এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।

“মাননীয় চেয়ারম্যান স্যার এটা খুবেই গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন এবং তার নির্দেশনায় আমি তাৎক্ষণিকভাবে যেখানে যেখানে কাজ করা দরকার আমি সেখানে সেখানে কাজ করছি।”

তাদের গণমাধ্যমে হাজির করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে কি না প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “একজন নারীকে যদি আপনি মানুষ মনে করেন, তাহলে অবশ্যই মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। হয় নাই কি? শুধু কি মানবাধিকার লঙ্ঘন, শিশু অধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, শিশু আইনের লঙ্ঘন হয়েছে।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা কর্তৃপক্ষর কাছে জবাব চেয়েছি। এটা যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়, অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।”